দর্শনার ক্লিনিকগুলো চিকিৎসার নামে হাতিয়ে নিচ্ছে কাড়ি কাড়ি টাকা

 

অনিময়ই যেখানে নিয়মে রূপ নিয়েছে সেখানে অহরহ প্রতারিত হচ্ছে রোগী সাধারণ

স্টাফ রিপোটার: দর্শনার ক্লিনিকগুলোতে অনিয়ম লেগেই রয়েছে? প্রতিকার মিলছে না কেন? এ প্রশ্নের জবাব মিলছে না কোনভাবে। স্থানীয় অনেকেরই অভিমত যে যার খুঁটির জোরে অনিয়মগুলোকেই নিয়মের পরিণত করছে, ফলে খেয়ালখুশি মতোই পরিচালিত হচ্ছে ক্লিনিকগুলো।

অভিযোগকারীরা বলেছেন, চিকিৎসক না হয়েও যেমন দিচ্ছে চিকিৎসা, তেমনিভাবে নার্সের পরিবর্তে আয়াদের দিয়ে চলছে যেনতেনভাবে সেবা। ঘটছে অহরহ দুর্ঘটনা। জীবন দিতে হয়েছে অনেককেই। অপচিকিৎসার কূফলে যন্ত্রণাদায়ক জীবন যাপন করছে অনেকেই। প্রতিবাদ করলেও নেই কোনো প্রতিকার। পোষা দালালদের হুংকারে রাতারাতি হচ্ছে আপস রফা। কর্তা বাবুদের সঠিক তদারকি থাকলে বেপরোয়া হয়ে উঠতে পারতো না ক্লিনিক নামের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিকরা। সাধারণ মানুষ রেহাই পেতো অপচিকিৎসার হাত থেকে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চলতি বছরে দর্শনার অধিকাংশ ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের রেজিস্ট্রেশন নবায়ন করা হয়নি। তার পরও অদৃশ্য শক্তির বলে ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার মালিকরা অবাধে তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন। মেডিকেল প্রাকটিস অ্যান্ড প্রাইভেট ক্লিনিক অ্যান্ড ল্যাবরেটরিজ রেগুলেশন অর্ডিনেন্স ১৯৮২ তে বলা হয়েছে, ১০ শয্যা বিশিষ্ট ক্লিনিক প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় ও নির্ধারিত স্থান সংবলিত নির্দিষ্ট কক্ষ, অত্যাধুনিক অপারেশন থিয়েটার, ৩ জন বিশেষজ্ঞ ও আবাসিক চিকিৎসক, ১ জন সার্জন ও ৩ জন স্টাফ নার্স থাকতে হবে। এ শর্ত পূরণ সাপেক্ষে বেসরকারি পর্যায়ে ক্লিনিক অ্যান্ড নার্সিং হোম ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোকে রেজিস্ট্রেশন দেয়া হয়ে থাকে। কিন্তু দর্শনায় এ নিয়মের বাইরেই চলছে সবকিছু। অনিয়মের বিরুদ্ধে সংস্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কোনো নজরদারী দেখা যায় না। যে কারণে অনিয়মই দর্শনার ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মালিকদের তৈরি নিয়মে পরিণত হয়েছে। দর্শনা পৌর শহরে রয়েছে ৪ ক্লিনিক ও অসংখ্যা ডায়াগনস্টিক সেন্টার রয়েছে। চকচকে সাইনবোর্ড ক্লিনিকগুলোর ভরসা হলেও নেই প্রয়োজনীয় জরুরি চিকিৎসা ব্যবস্থা। ক্লিনিক অ্যান্ড নার্সিং হোমগুলোতে নেই প্রয়োজনীয় সংখ্যক চিকিৎসক ও সেবিকা। এছাড়া যথোপযুক্ত অপারেশন থিয়েটার ও কারো কারো ক্ষেত্রে নিজস্ব বিদ্যুত ব্যবস্থা নেই। ফলে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীরা প্রতিনিয়ত নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। প্রতারিত হচ্ছে অহরহ। আনাড়ি চিকিৎসকের মাধ্যমে চিকিৎসা নেয়া রোগীরা ভুল চিকিৎসার শিকার হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছে।

জনশ্রুতি রয়েছে, কোনো কোনো ক্লিনিকে নার্স ও আয়া নামধারী কিছু যুবতীকে দিয়ে গভীর রাতে অসামাজিক কার্যকলাপের ঘটনাও নতুন কিছু নয়। হতদরিদ্র ও দুস্থ পরিবারের স্বামী পরিত্যক্তা মেয়েদের অল্প বেতনে রেখে সেবিকার কাজ চালিয়ে নেয়া হচ্ছে কোনো কোনো ক্লিনিকে। দর্শনা মা ও শিশু হাসপাতাল এবং মুক্তি ক্লিনিকে অসহায় আয়া ও নন ডিপ্লোমা যুবতী নার্সদের সাথে অশ্লীল আচরণ ও কুপ্রস্তাবের অভিযোগ রয়েছে ক্লিনিক কর্তৃপক্ষের অন্যতম অংশীদার এনামুল হকের বিরুদ্ধে। এনামুলের কুনজরের কারণে বেশ কয়েকজন আয়া ক্লিনিক ছেড়েছে বলে শোনা গেছে। অসহায় রোগীদের ক্ষেত্রেও অসামাজিক কাজের প্রস্তাবের ঘটনায় বেশ কয়েকবার লাঞ্ছিত হয়েছেন এনামুল। লোক লজ্জার ভয়ে কেউ কেউ মুখ না খুললেও খতিয়ে দেখলে মিলবে প্রমাণ।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন চিকিৎসক জানান, কোনো কোনো ক্লিনিকে নিজস্ব কোনো সার্জন বা চিকিৎসক ও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃত কোনো নার্স না থাকায় চুক্তিভিত্তিক চিকিৎসক ও নার্সদের দিয়েই এসব ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার চালানো হচ্ছে।

