সুপ্রিমকোর্ট-মন্ত্রণালয় দ্বন্দ্ব : বিচার বিভাগে পদোন্নতিজট

অর্ধশত জেলা জজের পদ শূন্য : শর্ত শিথিলের প্রস্তাব পড়ে আছে ছয় মাস : অতিরিক্ত জেলা জজ যুগ্ম জেলা জজ পদেও আটকে আছে

স্টাফ রিপোর্টার: সুপ্রিমকোর্ট-আইন মন্ত্রণালয়ের টানাপোড়েনে জেলা জজ পদে পদোন্নতি বন্ধ হয়ে আছে। ছয়টি জেলা ও দায়রা জজসহ প্রায় অর্ধশত জেলা জজের পদ শূন্য থাকলেও তা পূরণ করা সম্ভব হচ্ছে না। ছয় মাস আগে মন্ত্রণালয় থেকে জেলা জজ পদে পদোন্নতির জন্য একটি প্যানেল প্রস্তুত করা হয়। কিন্তু এটি এখনও চূড়ান্ত করেননি সুপ্রিমকোর্ট। আবার সুপ্রিমকোর্টের ফুলকোর্ট থেকে এ পদে পদোন্নতির শর্ত শিথিলের পরামর্শ দিলেও তা বাস্তবায়ন করেনি মন্ত্রণালয়। দ্বৈতশাসনের এই টানাপোড়েনেই বিচার বিভাগের পদোন্নতিতে জটের সৃষ্টি হয়েছে। জেলা জজ পদে পদোন্নতি না হওয়ায় অতিরিক্ত জেলা জজ পদেও পদোন্নতি আটকে আছে। আবার অতিরিক্ত জেলা জজ পদে পদোন্নতি আটকে থাকায় যুগ্ম জেলা জজ পদে পদোন্নতি হচ্ছে না। একইভাবে অন্যান্য পদেও পদোন্নতি থমকে আছে। এ নিয়ে বিভিন্ন স্তরের পদোন্নতি প্রত্যাশী প্রায় দুই শতাধিক বিচারকের মধ্যে ক্ষোভ ও হতাশা কাজ করছে। বিরূপ প্রভাব পড়তে শুরু করেছে বিচারপ্রার্থীদের ওপর। সহসাই পদোন্নতির জট না খুললে বিচার প্রার্থীরা চরম দুর্ভোগের মধ্যে পড়বে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

জেলা জজ পদে পদোন্নতি বন্ধের ব্যাপারে জানতে চাইলে আইন সচিব আবু সালেহ শেখ মুহাম্মদ জহিরুল হক  বলেন, আমরা প্রায় ছয় মাস আগে বিভাগীয় পদোন্নতি কমিটি (ডিপিসি) করে ১০৮ জনকে যোগ্য পেয়েছি। সে তালিকা করে আমরা হাইকোর্টে পাঠিয়েছি। এ পদোন্নতি হাইকোর্টের ফুলকোর্ট হয়ে আসে। আমাদের পাঠানো তালিকাটি ফুলকোর্ট হয়ে ফেরত আসেনি।

