জঙ্গি আস্তানায় ৭ জনের দেহাবশেষ : বিস্ফোরণে মেঝেতে গর্ত

 র‌্যাবের ধারণা আত্মঘাতী বিস্ফোরণে দুই স্ত্রী দুই শিশু ও দুই সহযোগীসহ আব্দুল্লাহ নিহত

স্টাফ রিপোর্টার: রাজধানীর মিরপুরে দারুস সালাম থানা এলাকার বর্ধনবাড়ির সন্দেহভাজন জঙ্গি আস্তানা কমল প্রভা থেকে ৭টি পোড়া মৃতদেহ উদ্ধার করেছে র‌্যাব। উদ্ধার করা মৃতদেহগুলো আব্দুল্লাহ (৪৫), তার দুই স্ত্রী ফাতেমা (৩৪) ও নাসরিন (৩২), দুই সন্তান ওমর (১০) ও ওসামা (৩) এবং দুই সহযোগীর বলে ধারণা করছে র‌্যাব। নিহত সাতজনের শরীর এমনভাবে দগ্ধ হয়েছে যে সেগুলোর কোনটি কার লাশ তা তাত্ক্ষণিকভাবে শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে নিহতদের পরিচয় শনাক্ত করা হবে বলে জানিয়েছে র‌্যাব।

গত মঙ্গলবার রাতে ওই বাড়িতে আত্মঘাতী বিস্ফোরণের ঘটনায় আগুন ধরে যায়। এতে ওই সাতজন মারা যান বলে দাবি করছে র‌্যাব। ওই বাড়ির পাঁচতলার প্রতিটি কক্ষ আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মেঝের একটি অংশ ধসে যায়। ফায়ার সার্ভিসের চারটি ইউনিট আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। গতকাল সিআইডির ক্রাইম সিন ইউনিট ঘটনাস্থল থেকে প্রয়োজনীয় আলামত সংগ্রহ করেছে। আস্তানাটির আশপাশে বেশকিছু বাড়িতে সোমবার থেকে বিদ্যুত্, ডিশ ও গ্যাস সংযোগ বন্ধ করে দেওয়া হলেও বুধবার সন্ধ্যার পর তা স্বাভাবিক হয়েছে। পুলিশ মহাপরিদর্শক একেএম শহীদুল হক ও র‌্যাব মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদসহ ঊর্ধ্বতন পুলিশ এবং র‌্যাব কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। এদিকে গতকাল দুপুরের দিকে র‌্যাব আব্দুল্লাহর ছোট ভাই খোকাকে মিরপুরের দিয়াবাড়ি এলাকা থেকে আটক করেছে। তবে খোকা জঙ্গি কর্মকাণ্ডে জড়িত কি-না তা জানা যায়নি। সে বিষয়ে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। খোকাও আব্দুল্লাহর মতো কবুতর ও আইপিএস (ইনস্ট্যান্ট পাওয়ার সাপ্লাই) ব্যবসায় জড়িত ছিলেন।

বিকালে ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে র‌্যাব মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ বলেন, মঙ্গলবার রাতে আস্তানাটিতে পরপর তিনটি বড় ধরনের বিস্ফোরণ ঘটে। বিস্ফোরণ এতোটাই শক্তিশালী ছিলো যে ছয়তলা ভবনের পঞ্চম তলার ফ্লোরে গর্ত হয়ে গেছে। যে জায়গাটিতে গর্ত হয়েছে, সেখানে শক্তিশালী বিস্ফোরক ছিলো বলে ধারণা করা হচ্ছে। কেমিক্যালের আগুন ফ্লোরের গর্ত দিয়ে চার তলায় ছড়িয়ে পড়ে। বাড়িটি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। বিস্ফোরণের ফলে পঞ্চম তলার জানালার থাইগ্লাস ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। আগুন পুরো পঞ্চম তলায় ছড়িয়ে পড়ে। সেখানে থাকা কেমিক্যালেও আগুন ধরে যায়। কেমিক্যালের আগুনের কারণে সেখানকার সব জিনিসপত্র, মানুষজন মারাত্মকভাবে পুড়ে যায়। মানুষ পুড়ে প্রায় কয়লা হয়ে গেছে। ফলে স্বাভাবিকভাবে কাউকে চেনার কোনো উপায় নেই। ফরেনসিক পরীক্ষা ছাড়া তাদের শনাক্ত করা সম্ভব নয়।

