চট্টগ্রামে গুলিবিদ্ধ একজনের মৃত্যু : বাংলাদেশ সীমান্তে গুলি : ঢাকায় মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে তলব
স্টাফ রিপোর্টার: মিয়ানমারের রাখাইনে পুলিশ ফাঁড়িতে ‘রোহিঙ্গা বিদ্রোহীদের’ হামলার পর নিরাপত্তা বাহিনীর দমন অভিযানের মুখে নতুন করে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ ঘটছে। কক্সবাজার সীমান্তের টেকনাফ ও উখিয়ার বিভিন্ন পয়েন্টে বাংলাদেশ সীমান্তরক্ষা বাহিনী বিজিবি অনুপ্রবেশ ঠেকাতে কড়া অবস্থানের কথা জানালেও গুলিবিদ্ধ ও আহতসহ অসংখ্য রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশের ভেতর দেখা গেছে। পালিয়ে এসে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে আশ্রয় নেয়া ছাড়াও আহত অনেককে কক্সবাজার ও চট্টগ্রামের হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে দেখা গেছে। এদের মধ্যে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় চিকিৎসা নিতে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গতকাল শনিবার সকালে দুই রোহিঙ্গা ভর্তি হওয়ার ঘণ্টা তিনেক পর একজন মারা যান বলে জানিয়েছেন হাসপাতাল পুলিশ ফাঁড়ির এএসআই আলাউদ্দিন তালুকদার।
শনিবার সকালে সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, কক্সবাজারের উখিয়ার কুতুপালং শরণার্থী শিবির সংলগ্ন এলাকার মেডিসিন স্যঁ ফ্রঁতিয়ে (এমএসএফ) হাসপাতালে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় ১২ জনের বেশি রোহিঙ্গা ভর্তি হয়েছে। এমএসএফ-হল্যান্ড হাসপাতাল ফটকে ডান হাতে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় দেখা যায় কামাল হোসেন নামে একজনকে। মংডুর ধুমবারিদা এলাকার আবু আহমদের ছেলে কামাল গুলিতে গুরুতর আহত হওয়ার পর পালিয়ে এসেছেন।
সেনাবাহিনী মংডুর রোহিঙ্গা অধ্যুষিত গ্রামগুলো সশস্ত্র অবস্থায় ঘিরে রেখেছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘সামনে যাকে পাচ্ছে গুলি করছে, সঙ্গে নানাভাবে নির্যাতনও চালাচ্ছে। তাদের গুলিতে ডান হাতে বাহুতে গুলিবিদ্ধ হয়ে এখানে (বাংলাদেশে) পালিয়ে এসেছি।’ বৃহস্পতিবার রাতে সেনাবাহিনীর গুলিতে আহত হওয়ার পর শুক্রবার রাতে পাহাড়ি পথ পেরিয়ে বাংলাদেশে পৌঁছেছেন বলছেন মিয়ানমারের এই নাগরিক। কামাল বলেন, সেখানে সেনাবাহিনী ব্যাপক তাণ্ডব চালিয়েছে। অনেকে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছেন। সবাই প্রাণ রক্ষায় দিগ্বিদিক পালাতে থাকায় ঠিক কতজন গুলিবিদ্ধ হয়েছে, কতজনের মৃত্যু হয়েছে তা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। এ অবস্থায় সীমান্তে বিজিবির নিয়মিত টহলের পাশাপাশি অতিরিক্ত ফোর্স বাড়িয়ে অনুপ্রবেশের চেষ্টা করা রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর বিভিন্ন তথ্য বিজিবির কর্মকর্তারা দিলেও পরিস্থিতি ভিন্ন রকম দেখা যায়।
বিজিবির টেকনাফ-২ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল এসএম আরিফুল ইসলাম জানান, শনিবার ভোর রাতে নাফ নদীর টেকনাফের হোয়াইক্যং ইউনিয়নের উলুবনিয়া পয়েন্ট দিয়ে অনুপ্রবেশ চেষ্টার সময় ১৭ রোহিঙ্গাকে তারা ফেরত পাঠিয়েছেন। এদের মধ্যে আটজন নারী, চারজন শিশু ও পাঁচজন পুরুষ রয়েছে। এছাড়া কোস্টগার্ড টেকনাফ স্টেশনের কন্টিনজেন্ট কমান্ডার লেফটেন্যান্ট সজীব জানান, ভোর রাতে নদীর বিভিন্ন সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে অনুপ্রবেশ চেষ্টার সময় শূন্যরেখা থেকে ৫৬ জন রোহিঙ্গাকে ফেরত পাঠানো হয়েছে। এদের মধ্যে অধিকাংশই নারী ও শিশু।
