জীবননগর উপজেলা শহরে ভ- কবিরাজ কাজলের সীমাহীন প্রতারণা : চিকিৎসার নামে যুবতীদের ঘরে রেখে দেন মাসের পর মাস

 

স্টাফ রিপোর্টার: খোদ জীবননগর থানা শহরের ওপরেই চলছে ভ- কবিরাজ কাজলের সীমাহীন ভ-ামি। আর চিকিৎসার নামে চলছে প্রতারণা। চিকিৎসা দেয়ার নামে যুবতীদের ঘরে আটকিয়ে রাখেন মাসের পর মাস। সম্প্রতি সরেজমিন জানা যায় যতোসব ভ-ামির কথা। জীবননগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে কিছুটা দূরে নদীর ধারে রয়েছে একটি পুরোনো গোরস্তান। এর কাছ থেকে একটু দূরে কাজল গড়ে তুলেছেন তার আস্তানা। স্থানীয়রা এটাকে কাজলের আস্তানা বা কাজলের বাগান হিসেবেই  চেনে। আমবাগানের ভেতরে কয়েকটি আধাপাকা টিনের ছাপড়া। আস্তানার একটি টিনের ঘরের ভেতরেই কাজল আটকে রাখেন সকল মহিলা রোগীকে। তার একান্ত ভক্তরা দাবি করেন, তিনি নাকি সমস্ত জটিল রোগের চিকিৎসা করতে পারেন। এমনকি ক্যানসারও সারাতে পারেন। মামলায় জেতাতে পারেন, ছেলে-মেয়ের মধ্যে সম্পর্ক সৃষ্টি করিয়ে দেন ইত্যাদি ইত্যাদি। রোগ যাইহোক তার মুখস্থ কথা জিনে ধরেছে। সারতে সময় লাগবে, আস্তানায় থাকতে হবে। এরপর রোগের মাত্রা দেখে চলতে থাকে চিকিৎসা। শুধু দিন নয়, রাতেও চলে চিকিৎসা। প্রতিবেশীরা জানায়, রাতে অনেক সময় রোগীর চিল্লাচিল্লিতে এক ভুতূড়ে অবস্থার সৃষ্টি হয়। তারা এ নিয়ে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছেন। সর্বক্ষণ স্টোভে জ্বলে আগুন, কখনও পোড়ানো হচ্ছে ধান-গম, খাবার রুটি ইত্যাদি। এভাবেই চলছে যতোসব উদ্ভট চিকিৎসা। চিকিৎসার কোনো সরকারি লাইসেন্স অথবা রোগী রাখার অনুমোদন ছাড়াই আস্তানায় রোগী রেখে বছরের পর বছর চলছে তার এই অবৈধ অপচিকিৎসার ব্যবসা। নিজের পরিচয় গোপন করে এই প্রতিবেদক কয়েকজন রোগীর সাথে কথা বলতে যান কাজলের আস্তানায়। কবিরাজ কাজল বলেন, রোগীদের গায়ে জিন আছে আপনি কথা বলতে পারবেন না। এই প্রতিবেদক অনুরোধ করলে কাজল বলেন, ঠিক আছে, আমি দাঁত দিয়ে জিন ধরে রাখছি আপনি কথা বলুন। পাশেই একটি পাত্রে কিছু একটা রেখে দীর্ঘ সময় ধরে জ্বালানো হচ্ছে। জিজ্ঞেস করে জানা যায়, এতে শয়তান জিনদের পোড়ানো হচ্ছে। পাশেই এক শিশুর পেটের ওপর দীর্ঘক্ষণ যাবত একটি কাঁচের গ্লাস চাপিেেয় রাখা হয়েছে। এর মাধ্যমে নাকি তার অ্যাপেনডিসাইটিস রোগের চিকিৎসা করা হচ্ছে। খোঁজ খবরে বেরিয়ে আসে আরও অনেক উদ্ভট ধরনের ভুতূড়ে চিকিৎসার কথা।

তার এই প্রতারণার ফাঁদে পা দিয়ে অনেক মহিলা তার স্বামীর ঘর ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। ভেঙে গেছে অনেকের সংসার। কিন্তু লোকলজ্জার ভয়ে কেউই তার বিরুদ্ধে মামলা করেনি। জীবননগর শহরের বেশ কয়েকজন জানিয়েছেন, কাজলের কারণে তাদের সংসার ভেঙে গেছে। তারা কাজলের প্রতি খুবই ক্ষিপ্ত। যেকোনো সময় তারা প্রতিশোধ নিতে মামলা করতে পারেন। পার্শ্ববর্তী পাতিলা গ্রামের জাহান্নারা এবং কাঞ্চন নামে দুজন যুবতী অনেক আগেই ছেড়েছেন স্বামীর ঘর। তাদের স্বামীরা অনেক চেষ্টা-তদবির করেও তাদেরকে ফিরিয়ে আনতে ব্যর্থ হয়েছেন। এখন তারা কাজলের একান্ত সহযোগী হিসেবে তার কাছে পড়ে রয়েছেন দীর্ঘদিন ধরে। তার প্রতেবেশীরা জানায়, কাজল নারী রোগীদের তার আস্তানায় রাখার কারণে তার স্ত্রী তাকে সব সময় প্রতিবাদ করতেন। অন্য নারীদের সাথে থাকলে তিনি সংসার করবেন না বলে ¯্রফে জানিয়ে দেন এবং নিজেই কাজলকে তালাক দিয়ে চলে গেছেন অনেক আগে।

