‘দশে মিলে করি কাজ, হারি জিতি নাহি লাজ’ যদিও দশে মিলে কোনো কাজ করলে তাতে পরাজয়ের শঙ্কা খুবই ক্ষীণ। সময়ের ¯্রােতে একান্নবর্তী পরিবার পুরোনো গল্পে রূপান্তর হলেও সঞ্চয়ে পারিবারিক ও মহল্লাভিত্তিক বা পেশার বদৌলতে পরিচিতদের মধ্যে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সল্প ও নির্দিষ্ট মেয়াদের মৌখিক সনদে সমবায় সমিতির প্রচলন বেড়েছে। বিশেষ করে ধর্মীয় উৎসবকে সামনে রেখে সমিতির মেয়াদ নির্দিষ্ট করাটা শুধু রেওয়াজে নয়, অতীব প্রয়োজনীয় হয়ে দেখা দিয়েছে। এবারও ঈদ উৎসবের আগের দিন অসংখ্য ক্ষুদ্র সমিতির তহবিল ভাগাভাগি করার মধ্যে সদস্যদের সঞ্চয়ের তৃপ্তি মাখা মুখম-ল উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। যে পরিবারের উপার্জনক্ষম পুরুষের আয় স্বল্প এবং নির্দিষ্ট, সেই পরিবারগুলোও ক্ষুদ্র সমিতির বদৌলতে মর্যাদা রেখেই ভালোভাবে ঈদ উদযাপন করতে পারছে।
আগে মহল্লাভিত্তিতক গরু-ছাগল জবাই করে মাংস বিক্রি করতেন কিছু সুযোগ সন্ধানী খ-কালীন কসাই। এখন? মহল্লায় মহল্লায় গরু-ছাগল জবাইয়ের সংখ্যা জনসংখ্যা অনুপাতে বেড়েছে। তবে খ-কালীন মাংস বিক্রেতাদের দাপট হ্রাস পেয়েছে। কারণ সমিতির মাধ্যমে নিজেদের সামর্থ অনুযায়ী সাঞ্চিত অর্থে উৎসবের আগে বা সময় সুযোগ মতো গরু-ছাগল কিনে পালনের পর জবাই করে মাংস নেয়ার রেওয়াজ। এ রেওয়াজে যেমন পারিবারিক মর্যাদা রক্ষার্থে অর্থাৎ অন্যের কাছে হাত পাতার মানসকিতা থেকে রক্ষা করছে, তেমনই মাংসের বাজারে মাংস ব্যবসায়ীদের অধিক মুনাফা হাতানোর দাপটের লাগাম টানতে সহায়ক হচ্ছে। ঘরে ঘরে পশু পালনের রেওয়াজ ত্বরান্বিত করতে পারলে ঈদুল আজহা বা কোরবানির ঈদেও কোরবানির পশুর ক্ষেত্রেও স্বনির্ভরতা অর্জন সম্ভব। দেশে মাংসের চাহিদা পূরণও অসম্ভব নয়। ভোগ-বিলাসের পূর্বশর্ত নিজের পায়ে মেরুদ- খাঁড়া করে দাঁড়াতে পারার মতো সক্ষমতা অর্জন। আমাদের সমাজের যাত্রা সে পথে হলেও মন্থর গতি সচেতনতায় ঘাটতিরই সাক্ষ্য দেয়। অল্প দিনে অনেক এগিয়ে যাওয়া বহু সমাজ অবশ্যই আমাদের অনুকরণীয় হতে পারে। দক্ষিণ কোরিয়াকে যখন বোঝা ভেবে ছেড়ে দেয় জাপান, তখন ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ। অভাব আর অভাব। হাহাকার। কাজ নেই, কাজ থাকলেও মজুরি মানে পেটেভাতে। ৪ জনের একটি পরিবারের একজন কষ্টে কাজ জোটালেও দু দিনের মজুরিতে একবেলাও কারো পেট পুরতো না। ৪ জনকেই একসাথে একদিন পেট পুরে খেতে হলে তাদের সকলকেই চাহিদার অর্ধেক খেয়ে গচ্ছিত বা সঞ্চিত করতে হতো প্রায় পক্ষকাল। যদিও একপর্যায়ে তারা আধাপেট খেয়ে সঞ্চিতটুকু ব্যয়ের বদলে কাজ না পাওয়া দিনগুলোর জন্য রেখেই দিতো। আর যারা কাজ পেতো না, তাদের ছুটতে হতো প্রকৃতির পথে। আগান-বাগান ঘুরে, নদ-নদী সাগর হাতড়ে যা পেয়েছে তাই তারা খাওয়ার উপযোগী করে নিয়েছে। এতে যেমন বাঁচার যুদ্ধে ওরা প্রকৃতিকে নিজের করে নিতে পেরেছে, তেমনই আধাপেটা খেয়ে শিখেছে সঞ্চয়। কৃচ্ছতা সাধন আর অপচয় রোধে সচেতনতা বৃদ্ধির পাশাপাশি রাষ্ট্র সঞ্চয়ের নিরাপত্তা দিয়ে নির্মাণ করেছে জাতির ভবিষ্যত। ওরা এখন স্বপ্নের সাফল্য পেরিয়ে সুখ সাগরে ভেসে বেড়ায়। সে তুলনায় যদিও এখনও আমরা আয়েশি বাতাসে গা এলিয়ে, তবুও প্রয়োজনের তাগিদে সমাজের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সঞ্চয়ের প্রয়াস প্রশংসার দাবি রাখে।
ঘরে ঘরে পশু পালন ধরে রাখতে তা লাভজনক করতে হবে। এজন্য চোরাচালানোর মূলচাবি নিজেদের হাতে রাখা জরুরি। কখন কেন পড়শি দেশের পাচার হয়ে আসা গরু-মোষ নেবো, কখন নেবো না তা যদি আমরা আমাদের মতো করে নিয়ন্ত্রণে নিতে পারি তাহলে ঘরে ঘরে পশু পালন লাভজনক করা সম্ভব। তাছাড়া স্বল্প আয়ের মানুষের সঞ্চয়ে মৌখিক সনদের বদলে লিখিত কিছু করার বিষয়টির দিকে গুরুত্ব দেয়ার পাশাপাশি ব্যাংকগুলোতেও দলভুক্ত ক্ষুদ্র সঞ্চয় সহজলভ্য করা দরকার। সময়ের ¯্রােতে প্রয়োজনের তাগিদে সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়ার পথ মূলতঃ সমাজই দেখায়। তাগিদ বুঝে সমাজপতিরা যদি সমাজের দেখানো পথটারই নিরাপত্তা বাড়ায় তাহলে পিছিয়ে পড়াদের অগ্রযাত্রায় গতি বাড়ে। সে গতি দান বা দয়ায় বহুক্ষেত্রেই থামিয়ে ওদের অমর্যাদার আসনে বসায়।
সকলকে ঈদোত্তর শুভেচ্ছা।