অন্যদিকে সুপ্রিমকোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল সৈয়দ আমিনুল ইসলাম এ ব্যাপারে বলেন, ‘একটি জায়গাতেই এ পদোন্নতি আটকে আছে। সেটা হচ্ছে জেলা জজ পদে পদোন্নতির ক্ষেত্রে শর্ত শিথিল করে অতিরিক্ত জেলা জজ হিসেবে বিচারিক কাজের অভিজ্ঞতা দু’বছরের স্থলে ছয় মাস করতে ফুলকোর্টের সিদ্ধান্ত রয়েছে। শর্ত শিথিল করে মন্ত্রণালয় থেকে গেজেট জারি হলেই পদোন্নতির বাধা কেটে যাবে। মূলত এ জায়গাতেই পদোন্নতি আটকে আছে। তিনি আরও বলেন, জেলা জজ পদে পদোন্নতি বন্ধ থাকার কারণে অতিরিক্ত জেলা জজ, যুগ্ম জেলা জজসহ অন্যান্য পদেও পদোন্নতি বন্ধ রয়েছে। জেলা জজ পদে পদোন্নতি হলে নিচের দিকে পদ শূন্য হবে। তখন সবারই পদোন্নতি হবে।’ খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সর্বশেষ প্রায় দু’বছর আগে জেলা জজ পদে পদোন্নতি হয়েছে। এরপর এ পদে পদোন্নতির প্যানেল চূড়ান্ত করার জন্য গত বছরের সেপ্টেম্বরে আইন মন্ত্রণালয় থেকে ১০৮ জন অতিরিক্ত জেলা জজের তালিকা পাঠানো হয় সুপ্রিমকোর্টে। কিন্তু জুডিশিয়াল সার্ভিস বিধিমালা অনুযায়ী অতিরিক্ত জেলাজজ হিসেবে দু’বছর বিচারিক কাজের অভিজ্ঞতা না থাকায় অনেকেই প্যানেল থেকে বাদ পড়েন। কিন্তু প্রশাসনিক কাজের প্রয়োজনে সুপ্রিমকোর্টের পরামর্শে আইন মন্ত্রণালয় ওইসব কর্মকর্তাকে প্রেষণে নিয়োগ দিয়েছে। এতে করে অনেকেই অতিরিক্ত জেলা জজ হিসেবে দুই বছর দায়িত্ব পালন করলেও বিচারিক কাজের অভিজ্ঞতা নেই। তবে বিধিমালার শর্ত অনুযায়ী তাদের মোট চাকরির বয়সকাল ১৫ বছর পূর্ণ হয়েছে। কিন্তু বিচারিক অভিজ্ঞতা না থাকায় পদোন্নতির প্যানেল থেকে বাদ পড়েন। এ অবস্থায় জুডিশিয়াল সার্ভিস পদোন্নতি বিধিমালার ৪ ধারার উপধারা (৪)(এ) অনুযায়ী বিচারিক অভিজ্ঞতার শর্ত শিথিলের সিদ্ধান্ত নেন সুপ্রিমকোর্টের ফুলকোর্ট।

বিধিমালার ৪ ধারার উপধারা-৪(এ) বলা হয়েছে, (নিয়োগকারী) কর্তৃপক্ষ সুপ্রিমকোর্টের সহিত পরামর্শক্রমে, সরকারি গেজেটে প্রকাশিত আদেশ দ্বারা তফসিলের প্রথম অংশে উল্লিখিত কোনো পদের বিপরীতে উল্লিখিত যোগ্যতা জনস্বার্থে শিথিলক্রমে পদোন্নতিদান করিতে পারিবেন। এই বিধান অনুযায়ী গত বছরের ৯ সেপ্টেম্বর সুপ্রিমকোর্টের ফুলকোর্ট সভা থেকে জেলা জজ পদে পদোন্নতির জন্য শর্ত শিথিল করে অতিরিক্ত জেলা জজ হিসেবে বিচারিক কাজের অভিজ্ঞতা দু’বছরের স্থলে ছয় মাস নির্ধারণ করেন। বিচারিক কাজের অভিজ্ঞতা শিথিল করলেও জেলা জজ পদে পদোন্নতির ক্ষেত্রে মোট চাকরির সময়কাল ১৫ বছর বহাল রাখা হয়। বিধিমালার এই শর্ত মোতাবেক এর আগেও জনস্বার্থে বিচারকদের পদোন্নতির ক্ষেত্রে একাধিকবার শর্ত শিথিল করার নজির রয়েছে। প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে হাইকোর্ট বিভাগের সব বিচারপতির উপস্থিতিতে নেয়া ওই ফুলকোর্ট সভার সিদ্ধান্ত জানিয়ে আইন মন্ত্রণালয়ের সচিব বরাবর চিঠি পাঠানো হয় গত বছরের ২০ সেপ্টেম্বর। বিষয়টি নিয়ে গেজেট প্রকাশ করতে বলা হয় চিঠিতে। তবে সুপ্রিমকোর্ট থেকে পাঠানো চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে এখনও কোনো উদ্যোগ নেয়নি মন্ত্রণালয়। এ কারণে জেলা জজ পদে পদোন্নতির প্যানেল চূড়ান্ত করার কাজও আটকে আছে। আর বিচার প্রশাসনে দ্বৈতশাসনের টানাপোড়েনের খেসারত গুনতে হচ্ছে ভুক্তভোগী বিচারক ও বিচারপ্রার্থীদের।