জানা গেছে, দর্শনা মডার্ন, শাপলা এবং মা ও শিশু জেনারেল হাসপাতাল ১০ শয্যার অনুমোদিত। শুধু মুক্তি ক্লিনিক ২০ শয্যার অনুমোদনপ্রাপ্ত। অনুমোদনের তোয়াক্তা না করেই একেক ক্লিনিকে রয়েছে অসংখ্য বেড। কোনো কোনো ক্লিনিকে বেড ছাড়া মেঝেতেও রোগী রেখে চিকিৎসা করা হচ্ছে।

অভিযোগ উঠেছে, মুক্তি ক্লিনিকে ২০ বেডের স্থলে বেডের সংখ্যা কমপক্ষে ৪০। তবে পুরুষ ও নারীদের দুটি ওয়ার্ড ছাড়াও কেবিনের ব্যবস্থা রয়েছে। কেবিনের ক্ষেত্রে রোগীদের গুনতে হয় দ্বিগুণ টাকা। ৫ তল বিশিষ্ট মডার্ন ক্লিনিকে প্রত্যেক তলায় রয়েছে ৬টি করে বেড। ১০ শয্যার অনুমোদনের স্থলে শাপলা ক্লিনিকের বেডের সংখ্যা অগণতি। মা ও শিশু জেনারেল হাসপাতালটিতে পুরুষ ও নারীদের জন্য দুটি ওয়ার্ড ছাড়াও কয়েকটি কেবিনের ব্যবস্থা রয়েছে। ফলে বেডের সংখ্যা কমপক্ষে ২৫। মডার্ন ক্লিনিকে জেলার স্বনামধন্য গাইনি চিকিৎসক হোসনা জারী তাহ্‌মীনা আখি অস্ত্রোপচারের কার্যক্রম করে থাকেন। অজ্ঞানকরণ চিকিৎসক ডা. তারিকুল আলম সার্বক্ষণিক দায়িত্ব পালন করেন। ফলে মডার্ন ক্লিনিক ২৪ ঘণ্টায় মাত্র দুজন চিকিৎসক একজন ডিপ্লোমা নার্স ও একজন ডিপ্লোমা প্যাথলজিস্টসহ বেশ কয়েকজন আয়া দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে। শাপলা ক্লিনিকে নেই নিজস্ব কোনো চিকিৎসক। ভাড়া করা চিকিৎসক দ্বারা অস্ত্রোপচারের কার্যক্রম করা হয়ে থাকে। ২৪ ঘণ্টায় মাত্র একজন ডিপ্লোমা নার্স ও বেশ কয়েকজন আয়াসহ একজন ডিপ্লোমা প্যাথলজিস্ট রয়েছে। মা ও শিশু হাসপাতালে নিজস্ব চিকিৎসক না থাকলেও নিয়মিত বিকেলে চিকিৎসা সেবা দিয়ে থাকেন একজন চিকিৎসক। নেই কোনো ডিপ্লোমা নার্স ও প্যাথলজিস্ট। মুক্তি ক্লিনিকে সকাল বিকেল দুজন চিকিৎসক চিকিৎসা সেবা দিয়ে থাকেন। ছোটখাটো অস্ত্রোপচারের ক্ষেত্রে রয়েছেন নিজস্ব একজন চিকিৎসক। প্রতি শুক্রবারসহ জরুরি ক্ষেত্রে চুক্তিভিত্তিক চিকিৎসক দিয়েই অস্ত্রোপচার করা হয়ে থাকে। একজন ডিপ্লোমা নার্স, একজন ডিপ্লোমা প্যাথলজিস্ট ও বেশ কয়েকজন আয়া এ ক্লিনিকের ২৪ ঘণ্টা কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। দর্শনার ৪ ক্লিনিকের মধ্যে মডার্ন ক্লিনিক ছাড়া কোনো ক্লিনিকেই নিজস্ব সার্জন ও জরুরি চিকিৎসা ব্যবস্থা নেই। এছাড়া বর্তমান চিকিৎসা ব্যবস্থায় চিকিৎসকের কাছে রোগী গেলেই প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে নানাবিধ পরীক্ষা-নিরীক্ষার গোলক ধাধায় সর্বশান্ত হচ্ছে রোগী সাধারণ। প্রতিটি ক্লিনিকেই নিজস্ব ডায়াগনস্টিক সেন্টার রয়েছে, অথচ কোনো কোনো ডায়াগনস্টিক সেন্টারে নেই প্যাথলজিস্ট বা আল্ট্রাসনোলজিস্ট। টেকনেসিয়ানরাই এসব পরীক্ষা করে রোগীর হাতে রিপোর্ট ধরিয়ে দিচ্ছে। একজন রোগীকে একই সময়ে পৃথক দুটি ডায়গনস্টিক সেন্টারে পরীক্ষা করালে দু রকম ফল পাওয়া যায় বলেও জনশ্রুতি রয়েছে। দর্শনা তথা আশপাশ এলাকার মানুষের সুচিকিৎসা সেবার ব্যবস্থা করণে চুয়াডাঙ্গা সিভিল সার্জনের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে ভুক্তভোগী ও সচেতন মহল।