খুঁজে দেয়ার দায়

 

শিশুদের শৈশবকালীন অবস্থা বিবেচনায় বাংলাদেশের যে অবস্থান আন্তর্জাতিক সংস্থা সেভ দ্য চিলড্রেনের জরিপে উঠে এসেছে, তা হতাশাজনক হলেও বিস্ময়কর কি? বস্তুত শহুরে শিশুরা তো বটেই, গ্রামাঞ্চলেও কীভাবে চিরায়ত শৈশব হারিয়ে যাচ্ছে, তা বহুল আলোচিত। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জসীম উদ্দীন, শরৎচন্দ্রের ধ্রুপদী সাহিত্যে আমরা বাংলার শিশুদের যে দূরন্ত ও অবারিত শৈশবের চিত্র পেয়ে থাকি, তা এখন সত্যিই গল্পের মতো শোনায়। অস্বীকার করা যাবে না যে, প্রযুক্তি ও পারিবারিক কাঠামোতে ব্যাপক পরিবর্তনের কারণে বিশ্বব্যাপীই শৈশবচিত্রে পরিবর্তন এসেছে। কিন্তু বাংলাদেশে সেই পরিবর্তন কতোটা দ্রুত ঘটেছে, আলোচ্য জরিপ তার প্রমাণ। দেখা যাচ্ছে, ১৭২টি দেশের মধ্যে পরিচালিত এই জরিপে আমাদের অবস্থান ১৩৪তম। এমনকি দক্ষিণ এশিয়ার ভারত, মালদ্বীপ, শ্রীলঙ্কাও আমাদের চেয়ে এগিয়ে। আমরা জানি, এখন শহরের শিশুরা কীভাবে জানালার গ্রিলবন্দি হয়ে বাইরের খোলা আকাশ দেখে; কীভাবে অভিভাবক পরিবেষ্টিত কিংবা স্কুলভ্যানে করে বিদ্যালয়ে যায়। খেলার মাঠ কমে যাওয়ায় তাদের বিকেলগুলো কাটে স্মার্টফোনের গেমস বা ইউটিউবে। বিদ্যালয়েও যেভাবে পাঠ্যক্রম তৈরি করা হয়ে থাকে, শৈশবেই তারা শিক্ষার চাপে পড়ে। শিশুর চেয়ে বইয়ের ব্যাগের বেশি ওজন নিয়ে এখানে কম আলোচনা হয়নি। আবার প্রথম শ্রেণি থেকেই একশ্রেণির অভিভাবক যেভাবে শিশুদের প্রতিযোগিতায় ঠেলে দেয়, তাও স্বাভাবিক শৈশবের অন্তরায়। প্রায় একই পরিস্থিতি গ্রামাঞ্চলে। কিছু শিশুর বাড়তি বিড়ম্বনার নাম দারিদ্র্য। পথশিশুদের পরিস্থিতি আরও করুণ। পথশিশু থেকে নায়ক বনে যাওয়ার রঙিন কাহিনি আমরা চলচ্চিত্রে মাঝে মধ্যে দেখি বটে; বাস্তবে তাদের জীবন অনেকটা ধূসর। রেলস্টেশনে, ফুটপাতে, পার্কে রাত কাটাতে দেখে তাদের মাথার ওপর ছাদের অভাবই প্রথম চোখে পড়ে; তাদের খাওয়া ও পরা নিয়ে শতব্যস্ত নাগরিক কখনও কখনও দুর্ভাবনায়ও ভোগেন বৈকি। কিন্তু তাদের জীবনের অন্ধকার আরও গাঢ়।

কিছুদিন আগে একটি পরিসংখ্যানে আমরা দেখেছিলাম, পথশিশুদের ৭২ শতাংশই শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়। উপযুক্ত শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা ও কর্মসংস্থানের সুযোগ পেলে তাদের জীবন আর দশটা শিশুর মতো হতে পারত সন্দেহ নেই। এই পরিস্থিতির উত্তরণ ঘটাতেই হবে। ঘর বা পথে, সব শিশুরই হারানো শৈশব খুঁজে দেয়ার দায়িত্ব আমাদের সবার। পরিবার, বিদ্যালয়, সমাজ ও রাষ্ট্র- সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। শৈশবেই যাতে তাদের অবারিত মাঠ, আকাশ, মনোজগৎ হারিয়ে না যায়, সামান্য সচেতন, সতর্ক ও সহানুভূতিশীল হলেই তা নিশ্চিত করা সম্ভব। যে জীবন হরিণের ফড়িংয়ের দোয়েলের- পরিবর্তিত বাস্তবতায় শিশুদের সেই শৈশব হয়তো আমরা দিতে পারবো না। কিন্তু তাদের বোঝার ওপর থেকে শাকের আঁটিটি সহজেই নামিয়ে রাখা সম্ভব।