নয়াদিল্লিতে প্রধানমন্ত্রী : দিদি ‘না’ বললেও মোদীর ঘোষণায় আস্থা আছে
মাথাভাঙ্গা মনিটর: তিস্তা চুক্তির ব্যাপারে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির অনাগ্রহ থাকলেও এ ব্যাপারে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ওপর ভরসা রাখার কথা জানিয়েছেন শেখ হাসিনা। তিনি বলেছেন, ‘তিস্তার পানিবণ্টনে নরেন্দ্র মোদির ঘোষণায় আমরা আস্থা রাখছি, যদিও দিদি (মমতা ব্যানার্জি) না বলেছেন। এটা আমাদের ন্যায্য পাওনা। আমরা বিশ্বাস করি সমমর্যাদা এবং বন্ধুত্ব দিয়ে অনেক কিছু অর্জন করা সম্ভব। ঝগড়া করে সমস্যার সমাধান হয় না। বন্ধুত্ব দিয়েই দাবি আদায় হয়।’
৪ দিনের সফরের শেষদিন গতকাল সোমবার সকালে নয়াদিল্লির ইমপেরিয়াল হোটেলে ইন্ডিয়া ফাউন্ডেশনের দেয়া এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে তিনি একথা বলেন। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) উপদেষ্টা পরিষদের চেয়ারম্যান এল কে আদভানি, বাণিজ্য ও শিল্পমন্ত্রী ড. নির্মলা সিতারমণ, কেন্দ্রীয় সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রঞ্জিত সিং সহ নয়াদিল্লির বুদ্ধিজীবী মহল।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ককে সম্মান করি। বন্ধুত্বকে গুরুত্ব দেই। ছোট দেশ বড় দেশ বলে কোনো কথা নেই। স্বাধীন দুটি দেশ আমাদের। এক সঙ্গেই কাজ করবো। শুধু এই দুই দেশ নয়, দক্ষিণ এশিয়ার মানুষদের আমরা উন্নত জীবন দিতে পারবো। দক্ষিণ এশিয়ার একমাত্র শত্রু দারিদ্র্য। এই শত্রুর বিরুদ্ধে একসথে লড়তে হবে।
তিনি বলেন, ভারতের লোকসভায় সর্বসম্মতভাবে ল্যান্ড বাউন্ডারি চুক্তি পাস হয়েছে। এটা একাত্তরের বন্ধুত্বের ধারা বজায় রেখেছে। ভারতের গণতন্ত্রের প্রশংসা করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ভারতের মানুষ ভাগ্যবান। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া এখানে অব্যাহত আছে। কিন্তু বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখতে আমাদের লড়াই করতে হচ্ছে। বাংলাদেশে বারবার সামরিক শাসন গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করেছে। আমরা বিশ্বাস করি গণতন্ত্রই দিতে পারে সুশাসন, দারিদ্র্যমুক্ত সম্মানজনক একটি জাতি।
পাক-ভারত সম্পর্ক উন্নয়নে পাশে চান আদভানি: এই অনুষ্ঠানে দেয়া বক্তব্যে ভারতের সাবেক উপ-প্রধানমন্ত্রী বর্ষীয়ান বিজেপি নেতা এলকে আদভানি বলেন, ‘ভারতের সাথে পাকিস্তানের সম্পর্ক উন্নয়নে শেখ হাসিনা সহায়তা করতে পারেন। এই অঞ্চলের সকলের মধ্যে যেন বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক হয়।’ অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের ভূয়সী প্রশংসা করেন আদভানি। তিনি বলেন, শেখ হাসিনার নেতৃত্ব বাংলাদেশকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে। তার নেতৃত্বেই বাংলাদেশের জনগণের জীবনমানের আরও উন্নয়ন ঘটবে বলে আশা প্রকাশ করেন এই প্রবীণ নেতা।
যারা দেশ বেচে দেয়ার কথা বলে তারা অর্বাচীন: এদিকে শেখ হাসিনা বলেছেন, দেশ বেচে দেয়ার কথা যারা বলেছেন তারা অর্বাচীন মন্তব্য করেছেন। গতকাল নয়াদিল্লির হোটের তাজ প্যালেসে ফেডারেশন অব ইন্ডিয়ান চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের উদ্যোগে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে তিনি এ মন্তব্য করেন। অনুষ্ঠানে ভারত-বাংলাদেশের শীর্ষ ব্যবসায়ীরা উপস্থিত ছিলেন। ব্যবসায়ীদের উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘দেশ কতটুকু বেচলাম, না অর্জন করলাম সেটা আপনারা দেখলেন। আমরা ভারতের সাথে অনেক চুক্তি করেছি। বর্ডার হাট করেছি, গঙ্গার পানিচুক্তি করেছি, সিটমহল খুলে দিয়েছি। ’