জানা যায়, তিনি কাজলের বিরুদ্ধে মামলাও করেছিলেন জীবননগর থানায়। দামুড়হুদা দশমীপাড়ার জনৈক শহিদুল তার স্ত্রীকে চিকিৎসার জন্য নিয়ে যান কাজলের আস্তানায়। কাজল তাকে বলেন তার স্ত্রীকে জিনে ধরেছে, এবং মারাত্মক জিন। এজন্য তাকে আস্তানায় রেখে চিকিৎসা চালাতে হবে। সরল মনে শহিদুল তার স্ত্রীকে রেখে আসেন আস্তানায়। মাঝে মাঝে তিনি তার স্ত্রীকে দেখতে আসতেন। মাসের পর মাস চিকিৎসা চলতে থাকে কিন্তু রোগীর কোনো উন্নতি হয় না। এদিকে হিতেবিপরীত হয়। শহিদুল দীর্ঘদিন রাখার পরও যখন ভালো হয় না তখন তিনি তার স্ত্রীকে বাড়িতে ফিরিয়ে আনতে যান, কিন্তু স্ত্রী বেঁকে বসেন এবং ¯্রফে জানিয়ে দেন তিনি কাজলের আস্তানা ছেড়ে যাবেন না। তিনি কয়েক দফায় চেষ্টা করেও তার স্ত্রীকে বাড়িতে ফিরিয়ে আনতে ব্যর্থ হন। অবস্থা বেগতিক দেখে অবশেষে তার বেশ কয়েকজন আত্মীয়স্বজন নিয়ে বলপূর্বক তাকে বাড়িতে ফিরিয়ে আনেন। তার আত্মীয়-স্বজনরা জানায়, বাড়িতে আসার পরও তার ঘোর কাটেনি, মাঝে মাঝেই তিনি কাজল কাজল বলে চিৎকার করতেন। তাদের ধারণা কাজল তাকে খারাপ তদবিরের মাধ্যমে তাকে বশ করে ফেলেছেন। আর একজন নারী রোগীর সাথে বিস্তারিত কথা বলে জানা যায়, আরও আজগুবি এবং ভয়াবহ চিকিৎসার কথা। তিনি জানান চিকিৎসার নামে ভ- কবিরাজ কাজল তাকে এক বছর তিন মাস একটি ছোট ঘরে আটকে রাখেন। তাকে মিথ্যা আশ্বাস দেন জিনের দৃষ্টি লেগেছে আস্তে আস্তে সেরে যাবে। কিন্তু দীর্ঘদিন থাকার পরও তার কোনো উন্নতি হয়নি। অবশেষে তার কয়েকজন আত্মীয়স্বজন তাকে কয়েক দফায় ফিরিয়ে আনতে ব্যর্থ হন। আপনি কেনো আসলেন না, এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি জানান, কবিরাজ কাজল আমাকে ফুঁসলিয়ে আমার মুখ বন্ধ করে রাখতেন। এ কারণে আমি নিজের কোনো কথা বলতে পারতাম না। শেষমেশ অবস্থা বেগতিক দেখে তার আত্মীয়স্বজনরা তাকে আস্তানা থেকে উদ্ধার করতে গেলে কাজলের নারী সহযোগীরা তাদের ওপর চড়াও হন এবং একজনের বোরকা টেনে ছিঁড়ে ফেলেন। তার আত্মীয়স্বজনরা তাকে জোরপূর্বক বাড়িতে ফিরিয়ে নিয়ে আসেন। এ রকম আরও অনেক ঘটনার কথা জানালেন প্রত্যক্ষদর্শীরা।

কথা হয় স্থানীয় বাসিন্দা, মেম্বার-মাতবর শ্রেণির কয়েকজন, উপজেলার চেয়ারম্যান এবং পৌর মেয়রসহ প্রশাসনের কয়েকজনের সাথে। প্রায় সকলেই জানান, কাজল একজন আস্ত ভ-। তার ভ-ামি এবং প্রতারণার বিরুদ্ধে সম্প্রতি জীবননগর থানায় একটি জিডি করেছে ভুক্তভোগীরা। এছাড়া জীবননগর উপজেলা নির্বাহী অফিসার বরাবরও একটি অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়েছে। পুলিশের একজন কর্মকর্তা এবং একজন আইন বিশেষজ্ঞ জানান, কোনো লিখিত অভিযোগ না থাকলেও জনস্বার্থে প্রশাসন এই ধরনের প্রতারক কবিরাজদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে পারেন। কাজলের ভক্তরা দাবি করেন, প্রশাসন তার বিরুদ্ধে কিছুই করতে পারবে না। ফোনে যোগাযোগ করা হলে জীবননগর পৌর মেয়র জাহাঙ্গীর আলম জানান, প্রশাসন ভ- কবিরাজ কাজলের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিলে তিনি সর্বাত্মক সাহায্য করবেন। জীবননগর থানার ইউএনও সেলিম রেজাও আশ্বাস দেন তিনি এ ব্যাপারে যথাযথ ব্যবস্থা নেবেন। সম্প্রতি চুয়াডাঙ্গা এবং তার পার্শ্ববর্তী জেলাগুলোতে এ ধরনের ভ- কবিরাজদের উৎপাত বেড়েছে চরমভাবে। বিজ্ঞসমাজ মনে করেন, তাদের বিরুদ্ধে অনতিবিলম্বে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা দরকার, যাতে ভবিষ্যতে আর কেউ এ ধরনের ভ- চিকিৎসার নামে মানুষকে প্রতারিত করতে না পারে।