জঙ্গি বোমায় রক্তাক্ত সিলেট

সিলেটের দক্ষিণ সুরমার শিববাড়িতে ‘জঙ্গিবাড়ি’ আতিয়া মহলে সেনাবাহিনী এবং পুলিশের সম্মিলিত অভিযানের মধ্যে যেভাবে গেরিলা কায়দায় জঙ্গিরা বোমা হামলা চালিয়ে এক পুলিশ ইন্সপেক্টরসহ ৬ জনকে হত্যা করেছে, তা হতবাক করে দিয়েছে সবাইকে। শনিবার সন্ধ্যা ও রাতে দুই দফায় পুলিশ চেকপোস্টের সামনে ভয়াবহ এই বোমা হামলা চালানো হয়। সন্ত্রাসীরা মোটরসাইকেলযোগে এসে এই হামলা চালায়। হামলায় ৩০ জনেরও অধিক আহত হয়েছেন। জঙ্গিবাড়ি ঘিরে ‘অপারেশন টোয়াইলাইট’ চলাকালে সেনাবাহিনীর প্রেস বিফ্রিং শেষ হওয়ার পরপরই এই হামলা চালানো হয়, যা নিঃসন্দেহে অজানা এক আশঙ্কাজনক পরিস্থিতিকেই নির্দেশ করছে।

গণমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, জঙ্গিবাড়ি আতিয়া মহল নিয়ে যে অপারেশন চালানো হচ্ছে তা এখনো সমাপ্ত হয়নি। আবার ‘অপারেশন টোয়াইলাইট’ পুলিশ, র‌্যাব কিংবা সোয়াটও প্রত্যক্ষ অভিযান চালায়নি। পুরো অভিযানের নেতৃত্ব এসে পড়েছে প্যারা কমান্ডোর হাতে। প্যারা কমান্ডোর সাথে জঙ্গিদের দফায় দফায় গোলাগুলি-বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে চলেছে। এ আতঙ্কজনক পরিস্থিতির মধ্যদিয়ে জঙ্গিরা তলে তলে কত শক্তিশালী হয়ে উঠেছে, সেটিও স্পষ্ট। মোদ্দা কথা হলো- যারা একটি দেশের প্রশিক্ষিত সেনাবাহিনীর সাথে প্রতিরোধের দুঃসাহস রাখে বা রাখছে, তাতে বিষয়টি অত্যন্ত গুরুতর পরিস্থিতিরই যে জানান দিচ্ছে তা অস্বীকারেরও সুযোগ থাকছে না। আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, সরকার কিংবা রাজনৈতিক নেতাদের পক্ষ থেকে যতোই বলা হোক- জঙ্গি নির্মূল হয়েছে, জঙ্গিদের মেরুদণ্ড ভেঙেছে, বাস্তবতা তার বিপরীত অবস্থানকেই চিত্রিত করছে। আমরা বলছি না, জঙ্গি দমন বা নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্টদের সফলতা নেই। সরকার যে জঙ্গি সন্ত্রাসী দমনে জিরো টলারেন্স অবস্থানে সেটিও স্পষ্ট। অন্যদিকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে জঙ্গিরা কীভাবে শক্তিশালী মারণাস্ত্রের মজুদ করছে, এ বিষয়টিও সাধারণ মানুষকে ভাবিয়ে তোলার জন্য যথেষ্ট। আর সার্বিক বিবেচনায় বিদ্যমান পরিস্থিতি যে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতিরই নির্দেশক, এমনটি বলাও বোধ করি বাহুল্য নয়।

বাংলাদেশে জঙ্গিদের উত্থান ও তাদের গোপনে সংগঠিত হওয়া নিয়ে এ পর্যন্ত কম আলোচনা হয়নি। আলোচনায় উঠে এসেছে জননিরাপত্তা রক্ষার বিষয়টিও। গত বছর ১ জুলাই গুলশান হত্যাকাণ্ড থেকে শুরু করে সর্বশেষ সিলেটে যে হামলা চালানো হলো, তাতে একটি বিষয় স্পষ্ট যে- ক্ষমতাসীনরা যতোই বলুক এটি বিএনপি-জামায়াতের কাজ, এরা জঙ্গিদের উসকানি দিচ্ছে। আমরা মনে করি, কেবল বিরোধিতার জন্য বিরোধিতা বা দোষ চাপানোর সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে এসে বিষয়টি নিয়ে সম্মিলিত রাজনৈতিক ঐক্য অত্যন্ত জরুরি। কিছুদিন আগে গুপ্তহত্যার মাধ্যমে একের পর এক বিদেশি নাগরিকসহ দেশের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। হামলা চালিয়ে হত্যা করা হয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের। এ পরিস্থিতি কিছুতেই একটি স্বাধীন রাষ্ট্রে চলতে পারে না। জঙ্গি হামলাগুলো বিবেচনায় এমন আশঙ্কাও অমূলক নয় যে, এদের রুখে দেয়া না গেলে এদের হাতে আক্রান্ত হবে স্থাপনা, আক্রান্ত হবে উৎসব, সর্বোপরি সাধারণ মানুষ। ইতোমধ্যে এর আলামতও স্পষ্ট। জঙ্গি শক্তির কাছে পুলিশ, র‌্যাব, সোয়াট যে নিছকই তুচ্ছ, সিলেটের জঙ্গিবিরোধী অভিযানে ঘটে যাওয়া রক্তাক্ত হামলাগুলো কী সেই বার্তাও দিচ্ছে না?

অনস্বীকার্য যে, জঙ্গিরা সরকার এবং রাষ্ট্রকাঠামোর বিপক্ষে সর্বনাশা এক আতঙ্ক হিসেবেই আবির্ভূত হয়েছে। অপশক্তি এবং মানবতা ধ্বংসকারী এই জঙ্গি-সন্ত্রাসীদের নিয়ন্ত্রণ, নির্মূলে এদের পৃষ্ঠপোষক ও মদদদাতাদেরও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির বিষয়টিও বহুবার সামনে এসেছে। বিশেষজ্ঞরা এ-ও বলেছেন, জঙ্গি নির্মূল করতে চাইলে এদের অর্থ ও অস্ত্রের উৎস বন্ধ করতে হবে। বাস্তবতা হলো, সংশ্লিষ্টরা যে উদ্যোগ নেয়নি এমনটিও নয়। কিন্তু তা কেন বাস্তবায়িত হয়নি- তাও নানা প্রশ্নের জন্ম দেয়। বিষয়টি অত্যন্ত পরিতাপেরও। জঙ্গিদের আশ্রয়দাতাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার ব্যর্থতা জঙ্গিদের আরও উৎসাহিত করছে- এমন আলোচনাও হয়তো অযৌক্তিক নয়। সরকারের সদিচ্ছা থাকলেই চলবে না, তার যথাযথ বাস্তবায়নও যে অত্যন্ত জরুরি, সম্প্রতি জঙ্গি হামলাগুলো এ কথায় স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে। আমরা মনে করি, জঙ্গিগোষ্ঠীর মূলোৎপাটনে সময়োপযোগী কৌশল প্রণয়ন এবং তার যথাযথ বাস্তবায়নের বিকল্প থাকতে পারে না। দেশের উন্নয়নের ধারাবাহিকতা রক্ষা, জননিরাপত্তা নিশ্চিত এবং জঙ্গি হামলার পুনরাবৃত্তি রোধে, বিষয়টি সরকারকেই নিশ্চিত করতে হবে।