তবে দু দিনে গুলিবিদ্ধসহ নানাভাবে আহত রোহিঙ্গা ছাড়াও বিভিন্ন ক্যাম্পে শতাধিক রোহিঙ্গার আশ্রয় নেয়ার কথা জানান কুতুপালং অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্পের এ-২ বস্নকে বসবাস করা রোহিঙ্গা আব্দুস শফি। তিনি বলেন, গত দু দিনে গুলিবিদ্ধসহ নানাভাবে আহত ১২ জন স্থানীয় এমএসএফ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। এদের মধ্যে গুলিবিদ্ধ দুজনকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছিলো, এর মধ্যে মোহাম্মদ মুসা নামে একজন শনিবার সকালে মারা গেছে। এমএসএফ হাসপাতালে চিকিৎসাধীনদের অনেককেই চট্টগ্রাম মেডিকেলসহ বিভিন্ন হাসপাতালে পাঠানো হচ্ছে আব্দুস শফি জানান। তিনি বলেন, শনিবার ভোররাতে সীমান্ত পেরিয়ে কুতুপালং অনিবন্ধিত ক্যাম্পে নতুন করে পালিয়ে আসা পাঁচটি পরিবারকে আশ্রয় নিতে দেখেছেন। স্থানীয়দের কাছ থেকে শুনেছেন, এ ক্যাম্পে অন্তত ৫০টি পরিবার নতুন করে আশ্রয় নিয়েছে।
শফির দেয়া তথ্যে, কুতুপালং অনিবন্ধিত ক্যাম্পে আশ্রয় নেয়া মংডুর ঢেঁকিবুনিয়া এলাকা থেকে পালিয়ে আসা নূর নাহার, রফিক ও কহিনুরে সঙ্গে কথা হয়। তারা জানান, মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর সদস্যরা নির্বিচারে গুলি চালিয়ে রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ ও শিশুদের হত্যাসহ নানা নির্যাতন চালাচ্ছে। এতে অনেকে হতাহত হয়েছেন। বৌদ্ধরাও তাদের ওপর হামলা চালাচ্ছে।
মিয়ানমারে জাতিগত নিপীড়নের শিকার হয়ে বাংলাদেশে পাঁচ লাখের বেশি রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়ে আছে কয়েক দশক ধরে। মুসলিম রোহিঙ্গাদের নিজ দেশের নাগরিক হিসেবে মানতে নারাজ মিয়ানমার।
অন্যদিকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের আহ্বান সত্ত্বেও নতুন করে শরণার্থী নিতে অপারগতা জানিয়ে আসছে বাংলাদেশ সরকার। নতুন করে আশ্রয় না দেয়ার ক্ষেত্রে রোহিঙ্গাদের জঙ্গি তৎপরতাসহ নানা ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার যুক্তিও দেখানো হচ্ছে। এর মধ্যে গত বছরের অক্টোবরে সীমান্ত পুলিশের চৌকিতে বিদ্রোহী রোহিঙ্গাদের হামলায় নয় পুলিশ সদস্য নিহত হওয়ার পর সেনা অভিযানের মুখে প্রায় ৮৭ হাজার মিয়ানমারের নাগরিক বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করে।
এবার দিন দশেক আগে মিয়ানমার সরকার রাখাইন রাজ্যে নতুন করে সেনা মোতায়েন করলে রোহিঙ্গাদের মধ্যে উৎকণ্ঠা তৈরি হয়। এরই মধ্যে বৃহস্পতিবার রাতে মংডু ও বুথিদাউং এলাকার ৩০টি পুলিশ ফাঁড়ি ও একটি সেনা ক্যাম্পে হামলা করে রোহিঙ্গা বিদ্রোহীরা।
