মায়াবি জগত ছেড়ে যাওয়ার মধ্যে কোনো বাহাদুরি নেই, নেই কৃতিত্ব। তাছাড়া চলার পথে সফলতা, বিফলতা থাকেই। জীনযাত্রার কিছু বাঁকে ব্যর্থতা অবশ্যই স্বার্থকতারই সোপান। তাহলে পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়ে বা প্রত্যাশিত ফল না পেয়ে নিজের জীবনপ্রদীপ নিজের হাতে নিভিয়ে দেয়ার অর্থ কি বোকামি নয়? অবশ্যই। তবে ওই পথে প্ররোচনা রোধেও বাস্তবমুখি পদক্ষেপ প্রয়োজন। বিশেষ করে শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন অতিবগুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষার মানবৃদ্ধির নামে দফায় দফায় পরীক্ষার্থীদের নিয়ে পরীক্ষা করা অর্থাৎ শিক্ষার্থীদের গিনিপিগ বানানোর মধ্যে বুদ্ধিমত্তার পরিচয় বহন করে না, বরঞ্চ খতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এবার এইচএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশের পর কুমিল্লা শিক্ষাবোর্ডে বহু শিক্ষার্থীদের আত্মহনন কি তারই খেসারত নয়?
এবার শুধু কুমিল্লা শিক্ষাবোর্ডের নয়, সকল বোর্ডেরই উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার ফল বিপর্যয় হয়েছে। শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন, উত্তরপত্র মূল্যায়নে মান নিশ্চিত করার কারণে এমনটি হয়েছে। এর কয়েক বছর আগে জিপিএ-৫ পাওয়ার হিড়িক আর ঢালাও পাসের হার প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ার পর এবার যদি মূল্যায়নে কড়াকাড়ির কথা বলা হয়, তাহলে নিশ্চয় পূর্বের খাতা মূল্যায়নে ছিলো নমনীয়তা। একবার নমনীয়, একবার কড়া মানেই কি পরীক্ষার্থীদের নিয়ে যাচ্ছে তাই করা নয়? নিশ্চয়। জাতির অগ্রযাত্রা ত্বরান্বিত করতে অবশ্যই মানসম্পন্ন শিক্ষা প্রয়োজন। বিশ্বমানের শিক্ষা ছাড়া তথ্যপ্রযুক্তি বৈপ্লবিক যুগে কোনো জাতিই যে এগিয়ে সাফল্যের শীর্ষে পৌঁছুতে পারবে না তা বুঝতে বোধকরি কারোরই বাকি নেই। শিক্ষা শুধু পুঁথিগত নয়, শিক্ষা হতে হবে বাস্তবসম্মত। যে শিক্ষা শিক্ষিত করার বদলে শুধু সনদ দেয়, সেই শিক্ষা জাতির মেরুদ- শক্ত করে না। বহুলাংশে উল্টোটাই ডেকে আনে। সে কারণেই শিক্ষার মান বৃদ্ধিতে বাস্তবমুখি পথেই হাঁটতে হবে। তাই বলে শিক্ষার্থীদের ওপর পরীক্ষা নিরীক্ষা চালানো চলবে না। শিক্ষার্থীদের ওপর পরীক্ষা নিরীক্ষা চালিয়ে কোনো জাতিই কখনো লাভবান হয়নি, হয় না। তাছাড়া পরীক্ষার উত্তরপত্র মূল্যায়নে কম বেশি নম্বর দেয়ার ক্ষেত্রে কখনো কখনো পরীক্ষকের মেজাজমজির ওপরও নির্ভর করে। সময় স্বল্পতা, কিংবা কোনো কোনো পরীক্ষকের পারিপার্শ¦কতায় বিগড়ানো মেজাজের বলিও তো হয় কিছু পরীক্ষার্থী। তাছাড়া কিছু শিক্ষক তথা পরীক্ষক আছেন যাদের হাতে নম্বর মানে যেন সোনার মোহর। যথাযথ মূল্যায়নের মতো মেধাবী শিক্ষক নিয়েও রয়েছে প্রশ্ন। এসব কারণে খাতা পুনঃমূল্যায়নের সুযোগ আছে। সেই সুযোগও নিশ্চয় প্রত্যাশিত ফল না পাওয়া পরীক্ষার্থীদের সহায়ক। তবে তা অনেক ক্ষেত্রেই নাকি দায়সারা গোচের হয় বলে জনশ্রুতি। আবেদকদের খাতা পুনঃমূল্যায়নে দায়সারা গোচের কিছু না করে যথাযথ মূল্যায়নপূর্বক পূর্বের পরীক্ষকের দেয়া নম্বর যদি অবমূল্যায়নের নজির মেলে সেক্ষেত্রেও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার নিয়ম, নীতি পদ্ধতি প্রচলনের গুরুত্ব নীতি-নির্ধারকেরা অনুধাবন করেন বলে তো নজির মেলে না।
আত্মহনন কোনো ধর্মে যেমন সমর্থন করে না, তেমনই তার মধ্যে কোনো কৃতিত্বও থাকে না। যা থাকে তাহলো ব্যর্থতার কাছে আত্মসমর্পণ। লজ্জায় মুখ আড়াল করা? সেটাও তো বোকারই বোকামি। নিজেকে গড়ে তুলতে হলে পিছুলোকে কিছু বলে যেমন পরিহার প্রয়োজন, তেমনই ব্যর্থতাগুলোকে সফলতার সিঁড়ি হিসেবেই দেখতে হয়। বিশ্ববরেণ্যদের জীবন সংগ্রামে ব্যর্থতাগুলোই কি সফলতা বয়ে আনেনি? তাহলে একটি মাত্র পরীক্ষায় প্রত্যাশিত ফল না পাওয়ার মানে কি জীবনের পরাজয়? শিক্ষার্থীদের এ বিষয়ে সচেতন করা দরকার। একই সাথে দরকার শিক্ষার্থীদের নিয়ে যাচ্ছে তাই করার প্রবণতা পরিহার। শিক্ষার্থীর শিক্ষায় মনোনিবেশের পরিবেশ গড়ার বদলে শুধু পড় পড় যেমন সুফল বয়ে আনে না, তেমনই পরীক্ষার খাতা মূল্যায়নই শিক্ষার্থীর একমাত্র মেধা মাপার মাপকাঠি নয় নিশ্চয়।