ঝিনাইদহে কোটি টাকার চুরি করা বিদ্যুত গিলে খেয়ে ধরা পড়লো সাবেক মেম্বার ও অব. ডাক্তার

ঝিনাইদহ প্রতিনিধি: ঝিনাইদহে লাখ লাখ টাকার বিদ্যুত গিলে খাচ্ছে ইজিবাইক, অটোরিকশা ও পাখিভ্যান শিরোনামের সংবাদ প্রকাশের পর জেলা জুড়ে ব্যাপক তোলপাড় শুরু হয়েছে। ইতোমধ্যে ধরা পড়েছে দুজন আলোচিত রাঘব বোয়াল। গতকাল সোমবার বিকেলে এ দুজন আলোচিত রাঘব বোয়ালের গোপন বাসা থেকে অবৈধভাবে চালানো মিটার খুলে নিয়েছে ঝিনাইদহ বিদ্যুত বিতরণ বিভাগ ওজোপাডিকো। উপরোক্ত সংবাদ প্রকাশের পরপরই ঝিনাইদহ বিদ্যুত বিতরণ বিভাগ খোঁজখবর নিতে থাকে।

গোপনসূত্রে ওজোপাডিকো কর্তৃপক্ষ জানতে পারে, ঝিনাইদহ শহরের আরাপপুরের শেখপাড়ার সাবেক মেম্বার ওবাইদুর ও অবসরপ্রাপ্ত ডাক্তার শেখ মোহাম্মদ আমিনুলের পাঁচতলা বাসায় দুটি গোপন ঘরে ইজিবাইক চার্জদেয়া হয়। খবর পেয়ে ঝিনাইদহ বিদ্যুত বিতরণ বিভাগ ওবাইদুর ও আমিনুলের গোপন বাসায় অভিযান চালিয়ে দুটি অবৈধ রিমোট কন্ট্রোল মিটার জব্দ করে। রিমোট কন্ট্রোল মিটার দিয়ে তারা টিপ প্রতি ১২০ ইজিবাইক চার্জকরা অবস্থায় রিমোর্ট টিপে মিটার বন্ধ রাখেন। যাতে করে বিদ্যুতবিল না ওঠে। এভাবে গত ২-৩ বছর যাবত তারা সরকারের কোটি কোটি টাকা ক্ষতি করেছেন বলে ওজোপাডিকো কর্তৃপক্ষ ও গ্রামবাসী জানিয়েছে।

স্থানীয়দের মধ্যে ‘রেডিও অ্যান্ড ঘড়ি’ ঘরের মালিক নাসির উদ্দিন পান্নু, বজলুর রহমান, মুদি দোকান মালিক মানিক মিয়া জানিয়েছেন, প্রধান মন্ত্রী শেখ হাসিনা বারংবার যেখানে ঘরে ঘরে বিদ্যুত পৌঁছে দেয়ার অঙ্গীকার বা ঘোষণা করছেন সেখানে কিভাবে লোডসেডিং হয়? সাবেক মেম্বার ওবাইদুর ও অবসরপ্রাপ্ত ডাক্তার আমিনুলের মতো অসাধু ব্যক্তিরা দেশ ও দশের ক্ষতি করে চলেছেন। রিমোর্ট কন্ট্রোল মিটারের মাধ্যমে বিদ্যুত চুরি করে ইজিবাইক চার্জ অবশ্যই অবৈধ ও অন্যায়। আমরা এলাকাবাসী এদের দুজনের বিচারের জোর দাবি করছি। তাছাড়া ঝিনাইদহ জেলা জুড়ে প্রচণ্ড গরমে সব সময়ই লোডসেডিং চলতেই থাকে সেখানে বিদ্যুত চুরি করলে কিভাবে জন সাধারণ বিদ্যুত পাবে?

