স্টাফ রিপোর্টার: ২০০৬ সালে ক্ষমতা ছাড়ার পর থেকে প্রতিকূলতা পিছু ছাড়েনি বিএনপির। গত এক দশকে দলের অধিকাংশ নেতাই ছিলেন নিষ্ক্রিয়। এ কারণে সরকারবিরোধী প্রতিটি আন্দোলন ব্যর্থ হওয়ায় বলতে গেলে বিধ্বস্ত হয়ে পড়েছিলো দলটি। কিন্তু সম্প্রতি একাদশ সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয়ার দলীয় ইঙ্গিতে সর্বস্তরের নেতাকর্মীরা সক্রিয় হয়ে উঠেছেন। সংসদে ৩০০ আসনে লড়তে প্রায় এক হাজার মনোনয়নপ্রত্যাশী নেতা নিজ নিজ সংসদীয় এলাকায় সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড ও নির্বাচনী প্রচারণা শুরু করেছেন। এছাড়া কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত সর্বস্তরের কমিটি গঠনের কাজ ইতিবাচকভাবে এগুচ্ছে। কেন্দ্রীয় কমিটির ফাঁকা পদ পূরণ এবং উপ-কমিটির ঘোষণা আসবে চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া লন্ডন থেকে ফেরার পরই। এসব কারণে গত এক দশকের মধ্যে বর্তমানে বিএনপি সবচেয়ে বেশি চাঙ্গা। তবে চুয়াডাঙ্গায় তেমন তৎপরতা নেই বললেই চলে।
দলটির সাংগঠনিক অবস্থার সংক্ষিপ্ত বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ২০০৬ সালের বিভিন্ন প্রতিকূলতার কারণে বারবার চেষ্টা করেও একটিবারের জন্যও ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি তারা। ২০০৭ সালে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় শীর্ষ নেত্রীসহ দলের সিনিয়র নেতাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতিসহ অসংখ্য অভিযোগে মামলা হয়। সেই মামলার ঘানি আজও টানতে হচ্ছে তাদের। সেই সময়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের চেয়ে বিএনপি নেতাদের ওপর অভিযোগের মাত্রা বেশি থাকায় নানাভাবে বেশি কোণঠাসা হয়ে পড়ে দলটি। দলের দ্বিতীয় শীর্ষ নেতা তারেক রহমানকেও অনির্ধারিত সময়ের জন্য দেশ ছাড়তে হয়। এরপর ২০০৮ সালে নির্বাচনে অংশ নিলেও তাদের ভরাডুবি হয়। ক্ষুদ্র সংসদীয় দল নিয়ে ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে ২০০৯ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত সংসদে যেমন বিএনপি সুবিধা করতে পারেনি তেমনি রাজপথেও ছিল নীরব। আর অধিকাংশ নেতাই নিজেকে এবং সম্পদ বাঁচাতে বলতে গেলে একেবারেই নিষ্ক্রিয় ছিলেন। সঙ্গতকারণে ২০১৪ সালে একতরফা নির্বাচন করে আবারও ক্ষমতায় যেতে বিশেষ অসুবিধা হয়নি আওয়ামী লীগের জন্য। একতরফা নির্বাচন করায় জনগণের সমর্থন নিয়ে আন্দোলনের মাধ্যমে স্বল্প সময়ে মধ্যে ক্ষমতাসীনদের মসনদ থেকে হটানো যাবে ভাবলেও দুর্বল সাংগঠনিক কাঠামো এবং একের এক ভুল সিদ্ধান্তের কারণে ২০১৪ ও ২০১৫ সালে বড় আন্দোলন করেও দলটি পুরোপুরি ব্যর্থ হয়। ফলে দল যেমন সাংগঠনিকভাবে বিপর্যস্ত আর সিনিয়র নেতা থেকে শুরু করে কর্মীরা পর্যন্ত মামলার ভারে ন্যুব্জ হয়ে পড়েন। এরপর দলকে ঘুরে দাঁড় কারানোর জন্য ২০১৬ সালের মার্চ মাসে জাতীয় কাউন্সিল করে দলটি। কিন্তু নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া জাতীয় নির্বাচনে অংশ না নেয়ার পূর্বের সিদ্ধান্ত থেকে সরে না আসায় দলকে ঘুরে দাঁড় করানো কঠিন হয়ে পড়ে। তবে সম্প্রতি একাদশ সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয়ার প্রকাশ্যে ঘোষণা দেয়ার পর চাঙ্গা হতে শুরু করে দলটি। পাশাপাশি ৩০০ আসনে ৯০০ প্রার্থী থাকার কথা জানান দিয়ে দেশব্যাপী নেতারা সক্রিয় হতে শুরু করেন। যার প্রভাব দেখা যাচ্ছে চলমান সদস্য সংগ্রহ অভিযানে। দলে দলে বিএনপির নতুন সদস্য হিসেবে সাধারণ মানুষ পর্যন্ত নাম লেখাতে শুরু করেছেন।
