অ্যাসল্ট ১৬ : নারী ও শিশুসহ নিহত ৫
স্টাফ রিপোর্টার: সীতাকুণ্ডে জঙ্গি আস্তানায় অভিযানে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে দুটি জঙ্গি আস্তানায় ১৯ ঘণ্টার শ্বাসরুদ্ধকর অভিযানে শিশু ও নারীসহ ৫ জন নিহত হয়েছেন। শিশু ছাড়া বাকি ৪ জন নব্য জেএমবির সদস্য। পুলিশ জানায়, নিহতদের মধ্যে দুজন ছিলেন নব্য জেএমবির আত্মঘাতী স্কোয়াডের সদস্য। আত্মঘাতী বিস্ফোরণের পর জঙ্গিদের শরীর ছিন্নভিন্ন হয়ে আশেপাশের কয়েকশ গজ দূরে গিয়ে ছিটকে পড়ে। বাকি দুই জঙ্গি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাথে গুলিবিনিময়কালে প্রাণ হারান। ছয় বছর বয়সের শিশুটির লাশ সিঁড়ির উপর পড়েছিলো। গতকাল সন্ধ্যায় শিশুর লাশ উদ্ধার করা হয়।
পুলিশ নিহত জঙ্গিদের পরিচয় সম্পর্কে জানতে পারেনি। ঘটনার সময় গ্রেনেড বিস্ফোরণে সোয়াত বাহিনীর দুই জন, পুলিশের একজন এবং ফায়ার সার্ভিসের একজনসহ চারজন আহত হয়েছেন। তবে তাদের অবস্থা আশঙ্কাজনক নয় বলে জানা গেছে। অভিযানের শেষ পর্যায়ে ওই বাড়ির বিভিন্ন ফ্ল্যাটের ২০ বাসিন্দাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠানো হয়। তবে তারা অক্ষত রয়েছেন বলে পুলিশ জানায়। গতকাল বৃহস্পতিবার সকাল সোয়া ১০টায় চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি মো. শফিকুল ইসলাম অপারেশন অ্যাসল্ট-১৬ নামের ওই অভিযান শেষের ঘোষণা দেন। ১৯ ঘণ্টার এই অভিযানে পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট, সোয়াত, বোমা নিষ্ক্রিয়করণ টিম, সিআইডির ক্রাইম সিন ও পুলিশ সদর দফতরের এলআইসি টিমের সদস্যরা অংশ নেন।
বিস্ফোরক দিয়ে ৫০ কেজি বোমা বানানো যেতো: অভিযান শেষ হওয়ার পর সকাল সাড়ে ১০টা থেকে শুরু হয় গোলাবারুদ ও বিস্ফোরক উদ্ধারের কাজ। বিকাল ৩টায় কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের এডিসি কাজী ছানোয়ার আহমেদ ওই বাড়ি থেকে বিপুল পরিমাণ বিস্ফোরক উদ্ধারের কথা সাংবাদিকদের জানান। এর মধ্যে একটি কার্টনে এসিড, লিকুইড কেমিক্যাল ও ১২ সেট জেল এক্সক্লুসিভ পাওয়া যায়। তিনি বলেন, এখানে যেসব সরঞ্জাম পাওয়া গেছে সেগুলো দিয়ে ৪০ থেকে ৫০ কেজি বোমা বানানো যেত। যে বিস্ফোরক দিয়ে জঙ্গিরা আত্মঘাতী হয়েছে তা যদি কোনো জনবহুল এলাকায় হতো তাহলে আশেপাশের ৫০ গজের মধ্যে অবস্থানকারী সব লোকই মারা যেতো।
ডিআইজি মো. শফিকুল ইসলাম জানান, আমাদের চেষ্টা ছিলো ভবনের সাধারণ বাসিন্দাদের অক্ষত অবস্থায় বের করে আনা। বুধবার রাতে কয়েকবার চেষ্টা করেও তা সম্ভব হয়নি। বৃহস্পতিবার সকাল ৬টা থেকে আমাদের অপারেশন শুরু হয়। আমাদের সোয়াত সদস্যরা যখন পাশের ভবন থেকে মূল ভবনটিতে যায় তখন দুই জঙ্গি আল্লাহু আকবর বলে ছাদে উঠে আসে। এক জঙ্গি তার কোমরের সাথে বেঁধে রাখা বোমা টিপে বিস্ফোরণের চেষ্টা করে। তা দেখে সোয়াত সদস্যরা গুলি করলে এক জঙ্গি ঘটনাস্থলেই মারা যায়। বিকট শব্দে বোমাটি বিস্ফোরিত হলে অপর জঙ্গিও মারা যায়। এরপর আমরা ভেতর থেকে লোকজনকে বের করে নিয়ে আসার কাজ শুরু করি।
তিনি বলেন, ফায়ার সার্ভিস কর্মীদের সহযোগিতায় ভবনের বিভিন্ন দিকের জানালা খুলে ফেলে সেখান থেকে নারী ও শিশুসহ ২০ জনকে বের করে আনা হয়েছে। ভবনের সামনের দিকে যে বোমাটি ছিল সেটিও বিস্ফোরণ করা হয়েছে। ভবনের ভেতরে দু’টি কক্ষে প্রচুর বিস্ফোরক ও বোমা রয়েছে। ছাদেও একটি বোমা অবিস্ফোরিত অবস্থায় রয়ে গেছে।