এ ব্যাপারে জানার জন্য মেম্বার ওবাইদুর ও অবসরপ্রাপ্ত ডাক্তার শেখ মোহাম্মদ আমিনুলের বাসায় গিয়ে দেখা পাওয়া যায়নি ও মুঠোফোনে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। এ ঘটনায় ঝিনাইদহ বিদ্যুত বিতরণ বিভাগ ওজোপাডিকো’র নির্বাহী প্রকৌশলী শহিদুল ইসলাম জানিয়েছেন, মেম্বার ওবাইদুর ও ডাক্তার শেখ মোহাম্মদ আমিনুলের বিরুদ্ধে অবৈধ রিমোট কন্ট্রোল মিটার ব্যবহারের কারণে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।

উল্লেখ্য, ঝিনাইদহ জেলা শহর, মফস্বল ও গ্রামগুলোতে রিকশা ও ভ্যানগাড়ির বিকল্প হিসেবে অবাধে চলছে ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক, অটোরিকশা ও পাখি ভ্যান। অবৈধভাবে চলা এসব বাইক বিদ্যুতের একটি বড় অংশ গিলে খাচ্ছে। কারণ এগুলোর ব্যাটারি বিদ্যুতের মাধ্যমে চার্জ দেয়া হচ্ছে।

বাংলাদেশ ইজিবাইক আমদানি ও সরবরাহকারী ব্যবসায়ী সমিতির দেয়া তথ্যানুয়ী, দেশের বিভাগীয় শহর, জেলা, উপজেলা ও গ্রাম পর্যায়ে এখন প্রায় ১০ লাখ ইজিবাইক ও অটোরিকশা চলাচল করছে। আর এসব যানবাহন চার্জ দিতে দৈনিক প্রায় এক হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুত খরচ হচ্ছে। সাধারণত একটি ইজিবাইকের জন্য ৪ থেকে ৫টি ১২ ভোল্টের ব্যাটারি প্রয়োজন। প্রতি সেট ব্যাটারি চার্জের জন্য গড়ে ৮০০ থেকে  ১১০০ ওয়াট হিসেবে ৫ থেকে ৬ ইউনিট (দিনে বা রাতে কমপক্ষে ৫ থেকে ৬ ঘণ্টা) বিদ্যুত খরচ হয়। ঝিনাইদহ জেলার হিসাব অনুযায়ী প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম ৫ টাকা ধরা হলে প্রায় ২০ হাজার ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক,  রিকশা ও পাখি ভ্যানে প্রতিদিন প্রায় এক লাখ টাকার বিদ্যুত খরচ হচ্ছে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ঝিনাইদহ শহরের আরাপপুর, ঝিনাইদহের চুয়াডাঙ্গা বাসস্ট্যান্ড, হামদহ, চাকলাপাড়া, পায়রাচত্বর ও সদর হাসপাতাল এলাকায় ইজিবাইকের ব্যাপক চলাচল রয়েছে। শহরের এসব গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় ইজিবাইক এত বেশি বেড়েছে যে, সাধারণ মানুষের চলাফেরাও বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে। প্রতিনিয়ত ঘটছে দুর্ঘটনা। বিশেষ করে পায়রাচত্বর ও সদর হাসপাতাল এলাকা এখন পুরোটাই ইজিবাইকের দখলে।

ঝিনাইদহ জেলার ৬ থানা এলাকার সাধারণ জনগণের সাথে কথা বললে তারা জানান, ভাড়া অন্যান্য যানের চেয়ে তুলনামূলক কম হওয়ায় মূল শহরে এবং তার বাইরে এখন যাত্রীদের প্রধান বাহনে পরিণত হয়েছে ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক ও রিকশা। আর এগুলোর বেশিরভাগ চালকই সামান্য অর্থের বিনিময়ে অবৈধভাবে বৈদ্যুতিক লাইন থেকে ব্যাটারি চার্জ করিয়ে নিচ্ছেন।

অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে, ঝিনাইদহের জেলা-উপজেলাগুলোতে ইজিবাইক চালকরা যে গ্যারেজে গাড়িগুলো রাখছেন, সে জায়গাতেই রাতভর একটি গাড়ির শুধু চার্জের জন্য গ্যারেজ মালিককে মাত্র ১০০ থেকে ২০০ টাকা করে দিচ্ছেন।