পদোন্নতি আটকে থাকার ব্যাপারে জানতে চাইলে আইন বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক বলেন, স্পষ্টত দ্বৈতশাসনের কারণে বিভিন্ন প্রশাসনিক জটিলতা তৈরি হচ্ছে। বিচার বিভাগের অনেক শূন্য পদ যথাসময়ে পূরণ হচ্ছে না। ফলে বিচারপ্রার্থীদের ভোগান্তি বেড়ে যাচ্ছে। মামলার জট দীর্ঘায়িত হচ্ছে। এ অবস্থায় দ্বৈতশাসনের অবসান জরুরি হয়ে পড়েছে। বিচার প্রশাসন নিয়ন্ত্রণের একক দায়িত্ব সুপ্রিমকোর্টের ওপর ন্যস্ত হওয়া দরকার।

সুপ্রিমকোর্ট ও মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে জেলা জজের মঞ্জুরিকৃত পদ ২২৬টি। এর মধ্যে ৬টি জেলার জেলা ও দায়রা জজ পদ শূন্য আছে। এছাড়া জেলা জজ পদমর্যাদার আরও ৪০টি পদ শূন্য রয়েছে। চলতি বছর আরও ১৭ জেলা জজ অবসরে যাবেন। এছাড়া চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে জেলা জজ পদমর্যাদার ৪১টি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের পদ সৃষ্টির বিষয়টিও। সব মিলিয়ে এ বছরই শূন্য হতে পারে অন্তত শতাধিক জেলা জজ পর্যায়ের কর্মকর্তার পদ। নিয়ম অনুযায়ী অতিরিক্ত জেলা জজদের মধ্য থেকে জেলা জজ পদে পদোন্নতির জন্য তৈরিকৃত প্যানেল থেকে শূন্য পদগুলো পূরণ করা হবে। কিন্তু দ্বৈতশাসনের জাঁতাকলে পড়ে আজও পদোন্নতি প্যানেল তৈরির কাজ চূড়ান্ত হয়নি। এতে করে পদোন্নতি প্রত্যাশী বিচারকরা যুগান্তরের এই প্রতিবেদকের কাছে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। এ অবস্থায় দ্রুত জেলা জজ পদে পদোন্নতির ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে বিচার বিভাগে বড় ধরনের অসন্তোষ দেখা দেবে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেন সংশ্লিষ্টরা। এতে বিচারপ্রার্থীরাও চমর দুর্ভোগের মুখে পড়বেন।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে আরও জানা গেছে, অতিরিক্ত জেলা থেকে জেলা জজ পদে পদোন্নতি না হওয়ায়, অতিরিক্ত জেলা জজ পদেও পদোন্নতি আটকে আছে। সূত্র জানায়, ১৮তম এবং ২৪তম বিসিএসের মাধ্যমে নিয়োগপ্রাপ্ত বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তা যারা বর্তমানে যুগ্ম জেলা জজ পদে কর্মরত আছেন তাদের অতিরিক্ত জেলা জজ পদে পদোন্নতি দেয়া হবে। এ লক্ষ্যে ২০১৫ সালের প্রথমদিকে ১৭১ জনের একটি প্যানেল প্রস্তুত করা হয়। ওই প্যানেল থেকে ইতিমধ্যে প্রায় ১০০ জন অতিরিক্ত জেলা জজ পদে পদোন্নতিও পেয়েছেন। ওই প্যানেলের এখনও প্রায় ৭০ জনের মতো পদোন্নতি পাননি। জেলা জজ পদে পদোন্নতি বন্ধ থাকায় অতিরিক্ত জেলা জজের পদ শূন্য হচ্ছে না। এ কারণে বর্তমানে যুগ্ম জেলা জজ হিসেবে কর্মরত ও অতিরিক্ত জেলা জজ পদে পদোন্নতির প্যানেলভুক্ত যাদের এখনও পদোন্নতি ও পদায়ন হয়নি, তাদের অনেকেই ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন।

