চুয়াডাঙ্গা আলমডাঙ্গার শিবপুরের ছালমাকে পাচার করে পাঁচকমলাপুরের দালাল হাবলু ঢাকার আল জাহান এজেন্সির মাধ্যমে
আহসান আলম/আলম আশরাফ: সৌদি আরবে বিক্রি হওয়া নারী ছালমা খাতুন (২৭) কয়েক মাস ধরে নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়ে গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় দেশে ফিরেছেন। গতপরশু রাতে বাড়ি আলমডাঙ্গার পল্লি শিবপুর পশ্চিমপাড়ায় ফেরেন। গতকাল শুক্রবার তাকে চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ভালোবেতনে গৃহপরিচারিকার চাকরির কথা বলে পাঁচকমলাপুরের হাবলু দালাল তাকে ঢাকা গুলশান-২ নতুনবাজারের আল জাহান এজেন্সির মাধ্যমে সৌদি আরবের এক পরিবারের কাছে ৬ লাখ টাকায় বিক্রি করে দেন। খবর পেয়ে গতকাল রাত সাড়ে ৮টার দিকে চুয়াডাঙ্গার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আব্দুল মোমেন হাসপাতালে ছালমা খাতুনের শয্যাপাশে হাজির হন। তিনি ঘটনার বর্ণনা শুনে হাবলু দালালসহ তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। একই সাথে তিনি চিকিৎসারও খোঁজখবর নেন।
জানা গেছে, আলমডাঙ্গার খাদিমপুর ইউনিয়নের শিবপুর গ্রামের জিনারুল ইসলাম ও তার স্ত্রী ছালমা খাতুন দরিদ্র দম্পতি। পার্শ্ববর্তী পাঁচকমলাপুরের মৃত আবদুল জলিলের ছেলে হাবলু ওই দম্পতিকে বিদেশে গিয়ে চাকরি নিয়ে ভাগ্যের চাকা ঘোরানোর স্বপ্ন দেখান। স্বামী স্ত্রী দুজনকেই সৌদি আরবে গৃহপরিচারিকার চাকরিসহ পাঠানোর কথা বলে ৯ মাস আগে দেড় লাখ হাতিয়ে নেন হাবলু। এক মাস পর ছালমার ভিসা এসেছে, জিনারুলের ভিসা পরে আসবে বলে হাবলু জানান এবং ছালমাকে সৌদি আরবে যাওয়ার ব্যবস্থা করেন। ছালমা তার স্বামীকে ছাড়াই সৌদি আরবে পৌঁছে দালালচক্রেরই সহযোগিতায় সেখানে এক বাড়িতে গিয়ে ওঠেন। শুরু করেন কাজ। এসব তথ্য জানিয়ে ছালমা খাতুন বলেছেন, মাস খানেকের মাথায় যখন বেতনের কথা বলি, তখন ওই পরিবারের লোকজন আমার ওপর অগ্নিমূর্তি ধারণ করে। বলে কিসের বেতন? তোমাকে তো ২ বছরের জন্য ৬ লাখ টাকা দিয়ে বাংলাদেশি দালালের নিকট থেকে কিনে নিয়েছি। এ কথা শুনে কাজ করতে অর্স্বীকৃতি জানাতেই শুরু হয় নির্মম নির্যাতন। দিনের পর দিন আটকে নির্যাতন করিয়ে পরিবারের যাবতীয় কাজ দিন রাত করিয়ে নিতে থাকে। ২ মাসের মাথায় একই ভবনের পৃথক ফ্লাটে থাকা বাংলাদেশের চট্টগ্রামের এক নারী সাথে পরিচয় হয়। তিনি আমার হাল দেখে হাসপাতালে ভর্তি করার ব্যবস্থা করেন। পুলিশ হাসপাতালে নিয়ে ভর্তি করানোর পর ২৫ দিনের মাথায় ওই পুলিশ হাসপাতাল থেকে নিয়ে আবার ওই বাড়িতেই তুলে দিয়ে আসে। আবারও শুরু হয় নির্যাতন। সারা শরীরে আঘাতের পর আঘাত করতে থাকে ওরা। মুখ বুঝেই সহ্য করতে হতো ওদের নির্যাতন। কান্নারও