চিকিত্সা বিজ্ঞানের উন্নতি এবং এর কার্যকর প্রয়োগের মাধ্যমে অনেক মারাত্মক ব্যাধি সমাজ থেকে দূর হয়েছে। কলেরা-বসন্ত এখন আর মহামারী রূপে দেখা যায় না। একসময় বলা হতো, যক্ষ্মা হলে রক্ষা নাই। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদী সুষ্ঠু চিকিত্সা গ্রহণ করা হলে, আক্রান্ত ব্যক্তি যক্ষ্মার আক্রমণ থেকে রক্ষা পাবে। অতএব, যক্ষ্মা হলে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। রোগীকে পরিবার-পরিজন থেকে আলাদা করারও প্রয়োজন পড়ে না। বিশেষ কোনো খাবারের দরকার নেই। কেবল নিয়মিত, পরিমিত এবং পূর্ণমাত্রায় ও পূর্ণমেয়াদে ওষুধ সেবন করলেই যক্ষ্মা সম্পূর্ণরূপে ভালো হয়ে যায়। সরকারি ও বেসরকারি সংস্থাসমূহ সরাসরি পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে এই রোগের চিকিত্সা করছে।
ম্যালেরিয়া কিংবা পোলিও যেমন দেশ থেকে প্রায় পুরোপুরি নির্মূল হয়েছে, যক্ষ্মাও এতোদিনে নির্মূল হওয়া উচিত ছিলো। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিশ্বে যক্ষ্মারোগীর সংখ্যার দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান সপ্তম। এখনও বাংলাদেশে লাখে ২২৫ জন যক্ষ্মা রোগী রয়েছে। শিশুদের যক্ষ্মা শনাক্তকরণের সমস্যা ও জনসচেতনতার অভাবে দেশে শিশু যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ এখন চ্যালেঞ্জের মুখে। ২০১৫ সালের তুলনায় ২০১৬ সালে শিশু যক্ষ্মা রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। যক্ষ্মা শনাক্তকরণে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের কারণে এই সংখ্যা বেশি চিহ্নিত হয়েছে। শিশুদের যক্ষ্মা ফুঁসফুঁস বা শরীরের অন্য কোনো অংশে প্রাথমিক ক্ষত সৃষ্টি হওয়ার পর রক্তের মাধ্যমে দ্রুত শরীরের অন্যান্য স্থান, যেমন-মস্তিষ্ক, হাড় ইত্যাদিতে ছড়িয়ে পড়তে পারে, বড়দের ক্ষেত্রে যা সচরাচর দেখা যায় না। তাই শিশু যক্ষ্মা রোগ শনাক্তকরণে বেশ সতর্ক হতে হয়। ডায়াগনস্টিক সুবিধার অপ্রতুলতা, লক্ষণ নিয়ে বিভ্রান্তি, চিকিত্সকদের অদক্ষতাসহ আরও কিছু কারণে শিশুদের যক্ষ্মা রোগ শনাক্তকরণ ও চিকিত্সা নিয়া তৈরি হয়েছে এই ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতি। অন্যদিকে ভাসমান জনগোষ্ঠী ও ঘনবসতির কারণে গ্রামের তুলনায় শহরে যক্ষ্মা রোগী বেশি। এই সকল নানান চ্যালেঞ্জের মধ্যে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ২০২০ সালের মধ্যে দেশ থেকে যক্ষা নির্মূল করার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। বর্তমানে যক্ষ্মা নিরাময়ের সাফল্যের হার ৯২ শতাংশ এবং ওষুধ-প্রতিরোধী যক্ষ্মা নিরাময়ের হার ৮২ শতাংশ। কিন্তু সমস্যা থেকে যাচ্ছে শনাক্তকরণের ক্ষেত্রে। বর্তমানে শনাক্তকরণের হার ৫৩ শতাংশ। বাকি ৪৭ শতাংশ রোগী শনাক্তকরণের বাইরে থেকে যাচ্ছে। শনাক্তকরণ মূল সমস্যা হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে শনাক্তকরণ সহজ করতে সরকার উপজেলা পর্যায়ে জিন এক্সপার্ট মেশিন পৌঁছানোর পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে।
যক্ষ্মামুক্ত বাংলাদেশ গড়তে হলে পাড়ি দিতে হবে অনেকখানি পথ। যক্ষ্মা বিষয়ে অনেকেই এখনও অসচেতন। ভীতি আর অজ্ঞতার কারণে তারা চিকিত্সাসেবা থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে। অথচ একটু সচেতনতাই তাদের যক্ষ্মা থেকে মুক্তি দিতে পারে। যদি সঠিক সময়ে রোগ চিহ্নিত করে চিকিত্সা নেয়া যায়, তাহলে যক্ষ্মা পুরোপুরি সেরে যায়। সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার অবদানে যক্ষ্মা রোগের চিকিত্সা এখন দেশের প্রায় সর্বত্রই পাওয়া যাচ্ছে। এখন অনগ্রসর ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে আরও খানেকটা সচেতন হতে হবে। সুস্থ থাকতে চাইলে তাদের ধূমপান বর্জন করতে হবে। কাশি দীর্ঘমেয়াদী হয়ে পড়লে চিকিত্সকের নিকট গিয়ে নিশ্চিত হতে হবে যে, তা যক্ষ্মার দিকে যাচ্ছে কি-না। ভীতির চাইতে সচেতনতাই এক্ষেত্রে অধিক কার্যকরী। দীর্ঘমেয়াদী চিকিত্সা শুরু হলে তা সম্পন্ন করার ধৈর্যও ধারণ করতে হবে। সরকারের দিক থেকেও যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণের প্রচারাভিযান অধিক বেগবান করা প্রয়োজন।