জঙ্গিদের বিরুদ্ধে অভিযান শেষ হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, এখন ভবন নিরাপদ করার জন্য পুলিশের বোমা নিষ্ক্রিয়করণ টিম ভেতরে প্রবেশ করছে। আমরা চারটি মৃতদেহ সেখানে দেখেছি। দুটি লাশ একেবারেই ছিন্নভিন্ন হয়ে রয়েছে। দুটি লাশ মোটামুটি বোঝা যাচ্ছে। শরীরের বিভিন্ন অংশ বিভিন্ন স্থানে গিয়ে পড়েছে। এ ঘটনায় দুই সোয়াত সদস্য, এক পুলিশ ও এক ফায়ার সার্ভিস কর্মী আহত হয়েছেন।
জঙ্গিদের টার্গেট ছিলো বিদেশিরা: ডিআইজি আরো জানান, নিহত চার জঙ্গি নব্য জেএমবির সদস্য। চট্টগ্রামের এই অঞ্চলে সরকারের প্রচুর উন্নয়ন কাজ চলছে। এখানে অনেক বিদেশি কাজ করছে। বিদেশিরাই জঙ্গিদের টার্গেট ছিলো। বুধবার আটক দুই জঙ্গি সম্পর্কে তিনি জানান, যে দুজন আটক হয়েছে তারা অত্যন্ত হার্ডলাইনার। কোনো কথাই তারা বলছে না। আমরা একাধিকবার চেষ্টা করেছি তাদের কাছ থেকে কথা বের করার জন্য। কিন্তু তারা মুখ খুলছে না। এদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আমাদের বিশেষ টিম কাজ করছে।
ঘটনার শুরু: বুধবার বিকাল ৩টায় সীতাকুণ্ড পৌরসভার নামারবাজার আমিরাবাদের সাধন কুটির নামে একটি বাসা থেকে ভবন মালিকের সহায়তায় এক জঙ্গি দম্পতিকে তাদের ১৫ বছর বয়সী এক ছেলেসহ আটক করে পুলিশ। সাধন কুটিরের মালিক ও পরিবারের সদস্যরাই মূলত তাদের ধরে পুলিশের হাতে সোপর্দ করেন। এরপর তাদের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে বুধবার বিকাল ৪টায় একই উপজেলার প্রেমতলার ছায়ানীড় ভবনে আসে পুলিশ। ভবনের নিচতলায় এই আস্তানায় পুলিশ অভিযান চালাতে গেলে জঙ্গিদের ছোড়া গ্রেনেডে সীতাকুণ্ড থানার ওসি (তদন্ত) মোজাম্মেলসহ দুই পুলিশ সদস্য আহত হন। এরপর পুলিশ বাড়িটি সারা রাত ঘিরে রাখে।
রাতে দফায় দফায় হ্যান্ডমাইকে জঙ্গিদের আত্মসমর্পণের আহ্বানও জানায় পুলিশ। কিন্তু জঙ্গিরা ভেতর থেকে গ্রেনেড নিক্ষেপ করে প্রতিরোধ করতে থাকে। গভীর রাতে ঢাকা থেকে পুলিশের বিশেষ টিম সোয়াত ঘটনাস্থলে আসে। সকাল ৬টার দিকে শুরু হয় অপারেশন অ্যাসল্ট-১৬। অভিযানে সিএমপি, সোয়াত, জেলা পুলিশ, বিস্ফোরক নিষ্ক্রিয়করণ ইউনিট, কাউন্টার টেররিজম ইউনিট, র্যাব ও পুলিশ অংশ নেয়। এ সময় ভবনের ভেতর থেকে বিকট শব্দ শোনা যায়। অভিযানের শেষ পর্যায়ে ভবনের ভেতরে আটকে পড়া ২০ জনকে উদ্ধার করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এছাড়া নারীসহ চার জঙ্গির মরদেহ উদ্ধার করা হয়। দুপুর একটার দিকে আলামত সংগ্রহের জন্য ঘটনাস্থলে যায় সিআইডির ফরেনসিক টিম। রাতভর অভিযানকে কেন্দ্র করে সীতাকুণ্ডের প্রেমতলাসহ আশপাশের এলাকার পরিস্থিতি থমথমে হয়ে উঠে। সাধারণ মানুষদের মাঝে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। স্কুল-কলেজ ও অধিকাংশ দোকানপাট বন্ধ ছিলো।
চট্টগ্রাম পুলিশ সুপার নুরে আলম মিনা বলেন, এটা ছিলো আমাদের জন্য একটা দুঃসাহসিক অভিযান। নিজেদের নিরাপদে রেখে ও বাড়ির অন্য বাসিন্দাদের নিরাপত্তা বজায় রেখে অভিযান চালানো ছিল চ্যালেঞ্জিং কাজ। ভবনের ভেতরে নারী, শিশু ও বৃদ্ধ ছিল। তাদের যেন কোনো ক্ষতি না হয় সেটাই ছিল আমাদের উদ্দেশ্য। সবদিক ঠিক রেখে সফলভাবে আমরা অভিযান সম্পন্ন করেছি। বাড়ির মালিকের ছেলে মো. মহিউদ্দিন জানান, তাদের দোতলা বাড়িটিতে তারাসহ মোট সাতটি পরিবার থাকে। ২ মাস আগে নিজেদের রাবার ব্যবসায়ী পরিচয় দিয়ে দুই দম্পতি একটি বাসা ভাড়া নেয়। তবে তারা যে জঙ্গি, সে ব্যাপারে আগে কোনো আভাস পাওয়া যায়নি।