জো ছিলো না। মারের পর মার। কয়েক মাসের মাথায় ওই পৃথক ফ্লাটের সেই চট্টগ্রামের নারী আবারও উদ্ধার করেন। হাসপাতালে নিয়ে ভর্তি করেন। হাসপাতালে এবার সাংবাদিকরা হাজির হলে তাদের কাছে কষ্টের কথা খুলে বলি। সব কিছু শুনে বুঝে সাংবাদিকসহ হাসপাতালের কিছু লোকের দয়ায় ২ হাজার টাকা তুলে আমাকে বাংলাদেশ দূতাবাসে পাঠায়। সেখান থেকে দেশে ফেরতের ব্যবস্থা করা হয়। গত বুধবার যখন বিমানযোগে ফিরছিলাম, তখন আমাকে দেখে বিমানের অন্যযাত্রীরা ঘটনা শুনতে চান। সব কিছু খুলে বললে তারা সকলে মিলে ২০ হাজার টাকা তুলে আমার হাতে দেন। সেই টাকা নিয়ে বুধবার বিকেলে দেশের মাটিতে নামি। পরদিন বৃহস্পতিবার বাড়ি ফিরি। এরপর সেই হাবলু দালাল মোবাইলফোনে আমার স্বামীর সাথে যোগাযোগ করে মামলা না করার জন্য হুমকি দিতে শুরু করেন। পরে বলে, তোমাদের টাকা ফেরত দেয়া হবে, ঢাকায় এসো।
ছালমা খাতুন ঘটনার বর্ণনা দেয়ার মাঝে তার শরীরের হাত ও পায়ের অসংখ্য ছ্যাঁকা দেয়া ক্ষত দেখিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন। তিনি বলেন, ওই দালালদের শাস্তি না হলে আমি মরেও শান্তি পাবো না। ওদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই। সেখানে ঘরে আটকে যেভাবে নির্যাতন করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন ছালমা খাতুন তা রোমহর্ষক।
এ ব্যাপারে পাঁচকমলাপুর গ্রামের মৃত আবদুল জলিলের ছেলে বর্তমানে কুলপালা গ্রামের ঘরজামাই হাবলু বলেন, আমি সালমার কাছ থেকে কোনো টাকা পয়সা নেইনি।
প্রসঙ্গত, শুধু ছালমা খাতুন নয়, বহু নারীই ভাগ্যের চাকা ঘোরাতে মধ্যপ্রাচ্যে পাড়ি জমিয়েছেন। এদের অনেকেই নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়ে কোনোরকম বাড়ি ফিরলেও কেউ কেউ দেশে নূন্যতম যোগাযোগও করতে পারছেন না। অবশ্য কিছু নারী রয়েছেন যারা ভাগ্যক্রমে গৃহকর্তা ভালো পেয়ে মাসে মাসে টাকা পাঠাচ্ছেন বাড়ি।
এদিকে, আইনি সহায়তা দেয়ার জন্য পাশে দাঁড়িয়েছে চুয়াডাঙ্গা জেলা লোকমোর্চা। গতকাল শুক্রবার বিকেলে সংগঠনের নেতৃবৃন্দ নির্যাতিতা ছালমা খাতুনকে দেখতে চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে যান। এ সময় তারা নির্যাতিতার প্রয়োজনীয় আইনি সহায়তা দেয়ার আশ্বাস দেন। উপস্থিত ছিলেন চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার লোকমোর্চার সভাপতি সহিদুল হক বিশ্বাস, সহসভাপতি সাহানা ইউসুফ কেয়া, জেলা লোকমোর্চার সদস্য জেলা পরিষদের সদস্য নুরুন্নাহার কাকলী, অ্যাড. হানিফ উদ্দিন, উপজেলা লোকমোর্চার সদস্য হেনা আক্তার ও জেলা লোকমোর্চার সচিব কানিজ সুলতানা। ছালমা খাতুনের টিকিৎসা সহায়তায় জেলা পরিষদের সদস্য নুরুন্নাহার কাকলী আর্থিক সহায়তা করেন।