সব দোষ যেমন নন্দো ঘোষের ওপর চাপানোর মতো কবিরাজের ওপর চাপানো অনুচিত, তেমনই চিকিৎসার নামে অপচিকিৎসার বিষয়টি দেখেও দায়িত্বশীলদের না দেখার ভান উচিত নয়। উদাসীনতা অবশ্যই সুন্দর সমাজ গঠনে অন্তরায়। চুয়াডাঙ্গা আলমডাঙ্গার খাসকররার একজন নারীর নাম জোসনা। তিনি তো ইচ্ছে করে অসুস্থ হননি, মাথার চুল পড়ে অন্যদের চেয়ে অন্যরকম হয়ে যাক, তাও চাননি। অসুস্থতা তাকে ওই অবস্থায় নিয়েছে। আর তাতেই স্বামীসহ স্বামীর নিকটজনেরা তাকে অন্যরকম দৃষ্টিতে দেখে দিনের পর দিন নির্যাতন করেছে, চিকিৎসার নামে অপচিকিৎসার মাধ্যমে নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছে। ঘটনাটি কোনোভাবেই খাটো করে দেখার সুযোগ নেই।
হোমিওপ্যাথি চিকিৎসকের চেম্বার পাওয়ার বদৌলতে নাতিও যে সমাজে চিকিৎসক সেজে প্রকাশ্যে অপচিকিৎসা দেয়ার সুযোগ পান, সেই সমাজে পল্লি চিকিৎসকেরা পল্লিতে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়াটা আর দোষের কি? কবিরাজি? সঙসেজে বাঁকা লাঠি নিয়ে ঘুরলেই কবিরাজি খেতাব যেমন মেলে, তেমনই হেকিমি চিকিৎসার গুণগতমান যাচাইয়ের বাধ্যবাধকতা না থাকার কারণে তাতে যাচ্ছে তাই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। শুধু কি তাই? হেকিমি চিকিৎসার দাওয়ায় দিব্যি গোয়ালের কান্টায় তৈরি হলেও দেখার কেউ আছে বলে টের পাওয়া যায় না। অবশ্য চুয়াডাঙ্গা জেলায় ডা. রওশন আরা সিভিল সার্জন হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণের পর তিনি সদর হাসপাতালের চিত্রটা বদলানোর বিশেষ উদ্যোগ নিয়ে বেশ সফল হয়েছেন। তিনি একা আর কতোটাই বা করবেন? এরপরও যার কাছে পাওয়া যায়, তার প্রতিই তো প্রত্যাশা বাড়ে। সে হিসেবে বর্তমান সিভিল সার্জনের নিকট গ্রামবাংলার অপচিকিৎসা রোধে বাস্তবমুখি পদক্ষেপ প্রত্যাশা নিশ্চয় অমূলক নয়।
দেশে নারী নির্যাতনের না জানি কতো রকমেরই ধরন রয়েছে। একজন নারী কতোটা অসহায় হতে পারে, কতোটা নির্যাতনের শিকার হয়ে আলমডাঙ্গার খাসকররার জোসনার ওপর নির্যাতন এবং তার মৃত্যুর চিত্র পর্যালোচনা করলে সহজেই অনুমান করা যায়। অথচ দেশে নারী নির্যাতন রোধে কঠোর বিধি বিদ্যমান। পুরুষ শাসিত সমাজে এক সময় পুরুষদেরই কেউ কেউ নতুন বউ পাওয়ার আশায় বলতো, ‘অভাগার মরে গরু আর ভাগ্যমানের মরে বউ’। উক্তিটি কতোটা নির্মম তা বিবেকবানদের কাছে বিবেকের মাপকাঠিতে নিশ্চয় ধরা পড়বে। বিবেকহীনদের বেলায় ওই প্রসঙ্গটাই তো হাস্যকর। সঙ্গত কারণেই বিবেকহীনদের বিবেক জাগিয়ে তোলার তাগিদ উপলব্ধি হয়। একজন কবিরাজ সেজে বা কবিরাজ হয়ে কোনো রোগীকে কি নির্যাতন করতে পারে? সভ্য সমাজে জিনের আছরের কথা বলে নির্যাতন হয় প্রকাশ্যে। একজন গৃহবধূ রোগাক্রান্ত হয়ে চুল হারালেন, এরপর তিনি তার স্বামী সংসারের কাছে হলেন অপছন্দের পাত্রী। তারপর কতোটা তাড়াতাড়ি মারা যায় সে জন্য কথিত কবিরাজ ডেকে করলেন নির্যাতন। দাওয়ার নামে এমন কিছু দিলেন যা খাওয়ার পর চব্বিশ প্রহরও পার হলো না, মরতে হলে অকালে।
অবশ্যই গ্রামবাংলা থেকে অপচিকিৎসা দূর করতে হবে। এজন্য যেমন দরকার স্বাস্থ্য বিভাগের দায়িত্বশীলতা, তেমনই দরকার আইন প্রয়োগে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাসমূহে নিয়োজিতদের সচেতন কর্তব্যপরায়ণতা। এ সমাজ আমাদের। সমাজ সুন্দর করতে না পারলে ভবিষ্যতের কাঠগড়ায় বর্তমানকে শুধু খাটোই হতে হবে না, ইতিহাসের পাতায় বর্তমানের দায়িত্বশীলদের অবস্থান নিশ্চয় উজ্জ্বল থাকবে না। ফলে যে যেখানে রয়েছেন, যার যা দায়িত্ব, তা যথাযথভাবে পালন করলেই সমাজাটাই যে বদলে যায় তা বলাই বাহুল্য। দায়িত্বশীলদের বিষয়টি অজানা না হলেও কেন যে আমরা পারি না, পারছি না তাও খতিয়ে দেখা দরকার সমাজের স্বার্থে।
পুনশ্চ: সুন্দর সমাজ গঠনে পথ প্রদর্শকের অভাব ঘুচবে কবে?