২০১৫ সালের প্রথমদিকে একই সঙ্গে ৩৪৮ জন সিনিয়র সহকারী জজকে যুগ্ম জেলা জজ পদেও পদোন্নতির প্যানেলভুক্ত করা হয়। বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশনের তৃতীয় ব্যাচে নিয়োগপ্রাপ্তদের নিয়ে এই প্যানেল তৈরি হয়। কিন্তু ওপরের দিকে পদোন্নতি বন্ধ থাকায় এখনও ওই প্যানেলের প্রায় ১০০ জনকে যুগ্ম জেলা জজে পদোন্নতি দিয়ে পদায়ন সম্ভব হয়নি। একই সঙ্গে প্যানেলভুক্ত হয়ে অনেকে যুগ্ম জেলা জজ হিসেবে কর্মরত থাকলেও এই ১০০ জন এখনও সিনিয়র সহকারী জজ হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

যে ৬ জেলায় জেলা ও দায়রা জজের পদ শূন্য: বর্তমানে যশোর, কুষ্টিয়া, নোয়াখালী, পটুয়াখালী, খাগড়াছড়ি ও সিলেট জেলার জেলা ও দায়রা জজের পদ শূন্য রয়েছে। এসব জেলায় জেলা ও দায়রা জজ না থাকায় বিচার প্রশাসন ও বিচারিক কাজ বিঘ্নিত হচ্ছে। মামলা নিষ্পত্তিতে গতি কমে আসছে। এর প্রভাব পড়ছে বিচারপ্রার্থীদর ওপর।

অন্য যেসব জেলা জজের পদ শূন্য: নীলফামারী, বাগেরহাট, জামালপুর, সুনামগঞ্জ, রংপুর, কুড়িগ্রাম, শেরপুর, সাতক্ষীরা, ঝিনাইদহ, খুলনা, পাবনা, কক্সবাজার, পটুয়াখালী, টাঙ্গাইল, কুষ্টিয়া, নেত্রকোনা, নাটোরের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল, রাজশাহীর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-২, চট্টগ্রামের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-২ ও ৩, বরিশালের প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনাল, ঢাকার ট্যাক্সেস আপিলাত ট্রাইব্যুনালের সদস্য, নোয়াখালী, কুষ্টিয়া, জামালপুর ও ফরিদপুরের বিশেষ জজ, ঢাকার কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট আপিলাত ট্রাইব্যুনালের সদস্য, চট্টগ্রামের দ্বিতীয় শ্রম আদালতের চেয়ারম্যান, রাজশাহীর শ্রম আদালতের চেয়ারম্যান, ৬৪টি জেলা সদরে চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ভবন নির্মাণ প্রকল্পের প্রধান সমন্বয়ক, বিচার প্রশাসন প্রশিক্ষণ ইন্সটিটিউটের পরিচালক, ঢাকার প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনাল-১’র সদস্য, জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থার পরিচালক, ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক, বরিশালের দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক, চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের আইন কর্মকর্তা, চট্টগ্রামের দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক, খুলনার প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনালের সদস্যপদ শূন্য রয়েছে। উল্লেখিত সব পদই জেলা জজ পদমর্যাদার। জেলা জজের এসব শূন্য পদ ছাড়াও অতিরিক্ত জেলা জজ পদের ৯টি, যুগ্ম জেলা জজ পদে ২০টি, সিনিয়র সহকারী জজ পদে প্রায় দুশ এবং সহকারী জজ পদে প্রায় দুশ পদ শূন্য রয়েছে বলে সূত্র জানিয়েছে।