হাঁপানিয়ায় ঈদের নামাজ আদায়ের সময় তুমুল সংঘর্ষ : আহত ২৩ জনের মধ্যে একজনের মৃত্যু

আলমডাঙ্গার পল্লিতে পূর্ব বিরোধের নগ্ন প্রকাশ : আওয়ামী লীগ নেতা দেলোয়ার হোসেনের দায়ের করা মামলায় জেলা কৃষকলীগ সেক্রেটারি আসামি
স্টাফ রিপোর্টার: আলমডাঙ্গার পল্লি হাঁপানিয়ায় ঈদের নামাজ আদায়ের সময় দু’পক্ষের তুমুল সংঘর্ষে আহত উভয়পক্ষের মোট ২৩ জন আহতের মধ্যে একজন মারা গেছেন। আরও একজন মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছেন। তাকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় রাজশাহী মেডিকেল কলেজে নেয়া হয়েছে। সংঘর্ষে বোমা নিক্ষেপ ও গুলিও ছোড়া হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিতে হাপানিয়া ফাঁড়ি পুলিশ ৪ রাউন্ড গুলি ছোড়ে। সংঘর্ষে আহতদের দ্রুত চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে নেয়া হয়। খবর পেয়ে আহতদের শয্যাপাশে ছুটে যান চুয়াডাঙ্গা জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি জাতীয় সংসদের হুইপ সোলায়মান হক জোয়ার্দ্দার ছেলুন এমপি।
সংঘর্ষে গুরুতর আহতদের মধ্যে জয়নাল আবেদিনকে ঘটনার দিনই ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হয়। সেখানে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ে দুদিনের মাথায় গতকাল সোমবার দুপুর পৌনে ২টার দিকে মারা যান। লাশ গতকালই ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগে ময়নাতদন্ত শেষে বাড়ির উদ্দেশে নেয়া হয়। আজ মঙ্গলবার সকাল ১০টায় নিজ গ্রামে নামাজে জানাজা শেষে দাফন কাজ সম্পন্ন করা হবে। সংঘর্ষের দিনই আলমডাঙ্গা উপজেলার সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান হাঁপানিয়ার আওয়ামী লীগ নেতা দেলোয়ার হোসেন বাদি হয়ে ২৮ জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাতনামা কয়েকজনকে আসামি করে মামলা দায়ের করেন। আলমডাঙ্গা থানা পুলিশ গতরাতে শেষ খবর পর্যন্ত মোট ৮ জনকে গ্রেফতার করেছে। আসামির তালিকায় চিৎলা ইউপি চেয়ারম্যান চুয়াডাঙ্গা জেলা কৃষকলীগের সাধারণ সম্পাদক জিল্লুর রহমান জিল্লু ১ নম্বর আসামি।
গ্রামসূত্র ও পুলিশ জানিয়েছে, শনিবার সকাল ৮টার দিকে হাঁপানিয়া ঈদগাহে নামাজের জামাত শুরু হওয়ার আগে স্থানীয় যুবলীগ নেতা ইউপি সদস্য ইন্তাদুল হক ঈমামের স্থানে দাঁড়িয়ে আওয়ামী লীগের অন্য গ্রুপের বিরুদ্ধে বিভিন্ন রকম উসকানিমূলক ও রাজনৈতিক বক্তব্য দেয়া শুরু করে। এদের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরেই বিরোধ চলে আসছে। সকাল ৮টায় ঈদের নামাজের কথা থাকলেও প্রায় ৯টা বেজে গেলেও নামাজ না হওয়ায় উত্তেজনা দানাবাঁধে। গরু ও ছাগল কোরবানি দেয়ার জন্য তাড়াতাড়ি নামাজ আদায়ের জন্য বলতে থাকে। এক পর্যায়ে সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান দেলোয়ারের ভাই মহিবুল হক মন্টুর সাথে স্থানীয় মসজিদ ও মাদরাসার মালিকানাধীন ছয় বিঘা জমির একটি বাগানের আম বিক্রির হিসেব দাবি করেন। শুরু হয় বাকবিত-া। তার পক্ষের লোকজন ও বিপক্ষের মন্টুর লোকজনের মধ্যে ধাক্কা ধাক্কি শুরু হয়। ইউপি সদস্য ইন্তাদুলের লোকজন ধারালো অস্ত্র দিয়ে মন্টুকে ধাওয়া করলে তিনি হাঁপানিয়া ক্যাম্পে আশ্রয় নেন। ক্যাম্প পুলিশ ঘটনাস্থলে পেঁৗঁছে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে ৪ রাউন্ড ফাঁকা গুলি ছোড়ে। তারা সবাই ছত্রভঙ্গ হলে নামাজ অনুষ্ঠিত হয়। পরে নামাজ শেষে বাড়ি ফেরার পথে গ্রামের বাজারের অদূরে ইন্তাদুল ও তার লোকজন ধারালো অস্ত্র, বোমা ও আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে দ্বিতীয় দফায় হামলা চালায়। ইন্তাদুল তার হাতে থাকা পিস্তল দিয়ে চার রাউন্ড গুলি ছোড়ে ও তার লোকজন চারটি বোমার বিস্ফোরণ ঘটায়। এতে উভয় পক্ষের ২৩ জন আহত হন। এর মধ্যে ১৪ জনকে চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। কুদ্দুস আলীর ছেলে জয়নাল আবেদীন, আব্দুল আহাদের ছেলে সেলিম রেজা, মৃত ইসমাইল হোসেনের ছেলে মহিদুল হক মন্টু, ময়জুদ্দীন ম-লেরে ছেলে মতিয়ার রহমান, আনিচ উদ্দীনের ছেলে উসমান গণি, মৃত আইজাল হকের ছেলে আজিজুল হক, মৃত গোলাম রসুলের ছেলে হাসান, রকিবুল ইসলামের ছেলে মিলন, ইদ্রিস