ভারতীয় ব্যবসায়ীদের বাংলাদেশে বিনিয়োগের সুযোগ নেয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, আসুন বিনিয়োগের সুযোগ নিন। সরকার সব ধরনের সহায়তা দেবে। ভারতের ব্যবসায়ীরা বাংলাদেশের অবিচলিত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পাশাপাশি উচ্চ জনতাত্ত্বিক লভ্যাংশ, সস্তা ব্যবসায়িক খরচ ও বিশাল ভোক্তা জনগোষ্ঠীর পূর্ণ সুবিধা কাজে লাগাতে পারেন। তবে আপনাদের বিনিয়োগকে রক্ষা করার ক্ষেত্রে একটি দীর্ঘমেয়াদি ইন্দো-বাংলা বিনিয়োগ চুক্তি হওয়া দরকার। এছাড়া আমরা আপনাদের বিনিয়োগকৃত মূলধনের লভ্যাংশ একশত শতাংশ পর্যন্ত ফিরিয়ে দেয়ার আকর্ষণীয় প্যাকেজ ঘোষণা করছি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের ‘সোনার বাংলা’ গড়ে তুলতে আমরা অর্থনীতিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে এর অগ্রগতি সাধনে সর্বাত্মক কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের লক্ষ্য ২০৪১ সালের মধ্যেই উন্নত দেশে রূপান্তরিত হওয়া। তিনি বলেন, গত আট বছরে বাংলাদেশের জিডিপি ৬ থেকে ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে এবং ২০২০ সালের মধ্যেই তা ৮ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্যে আমরা বদ্ধপরিকর। আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বর্তমানে প্রায় ৩২ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। ২০২১ সালের মধ্যে আইসিটি রফতানি খাতে ৫ বিলিয়ন ডলার আয়ের পরিকল্পনা রয়েছে আমাদের। তাছাড়া মাথাপিছু আয় ১ হাজার ৬৬৬ ডলারে নিয়ে যাওয়ারও চিন্তা করছি আমরা।
শেখ হাসিনা আরও বলেন, বর্তমানে বাংলাদেশ ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জাপান, অস্ট্রেলিয়া, কানাডাসহ বিশ্বের ৩৮টি দেশ থেকে জিএসপি সুবিধা পাচ্ছে। এছাড়া চীন, দক্ষিণ কোরিয়া, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া ও চিলির মতো আপনারাও আমাদের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি শুল্ক ও কোটামুক্ত সুবিধা বিস্তার করতে পারেন। শিল্পায়ন অনুমোদন ও বিদেশি বিনিয়োগকে আকৃষ্ট করতে বাংলাদেশ ১০০টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলার ঘোষণা করেছে। এর মধ্যে মংলা, ভেড়ামারা এবং মিরেরসরাই এই তিনটি অঞ্চল শুধু ভারতীয় বিনিয়োগকারীদের প্রাধান্য দেয়া হবে।
জ্বালানি নিরাপত্তা ব্যবসায়ের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান উল্লেখ করে শেখ হাসিনা আরও বলেন, আমাদের বিদ্যুত উত্পাদন ১৫ হাজার ৭২৬ মেগাওয়াটে পৌঁছেছে এবং ২০৪১ সালের মধ্যেই তা ৫৭ হাজার মেগাওয়াটে উন্নীতের মহাপরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। আমাদের পরিকাঠামোগত উন্নয়ন বেড়ে ৬৩২ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে এবং উচ্চ জনতাত্ত্বিক লভ্যাংশ ও কম শ্রমিক খরচের পূর্ণ সুবিধা নিতে আমাদের এখানে ২০৩০ সালের মধ্যে বার্ষিক ২০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের ব্যবস্থা করতে হবে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা পদ্মা বহুমুখী সেতু এবং রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্রের মতো বৃহত অবকাঠামোর উন্নয়নে হাত দিয়েছি, যা আমাদের দেশের ভবিষ্যত পাল্টে দেবে। আমি বাংলাদেশের অবকাঠামো, বিদ্যুত ও জ্বালানি, উত্পাদন এবং পরিবহন খাতে ভারতীয়দের বিনিয়োগের আহ্বান জানাচ্ছি। আইএমএফের রিপোর্টেই প্রকাশ পেয়েছে যে, বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে একটি স্থিতিশীল দেশ। আমি বাংলাদেশের ব্যবসায়ে আপনাদের সহযোগিতা একান্তভাবে কামনা করছি।