হরিণাকুণ্ডু উপজেলাতেও অবাধে চলছে ইজিবাইক। আর এগুলোর চালকরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অবৈধ লাইন থেকে বিদ্যুত নিয়ে গাড়িগুলো চার্জ দিচ্ছেন। তাছাড়া কালীগঞ্জ, মহেশপুর, শৈলকুপা ও কোটচাঁদপুর শহরে এই যানগুলো চার্জ দেয়ার জন্য আছে আলাদা দোকান। সেখানে নিয়ম ভঙ্গ করে বিদ্যুতের অপচয় করে গাড়িগুলোতে চার্জ দেয়া হচ্ছে। এছাড়া ঝিনাইদহ শহরে এই বাইকগুলো চার্জের জন্য আলাদা করে ঘর তৈরি করা হয়েছে। সেখানে অবৈধভাবে ইজিবাইকে চার্জ দেয়া হচ্ছে। এক একটি ঘরে একসাথে ১৫-২০টি করে ইজিবাইকে একটানা ৮ ঘণ্টা করে চার্জ দেয়া হচ্ছে। এ জন্য তাদের খরচ হচ্ছে ১৫০ টাকা।

ঝিনাইদহ শহরের ইজিবাইক চালক জলিল মিয়া বলেন, প্রতিদিন ৬ ইউনিট করে মাসে তার গাড়িতে ১৮০ ইউনিট বিদ্যুত খরচ হয়।

সূত্র মতে, এসব যানগুলোর বিরুদ্ধে মাঝেমধ্যে পুলিশি অভিযান চালানো হলেও প্রশাসনকে ম্যানেজ করে এগুলো ঠিকই চলছে। সংশ্লিষ্টদের মতে, যানগুলোর প্রথম সমস্যা হলো, এগুলো রিচার্জ করতে বিপুল পরিমাণ বিদ্যুত খরচ হয়, আর দেশে যেখানে বিদ্যুতের ঘাটতি রয়েছে সেখানে এই যানগুলোতে অতিরিক্ত বিদ্যুৎ ব্যবহার বিদ্যুতের অপচয় ছাড়া কিছুই নয়।

ঝিনাইদহ ওজোপাডিকোর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. শহিদুল ইসলাম এ প্রতিবেদককে বলেন, যদিও ঝিনাইদহ শহরের ইজিবাইক, অটোরিকশা ও পাখিভ্যান একটি জনপ্রিয় যানবাহনে পরিণত হয়েছে। কিন্তু এ জন্য বিদ্যুতের কাঙ্ক্ষিত উৎপাদন ব্যবস্থা যাতে বাধাগ্রস্ত না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। অফ পিক আওয়ারে এই যানগুলো চার্জ করা এবং সোলার চার্জিং সিস্টেমে এর রিচার্জের ব্যবস্থা করা যায় কি-না সেটি ভাবতে হবে।

উল্লেখ্য, ২০১৫ সালে সরকার দেশের ২২ সড়কে এসব যান চলাচল বন্ধ করার নির্দেশ দেয়। এরপর সড়ক-মহাসড়কে বিশৃঙ্খলা ও দুর্ঘটনার জন্য দায়ী হওয়ায় উচ্চ আদালত থেকেও এসব যান চলাচলের ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। তবে একসঙ্গে বহু মানুষের জীবিকা অর্জনের উৎস হওয়ায় সরকারিভাবে বৈধ উপায়ে এই বাহনগুলো চার্জ দেয়ার ব্যাবস্থা নেয়া হয়। বিদ্যুত অপচয় কমাতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে কেরানীগঞ্জের রহিতপুরে পল্লি বিদ্যুতায়ন বোর্ড এই যানগুলোর জন্য দেশের প্রথম চার্জিং স্টেশন নির্মাণ করে।