এবারের হামলায় এখন পর্যন্ত কতজন রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করেছে তার সঠিক পরিসংখ্যান জানা না গেলে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে আগে থেকে বসবাসরতরা বলছেন, অন্তত এক হাজারেরও বেশি রোহিঙ্গা নতুন করে অনুপ্রবেশ হয়েছে। নতুন করে রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশের ঘটনা নিশ্চিত করতে পারেননি বিজিবিসহ রোহিঙ্গাদের নিয়ে কার্যক্রম চালানো সংশ্লিষ্ট সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। সীমান্ত দিয়ে অনুপ্রবেশ চেষ্টাকারী রোহিঙ্গাদের অধিকাংশকেই শনিবার ভোর রাতের মধ্যে ফেরত পাঠানো হয়েছে বলছেন কক্সবাজারে বিজিবির-৩৪ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মঞ্জুরুল হাসান খান। তিনি বলেন, বিক্ষিপ্তভাবে কিছু রোহিঙ্গা সীমান্তের শূন্যরেখা বরাবর অবস্থান করছে। বিজিবি সদস্যরা সীমান্তে কড়া অবস্থানে থেকে যেকোনোভাবে এদের অনুপ্রবেশ ঠেকাতে প্রস্তুত রয়েছে।
মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষীদের গুলি: রাখাইন রাজ্যে নতুন করে গোলযোগের কারণে বাংলাদেশ সীমান্তে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের লক্ষ্য করে মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষীরা গুলি ছুড়েছে। গতকাল শনিবার দুপুরে এই গুলিবর্ষণের পর সীমান্তে সতর্কতা বাড়ানো হয়েছে বলে বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবির কক্সবাজার ৩৪ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মঞ্জুরুল হাসান খান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, বেলা সোয়া ১টার দিকে তারা তিন থেকে চার রাউন্ড গুলি ছোড়ে। তবে এ ঘটনায় কেউ হতাহত হয়নি। বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম ইউনিয়নের তমব্রু এলাকায় শূন্যরেখায় আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের লক্ষ্য করে সীমান্তের ওপার থেকে গুলি চালায় মিয়ানমারের বর্ডার গার্ড পুলিশ (বিজিপি)।
মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে তলব: এদিকে রাখাইন রাজ্যে সর্বশেষ সহিংসতার জেরে বাংলাদেশে নতুন করে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ বন্ধে মিয়ানমারকে পদক্ষেপ নিতে বলেছে বাংলাদেশ। শনিবার দুপুরে ঢাকায় মিয়ানমারের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স অং মিন্টকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তলব করে বাংলাদেশের এ অবস্থানের কথা জানানো হয়। মিয়ানমারের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স এদিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব (এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয়) মাহবুব জামানের সঙ্গে দেখা করেন। আলোচনার পর বিকেলে মাহবুব জামান এসব তথ্য জানান। আলোচনায় উপস্থিত দুই কূটনীতিকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রাখাইনে সংঘর্ষে বেশ কিছু লোকজন হতাহত হওয়ার পর সেখানকার মুসলিম সংখ্যালঘুরা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের চেষ্টা করছে। তাই উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সেখানকার বেসামরিক লোকজনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার বিষয়ে মিয়ানমারের পদক্ষেপ নেয়া উচিত সেটা অং মিন্টকে বলা হয়েছে। তা ছাড়া আলোচনার মাধ্যমে সেখানকার সমস্যার সমাধানের বিষয়টিও তাকে বলা হয়েছে। সমস্যা যেহেতু মিয়ানমারের, তাই তাদেরই এর সমাধান করতে হবে। সেই সঙ্গে লোকজনের বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ বন্ধে তাদের (মিয়ানমারকে) কার্যকর পদক্ষেপ নিতে বলেছে বাংলাদেশ।