বিবেকের তাগিদে প্রসূতির কষ্ট লাঘবে কর্তব্যপরায়ণতা কাম্য

অবশ্যই পূর্বের যেকোনো সময়ের তুলনায় বর্তমানে শিশু ও প্রসূতি মৃত্যুর হার দেশে হ্রাস পেয়েছে। তার মানে এই নয় যে, জেলা সদর হাসপাতালগুলোর প্রসূতি বিভাগে চিকিৎসার মান বেড়েছে। বরঞ্চ বহুক্ষেত্রেই নির্মম, অমানবিক চিত্র প্রকাশ পায়। বিশেষ করে চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালের প্রসূতি বিভাগে প্রায় প্রতিরাতই যেন আসে রাত পার না হওয়ার মতো কষ্ট নিয়ে। কারণ প্রসূতি যতোই যন্ত্রণায় কাতরাক, যতোই তার জরুরি অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন হোক কোনো উপায় নেই। প্রসূতি বিভাগের প্রধান চিকিৎসক তথা গাইনি কনসালটেন্ট হাসপাতালের কাছাকাছি থাকেন না। সেবিকাই ভরসা। মাঝে মাঝে আয়াই প্রসূতির পাশে পরিত্রাণের একমাত্র ভরসা হয়ে থাকতে দেখা যায়। এটা কি কোনো জেলা পর্যায়ের সরকারি হাসপাতালের প্রসূতি ওয়ার্ডের ছবি হওয়া উচিত?
চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালের প্রসূতি বিভাগে ভর্তি হওয়া এক প্রসূতি গতপরশু রোববার রাতে তীব্র ব্যথায় কাতরাতে থাকেন। পানি শূন্যতায় গর্ভের সন্তানের প্রাণরক্ষা দূরের কথা, প্রসূতিই ক্রমশ জীবনঝুঁকির মধ্যে যেতে থাকেন। কর্তব্যরত স্টাফ নার্সসহ আয়া প্রসূতির সন্তান ভূমিষ্ঠ করার চেষ্টা করেন। গাইনি কনসালটেন্ট হাসপাতালে দিনে থাকলেও রাতে পাওয়া প্রায় অসম্ভব। কারণ তিনি থাকেন দর্শনায়। সদর হাসপাতালে চিকিৎসার দশা দেখে প্রসূতির দরিদ্র নিকটজনেরা রাতেই হাসপাতাল থেকে পাশের ক্লিনিকে নিতে বাধ্য হন। চুয়াডাঙ্গার ডাক্তার পরিবার হিসেবে পরিচিত পরিবার পরিচালিত ক্লিনিকে অস্ত্রোপচার করা হয়। নবজাতক ভূমিষ্ঠ হলেও দেখা যায় যথাসময়ে সঠিক চিকিৎসার বদলে টানাটানি বা সন্তান ভূমিষ্ঠ করার চেষ্টার কারণেই নবজাতকের মাথা গুরুতর আঘাতপ্রাপ্ত। নবজাতককে সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরদিন সোমবার নবজাতক মারা যায়। ঘটনাগুলো যাদের সামনে হয়েছে তারা কিছুটা হলেও প্রসূতির কষ্টটা উপলব্ধি করেছেন। এ ধরনের ঘটনা মাঝে মাঝেই পত্রস্থ হয়। প্রতিকার মেলে না। শুধু কি চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে ক্ষেত্রে? মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রে সব রকম আয়োজন থাকলেও রাতে চিকিৎসক পাওয়া সেখানেও প্রায় অসম্ভব। উপজেলার চিত্র আরো করুণ।
চুয়াডাঙ্গা জেলা স্বাস্থ্য বিভাগের শীর্ষ কর্মকর্তা তথা সিভিল সার্জন হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন একজন নারী। সৎ সততা ও কর্মনিষ্ঠাবান হিসেবে তার উজ্জ্বল ভাবমূর্তিও দিন দিন ফুটে উঠছে। চুয়াডাঙ্গা জেলার স্বাস্থ্য বিভাগের দায়িত্বভার গ্রহণের পর জেলার সদর হাসপাতালসহ উপজেলা পর্যায়ের স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে চিকিৎসকের উপস্থিতিসহ চিকিৎসার মান প্রত্যাশিত করার প্রয়াসের সুফল ইতোমধ্যেই পেতে শুরু করেছে জেলাবাসী। তাছাড়া চুয়াডাঙ্গা পৌর মেয়রকে উদ্বুব্ধ করে হাসপাতালের পরিবেশ সহনীয় পর্যায়ের রাখার পাশাপাশি জাতীয় সংসদের হুইপ চুয়াডাঙ্গা-১ আসনের সংসদ সদস্যের সহযোগিতায় হাসপাতালের উন্নয়ন ত্বরান্বিত করার উদ্যোগ অনুকরণীয় হয়ে উঠতে যাচ্ছে। যার কাছে পাওয়া যায়, যে তার কর্তব্যপরায়ণতা দিয়ে আস্থা অর্জন করেন, তার প্রতি আমজনতার প্রত্যাশা সঙ্গত কারণেই বাড়ে। চুয়াডাঙ্গা সিভিল সার্জন ডা. রওশন আরা বেগম সত্যিই প্রত্যাশা বাড়িয়েছেন। জাগিয়েছেন আশা। যদিও অনিয়ম তাড়িয়ে ন্যায়প্রতিষ্ঠার পথে হাঁটা তথা যুদ্ধটা অতোটা সহজ নয়। ও পথে ভালো মানুষগুলোর সমর্থন সর্বাত্মক থাকলেও গুটি কয়েক মন্দদের দাপটে সত্যিই টেকা বড় দায়। তারপরও হাসপাতালের নির্মম দৃশ্যাবলি দূর করতে তিনি আরো বেশি শক্ত হয়ে স্বস্তি ফেরাবেন বলেই আমাদের বিশ্বাস।
চিকিৎসক পেশায় যারা নিয়োজিত তারা অবশ্যই মেধাবী। মেধাযাচাই করেই বদ্যি হওয়ার বিদ্যা অর্জনের সুযোগ দেয়া হয়। সেবার ব্রত নিয়ে চিকিৎসক হতে হলে যেমন মেধাবীদের কঠোর অধ্যবসায় থাকে, তেমনই জাতির কাড়ি কাড়ি টাকাও বিনিয়োগ করতে হয়। এরপর যখন সেবদানের পর্যায়ে আসেন তখনও মাস গেলে মাইনে দেয়া হয় অন্যদের তুলনায় কোনো অংশে কম নয়। তাহলে সেবাদানে কেন অলসতা? কেনই বা অনিয়ম? একজনের ওপর অনেক চাপ? তেমনটি কি সত্যিই পরিলক্ষিত হয়? বিবেকের কাঠগাড়ায় নিজেকে দাঁড় করিয়ে এসব প্রশ্নের জবাব কি একবারও কর্তব্যপরায়ণতার তাগিদ দেয় না? নিশ্চয় আমাদের বিবেক অতোটা ভুতা হয়ে যায়নি, যতোটা হলে নিজেকে মানুষ বলে দাবি করা যায় না। বিবেকের তাগিদে প্রসূতির কষ্ট লাঘবে কর্তব্যপরায়ণতা কাম্য।

Leave a comment