আলীর ছেলে গফুর আলী, মতিয়ার রহমানের ছেলে মকলেচুর রহমান, খেজমত আলীর ছেলে কাইয়ুম আলী, ইসলাম আলীর ছেলে আশরাফ আলী, সিরাজুল ইসলামের ছেলে ফিরোজ আলী ও ইকরামুল ইসলামের ছেলে সুইট। আহতদের মধ্যে ২ জন গুলিবিদ্ধ এবং বাকীদের শরীরে বোমার স্পিøন্টারের আঘাত রয়েছে বলে জানিয়েছেন হাসপাতালের জরুরী বিভাগের চিকিৎসক পরিতোষ কুমার ঘোষ। বাকীদের কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতাল, আলমডাঙ্গা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও মেহেরপুরের গাংনী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়েছে। চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতাল থেকে গুলিবিদ্ধ জয়নাল আবেদীন নামের একজনকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রেফার করা হয়। সেখানে তার মাথা থেকে এক রাউন্ড গুলি বের করা হয়েছে বলে তার পরিবারের দাবি। পরে গতকাল সোমবার দুপুরে সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তিনি।
এ ঘটনায় আলমডাঙ্গা উপজেলা পরিষদের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান জেলা আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সদস্য দেলোয়ার হোসেন বাদী হয়ে আলমডাঙ্গা থানায় হত্যা ও চেষ্টা বিস্ফোরক আইনে একটি মামলা করেছেন। ওই মামলায় চিৎলা ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান জিল্লুর রহমানসহ ২৮ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত অর্ধশতাধিক ব্যক্তিকে আসামি করা হয়েছে। এরমধ্যে ৮ জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। গ্রেফতারকৃতরা হলেন, বড় হাঁপানিয়া গ্রামের মুকুল আলী, আকিদুল ইসলাম, আব্দ্ুর রশিদ, শাহাবুল হোসেন, আরশাদ আলী, গিয়াস উদ্দিন, হামিদুল ইসলাম ও কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আব্দুল ওহাব।
মামলার বাদি দেলোয়ার হোসেন জানান, ঈদের দিনে হামলাকারীরা ২০ বছর আগে তার বাবাকে খুন করে। রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যস্ততায় মামলাটি আপোষ মীমাংসা করা হলেও পরবর্তীতে দফায় দফায় সন্ত্রাসী কর্মকা- চালিয়ে আসছে ইন্তাদুল। মাস কয়েক আগেও মন্টুর বাড়ি ঘর ভাঙচুরসহ তার মা, মন্টুর স্ত্রী ও ছেলেকে মারধর করেছে ইন্তাদুল ও তার লোকজন। বাবার পর এবার তারা আমাকে ও আমার পরিবারের লোকজনকে টার্গেট করেছে।
চুয়াডাঙ্গা পুলিশ সুপার নিজাম উদ্দিন, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর ও আলমডাঙ্গা সার্কেল) তরিকুল ইসলাম ও আলমডাঙ্গা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন।
খবর পেয়ে জাতীয় সংসদের হুইপ সোলায়মান হক জোয়ার্দ্দার ছেলুন হাসপাতালে এসে আহতদের খোঁজখবর নেন এবং দোষীদের শাস্তির দাবি করেন। এ ঘটনায় গ্রামটি প্রায় পুরুষশূন্য হয়ে পড়েছে। গ্রামের নারী ও শিশুদের নিরাপত্তায় সেখানে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন ও টহল জোরদার করা হয়েছে। আলমডাঙ্গা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আকরাম হোসেন বলেন, ঘটনার প্রেক্ষিতে আলমডাঙ্গা উপজেলার সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান দোলোয়ার হোসেন বাদী হয়ে মামলা দায়ের করেছেন। মামলায় এজাহারভুক্ত ৮ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। গ্রাম থেকে পুরুষেরা ভয়ে বাইরে অবস্থান করছে। তবে, নারী ও শিশুদের নিরাপত্তায় অতিরিক্ত ফোর্স মোতায়েন করা হয়েছে। বাকি আসামিদের ধরতে এলাকায় অভিযান অব্যাহত রয়েছে।
সরেজমিন ঘুরে আমাদের আসমানখালী প্রতিনিধি জানিয়েছেন, গ্রামটিতে বিভিন্ন বাড়িতে নারী ও শিশুরা আতঙ্কে রয়েছে। এদের একপক্ষ পুলিশ এবং অপরপক্ষ প্রতিপক্ষের দুর্বৃত্তদের নিয়ে আতঙ্কে রয়েছে। গ্রামবাসীরা জানান, ঈদের দিন তারা কেউই কোরবানি দিতে পারেননি। আগে গ্রামের সকল মানুষ এক জায়গায় কোরবানি দিয়ে মাংস গ্রামের দুঃস্থ মানুষদের মাঝে বন্টন করতেন। কিন্ত, সংঘর্ষের কারণে ঈদের দিন কোনো পশু জবাই হয়নি। এদিকে নিহত জয়নাল আবেদীনের ময়নাতদন্ত গতকাল রাতে সম্পন্ন করা হয়েছে। আজ মঙ্গলবার সকালে গ্রামে তার দাফন সম্পন্ন করা হবে বলে তার পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে।