মুফতি হান্নানসহ তিন জঙ্গির ফাঁসি কার্যকর

 

বিপুল পাটোয়ারির লাশ গ্রহণ করবেন না তার বাবা

স্টাফ রিপোর্টার: নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদের শীর্ষ নেতা মুফতি আব্দুল হান্নান মুন্সি ওরফে মুফতি হান্নান এবং তার দুই সহযোগী শরীফ শাহেদুল আলম বিপুল পাটোয়ারী ও দেলোয়ার হোসেন রিপনের ফাঁসি গতকাল বুধবার রাত দশটায় কার্যকর করা হয়েছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল এ তথ্য নিশ্চিত করেন। ২০০৪ সালের ২১ মে সিলেটে তত্কালীন ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরীর ওপর গ্রেনেড হামলার ঘটনায় করা মামলার রায় অনুযায়ী এই মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।

গাজীপুরের কাশিমপুর হাইসিকিউরিটি কেন্দ্রীয় কারাগারে মুফতি হান্নান ও বিপুল পাটোয়ারী এবং সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগারে দেলোয়ারের ফাঁসি কার্যকর করা হয়। রাতেই ময়নাতদন্ত শেষে কড়া পুলিশ প্রহরায় মুফতি হান্নানের লাশ গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় তার গ্রামের বাড়ি পাঠানো হয়। দেলোয়ারের লাশ পাঠানো হয় মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার কোনাগাঁও গ্রামে।

অন্যদিকে বিপুল পাটোয়ারীর লাশ গ্রহন করবেন না বলে জানিয়েছেন তার বাবা চাঁদপুর সদর উপজেলার মৌশদি গ্রামের বাসিন্দা মিন্টু পাটোয়ারী। এমনকি ফাঁসি কার্যকরের আগে কারাগারে কোন স্বজন তার সঙ্গে দেখাও করেননি। কারা সূত্র জানিয়েছে, বিপুলের লাশ আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামে হস্তান্তর করা হবে।

এ দিকে গতকাল সকালে কাশিমপুর কারাগারে মুফতি হান্নানের সঙ্গে দেখা করেছেন তার বড় ভাই আলিমুজ্জামান মুন্সি, হান্নানের স্ত্রী জাকিয়া পারভিন রুমা, বড় মেয়ে নিশি খানম ও ছোট মেয়ে নাজরিন খানম। আর দুপুরে দেখা করেন একই  মামলায় যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত হান্নানের ছোট দুই ভাই মহিবুল্লাহ ওরফে মফিজুর রহমান ওরফে মফিজ ওরফে অভি ও অপর এক মামলায় সাজাপ্রাপ্ত আনিস। এদের মধ্যে মহিবুল্লাহ আটক রয়েছেন নারায়ণগঞ্জ জেলা কারাগারে ও আনিস রয়েছেন কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার পার্ট-২-এ।

এছাড়া গতকাল সন্ধ্যায় সিলেট কারাগারে দেলোয়ারের সঙ্গে দেখা করেন তার  বাবা আবু  ইউসুফ, মা আজিজুন্নেছা, ভাই নাজমুল ইসলাম, চাচা আব্দুন নুর, চাচি আজিজুন্নেছাসহ ২০ জন।

নিরাপত্তা: তিন জঙ্গির মৃত্যুদণ্ড কার্যকর উপলক্ষে মঙ্গলবার বিকাল থেকেই কাশিমপুর কারাকমপ্লেক্স ও সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগারের আশপাশে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়। গতকাল দুপুরের পর থেকে কাশিমপুর কারাকমপ্লেক্সের সামনের প্রধান সড়কে সব ধরনের যান চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয়। মোতায়েন করা হয় অতিরিক্ত পুলিশ, র‌্যাব। সাধারণ মানুষের চলাফেরা সীমিত করতে আশপাশের সড়কগুলোতে অস্থায়ী নিরাপত্তা চৌকি স্থাপন করা হয়। সকাল থেকেই কাশিমপুর কারাকমপ্লেক্সের মূল ফটকের বাইরে গণমাধ্যম কর্মীরা অবস্থান নেয়।

যেভাবে ফাঁসির মঞ্চে মুফতি হান্নান ও বিপুল: সাজা ঘোষণার পর থেকে মুফতি হান্নান ও বিপুল ছিলেন হাইসিকিউরিটি কারাগারের কনডেম সেল হিমেল ভবনের নীচ তলায় কাছাকাছি দুই কক্ষে। এই ভবন থেকে ২০-২৫ গজ দূরে খোলা স্থানে ফাঁসির মঞ্চে নিয়ে একই সঙ্গে তাদের দুজনের ফাঁসি কার্যকর করা হয়। মুফতি হান্নান ও বিপুলের ফাঁসি কার্যকরে নেতৃত্ব দেন জল্লাদ রাজু। তার সহযোগী ছিলেন যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত বন্দী রোমান ও সাকু মিয়া। তওবা পড়ান কাশিমপুর কারা কমপ্লেক্সের ইমাম মাওলানা হেলাল উদ্দিন। এর আগে দুপুরে  ও সন্ধ্যায় স্বাস্থ্য পরীক্ষা করেন কারা চিকিত্সক মিজানুর রহমান।

২০ মিনিট ধরে ফাঁসির দড়িতে ঝুলে থাকার পর মুফতি হান্নান ও বিপুলের দেহ নীচে নামিয়ে আনা হয়। গাজীপুর জেলা সিভিল সার্জনের উপস্থিতিতে একটি টিম তাদের মৃত্যু নিশ্চিত করেন। এরপর তাদের পায়ের রগ কেটে দেয়া হয়। পরে ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী মরদেহ গোসল করিয়ে কাফনের কাপড় দিয়ে মুড়িয়ে কফিনে ভরে অ্যাম্বুলেন্সে মুফতি হান্নানের লাশ কড়া পুলিশ পাহাড়ায় গ্রামের বাড়ি গোপালগঞ্জে পাঠানো হয়।

দেলোয়ারের ফাঁসি কার্যকর যেভাবে: অপরদিকে সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগারে ‘দশ সেলে’ ছিলেন দেলোয়ার হোসেন রিপন। সেখানে তার ফাঁসি কার্যকর করেন জল্লাদ ফারুক। তাকে সহায়তা করেন আরো দুজন।

কারা সূত্র জানিয়েছে, রিপনও স্বাভাবিকভাবে খাবার খেয়েছেন। রিপনের দেহ ২০ মিনিট ঝুলিয়ে রাখার পর মঞ্চ থেকে নামিয়ে আনা হয়। সিলেট জেলা সিভিল সার্জনের উপস্থিতে একটি টিম তার মৃত্যু নিশ্চিত করেন। রিপনের লাশও একইভাবে অ্যাম্বুলেন্সে করে মৌলভীবাজারের কুলাউড়ায় কোনাগাঁও গ্রামে পাঠানো হয়।

বিপুলের লাশ গ্রহণ কববেন না তার বাবা: বিপুল পাটোয়ারীর বাড়ি চাঁদপুর সদর উপজেলার মৌশাদি গ্রামে। তার বাবা হেমায়েত উল্লা ওরফে মন্টু পাটোয়ারী। দুই ভাই দুই বোনের মধ্যে বিপুল তৃতীয়। বিপুলের শ্বশুরবাড়ি সিলেটে। গ্রেফতার হওয়ার পর তার স্ত্রী তাকে ছেড়ে চলে গেছে।

মন্টু পাটোয়ারী জানিয়েছেন, জঙ্গি কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ার কারণে তিনি তার ছেলের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেননি। চাঁদপুর থানা পুলিশ বিপুলের সঙ্গে কারাগারে দেখা করার চিঠি নিয়ে তার কাছে গিয়েছিল। তিনি পুলিশকে লিখিতভাবে জানিয়েছেন, বিপুলের সঙ্গে তিনি দেখা করবেন না। এমনকি তার লাশও গ্রহণ করবেন না।

কোটালীপাড়ায় হান্নানের লাশ দাফনের প্রস্তুতি: কোটালীপাড়া (গোপালগঞ্জ) সংবাদদাতা গৌরাঙ্গ লাল দাস জানিয়েছেন, মুফতি হান্নানের লাশ তার গ্রামের বাড়ি গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়া উপজেলার হিরন গ্রামের হিরন বালিকা মাদ্রাসা ও এতিমখানা সংলগ্ন পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। কবর খোড়ার কাজও শেষ হয়েছে।

পেছনের কথা: ২০০৪ সালের ২১ মে সিলেটের হযরত শাহজালালের (র.) মাজারে তত্কালীন ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরীর ওপর গ্রেনেড হামলা চালানো হয়। হামলায় আনোয়ার চৌধুরী, সিলেটের জেলা প্রশাসকসহ অর্ধশতাধিক ব্যক্তি আহত এবং দুই পুলিশ কর্মকর্তাসহ তিনজন নিহত হন। ২০০৮ সালের ২৩ ডিসেম্বর সিলেটের দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল এ মামলার ৫ আসামির মধ্যে মুফতি হান্নান, বিপুল ও রিপনকে মৃত্যুদণ্ড এবং হান্নানের ছোট ভাই মহিবুল্লাহ ও হান্নানের সহযোগী আবু জান্দালকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন। ২০০৯ সালে আসামিরা জেল আপিল করেন। বিচারিক আদালতের রায় বহাল রেখে গত বছরের ১১ ফেব্রুয়ারি রায় ঘোষণা করে হাইকোর্ট। এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেন মুফতি হান্নান ও বিপুল। গত বছরের ৭ ডিসেম্বর আসামিদের আপিল খারিজ করে চূড়ান্ত রায় ঘোষণা করে আপিল বিভাগ। আসামিরা এ রায় রিভিউয়ের আবেদন জানালে গত ১৯ মার্চ তা খারিজ করে দেয় সর্বোচ্চ আদালত।

গত ২১ মার্চ রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশিত হয়। পরের দিন তিন জঙ্গির মৃত্যু পরোয়ানায় স্বাক্ষর করে কারাগারে পাঠায় বিচারিক আদালত। ওই দিনই তাদের মৃত্যু পরোয়ানা পড়ে শোনানো হয়। গত ২৭ মার্চ পৃথকভাবে মুফতি’ হান্নান, বিপুল ও রিপন স্ব স্ব কারা কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার আবেদন জানান। গত ৮ এপ্রিল রাষ্ট্রপতি প্রাণভিক্ষার আবেদন নাকচ করেন।