র‌্যাব ও ফায়ার সার্ভিস সদস্যরা জানান, অভিযান চালিয়ে বাড়িটির চতুর্থ তলা পর্যন্ত পরিষ্কার করতে সক্ষম হয়েছেন তারা। পাঁচতলায় কক্ষগুলোতে অন্তত ৫০ থেকে ৫৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা ছিল। পঞ্চম তলায় থাকা সব বিস্ফোরক বিস্ফোরিত হয়েছে। সেখানে আর কোনো বিস্ফোরকের অস্তিত্ব প্রাথমিকভাবে মেলেনি। মারাত্মক বিস্ফোরণে বাড়িটির দরজা জানালা খুলে গেছে। দেয়ালের কিছু কিছু অংশ ধসে পড়েছে। অনেক আসবাবপত্র পুড়ে ছাই হয়ে গেছে।

র‌্যাব সূত্র আরো জানায়, জঙ্গি আব্দুল্লাহ ২০০৫ সালে নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন জেএমবির সাথে যুক্ত হন। আর ২০১৩ সালে যোগ দেন নব্য জেএমবিতে। তার বাসায় জঙ্গিদের আশ্রয় দেয়া হতো। শুধু আশ্রয় নয়, জঙ্গিদের অর্থের যোগান দিতেন আব্দুল্লাহ।

র‌্যাব মহাপরিচালক বলেন, বর্ধনবাড়ির ২/৩/-বি নম্বর বাড়ির পঞ্চম তলায় আব্দুল্লাহর ফ্ল্যাটে জেএমবির শীর্ষ নেতা সরোয়ার জাহান ও গুলশানের হোলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় হামলার অন্যতম মাস্টারমাইন্ড পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত তামিম চৌধুরীর যাতায়াত ছিল। সরোয়ার-তামিম গ্রুপের একজন শুরা সদস্য বর্তমানে কারাগারে আছে। তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেও আব্দুল্লাহ সম্পর্কে তথ্য পাওয়া গিয়েছিলো। বছর খানেক ধরে আব্দুল্লাহর সন্ধান চলছিল। অবশেষে তাকে খুঁজে পাওয়া সম্ভব হয়।

র‌্যাব মহাপরিচালক বলেন, আবদুল্লাহ ওই বাড়ির ছাদে কবুতর পুষতেন। এলাকায় ‘কবুতর আব্দুল্লাহ’ নামেও তার খ্যাতি রয়েছে। বিস্ফোরণে অনেক কবুতর মারা গেছে। যেগুলো জীবিত আছে, সেগুলোর পরিচর্যা করা হচ্ছে। নিরপরাধ দুটো বাচ্চা ছিল, নারী ছিল, আমরা চেষ্টা করেছিলাম তাদের সেইফ করার জন্য।

র‌্যাব-৪ এর একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, আব্দুল্লাহর পিতার নাম মৃত মীর ইউসুফ আলী। বাড়ি চুয়াডাঙ্গায়। তারা সাত ভাই। তবে তার বোনের সংখ্যা জানা যায়নি। এক বোন মেহেরুন্নেছা মঙ্গলবার র‌্যাবের কাছে আত্মসমর্পণ করেছেন। তিনি ঈদ উপলক্ষে ভাই আব্দুল্লাহর বাসায় বেড়াতে এসেছিলেন। আত্মসমর্পণকারী ওই নারী প্রতিবন্ধী। আব্দুল্লাহ জেএমবির সদস্য হলেও তিনি আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন আল কায়েদা ও তালেবান জঙ্গিদের অনুসারী। এজন্য তিনি তার দুই ছেলের নাম রেখেছেন দুই শীর্ষ জঙ্গি নেতার নামে। আল কায়েদা প্রধান ওসামা বিন লাদেনের নামের সাথে মিল রেখে ছোট ছেলের নাম রেখেছেন ওসামা। আর তালেবান জঙ্গিদের প্রধান মোল্লা ওমরের (নিহত) নামে বড় ছেলের নাম রেখেছেন ওমর।

উল্লেখ্য, জঙ্গি আস্তানা সন্দেহে রাজধানীর দারুস সালামের বর্ধনবাড়ির ২/৩-বি নম্বর কমল প্রভা বাড়িটি সোমবার রাত ১২টা থেকে ঘিরে রাখে? র‌্যাব। বাড়ির ৫ম তলার একটি ফ্ল্যাটে জঙ্গিদের অবস্থান চিহ্নিত করা হয়। পরে বাড়ির বিদ্যুত, গ্যাস ও পানির সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়। ওই বাড়ির ২৪টি ফ্ল্যাটের মধ্যে ২৩টি ফ্ল্যাটের ৬৫ জন বাসিন্দাকে সরিয়ে নেয়া হয়। মঙ্গলবার রাত সাড়ে ৭টা থেকে ৮টার মধ্যে জঙ্গি আব্দুল্লাহ আত্মসমর্পণে রাজি হন। কিন্তু আত্মসমর্পণ না করে রাত পৌনে ১০টার দিকে তিনি আত্মঘাতী বিস্ফোরণ ঘটান বলে জানিয়েছে র‌্যাব।