বিএনপির সিনিয়র এক নেতা জানান, ২০১৪ সালের নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত ভুল না হলেও নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক কিছু সিদ্ধান্ত ভুল ছিলো। এরপর পরবর্তী নির্বাচন বর্জনের আভাস দেয়াটাও ছিলো মস্তবড় ভুল। নির্বাচনমুখী দল হিসেবে একের পর এক নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্তে নেতাকর্মীরা ঝিমিয়েও পড়েছিলেন। কোনো অবস্থাতেই দলকে চাঙ্গা করা সম্ভব হচ্ছিলো না। কিন্তু সম্প্রতি একাদশ নির্বাচনে অংশ নেয়ার ঘোষণা দলের জন্য টনিক হিসেবে কাজ করেছে। সারাদেশে বিএনপির নেতাকর্মীরা এখন উজ্জীবিত। নিতে শুরু করেছে নির্বাচনের প্রস্তুতি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আগামী নির্বাচনে ৩০০ আসনের জন্য বিএনপির ৯০০ জনের একটি সম্ভাব্য প্রার্থীর তালিকা করেছে। আর এই তালিকা অন্তর্ভুক্ত হতে আরও ১০০ নেতা এখনো কাজ করে যাচ্ছেন। বিশেষ করে তরুণ নেতারা শেষপর্যন্ত তালিকায় নিজের অবস্থান ধরে রাখতে দেশব্যাপী সক্রিয়ভাবে কাজ শুরু করেছেন। নিজেদের অনুসারী বাড়াতে ৫ থেকে ৫০ হাজার পর্যন্ত নতুন সদস্য সংগ্রহ করার মিশনে নেমেছেন। তারা কৌশলে নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণা চালাচ্ছেন। অংশ নিচ্ছেন বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে। নির্বাচনের ঢের সময় বাকি থাকলেও সাধারণ মানুষ এখনই নির্বাচনী আমেজ টের পাচ্ছেন। সম্ভাব্য প্রার্থীরা বিভিন্ন দিবস ও উপলক্ষকে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাকর্মী ও ভোটারদের প্রার্থিতার বিষয়টি জানিয়ে দিচ্ছেন। এছাড়া সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও নির্বাচনী প্রচারণা চালাচ্ছেন। যেসব নেতাকে আন্দোলনের মাঠে দেখা যায়নি বললেই চলে তারা এখন দলীয় কাজে ব্যাপক সক্রিয় হয়ে উঠেছেন। এছাড়া এতদিন দলীয় কাজে যেসব নেতাকে অর্থকড়ি ব্যয় করতে দেখা যায়নি তাদের অনেকে প্রয়োজনে দলকে আর্থিক সহায়তা করার আশ্বাস দিচ্ছেন বলে জানা যায়।
বিএনপি সূত্রে জানা গেছে, আর্থিক সংকটের কারণে সদস্য সংগ্রহ অভিযান শুরু করে দলটি ব্যাপক সাড়া পাচ্ছে। ১০ কোটি টাকার লক্ষ্য নিয়ে এ অভিযান শুরু হয়েছে। এরই মধ্যে প্রায় দুই কোটি টাকার ফরম বিক্রি হয়েছে।
বিএনপি সূত্র জানায়, দলকে আরও চাঙ্গা করতে আগামী দুই মাসের মধ্যে জেলা ও অঙ্গ দলের কমিটিগুলো পুনর্গঠন করার টার্গেট করা হয়েছে। এ পর্যন্ত ৫০টি জেলা কমিটি পুনর্গঠন করা হয়েছে। বিরোধপূর্ণ কমিটি পুনর্গঠনের জন্য দলের এক ভাইস চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে সিনিয়র কয়েকজন নেতাকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা বিএনপি চেয়ারপারসন দেশে ফেরা আগেই সব জেলা পুনর্গঠনের আশ্বাস দিয়েছেন। আন্দোলনের কেন্দ্রস্থল ঢাকা মহানগর বিএনপির উত্তর ও দক্ষিণের পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠনের কাজও প্রায় শেষ। এছাড়া যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল, মহিলাদলসহ বেশ কয়েকটি অঙ্গদলের পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠনও প্রায় শেষপর্যায়ে রয়েছে। বিএনপিপ্রধান দেশে ফেরার পরই বিভিন্ন ইউনিট ও অঙ্গদলের পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করে হবে।
বিএনপির এক সিনিয়র নেতা জানান, ২০১৫ সালের আন্দোলনের পর যে বিপর্যয় হয়েছিল তা কাটিয়ে উঠতে শুরু করেছে বিএনপি। সাংগঠনিকভাবে দল এখন অনেক চাঙ্গা। আগামী দিনের আন্দোলন, জাতীয় নির্বাচনে দলীয় প্রার্থী তালিকা করা, স্থায়ী কমিটির শূন্য পদ পূরণ, জাতীয় নির্বাহী কমিটির গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি পদে পদায়ন, গুরুত্বপূর্ণ জেলা কমিটি গঠনের বিষয়ে বিএনপি চেয়ারপারসন দেশে ফিরেই সিদ্ধান্ত দিবেন। তখন দল আরও অনেক শক্তিশালী হবে। দুর্বল সাংগঠনিক কাঠামোর কারণে এতদিন দাবি আদায় সম্ভব না হলেও সংগঠন শক্তিশালী হওয়ায় নির্বাচনকালীন সরকারের দাবি আদায় এবার সম্ভব হবে বলেও মনে করেন তিনি।
বিএনপির সাংগঠনিক অবস্থা সম্পর্কে দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রহুল কবির রিজভী বলেন, আগের যে কোনো সময়ে চেয়ে বিএনপি এখন অনেক বেশি শক্তিশালী। দলের সাংগঠনিক শক্তি বিষয়টি চলতি বছরের শেষ নাগাদ আরও বেশি দৃশ্যমান হবে।