বিদ্যুতের দাম ইউনিটে ১ টাকা বৃদ্ধির প্রস্তাব

 

স্টাফ রিপোর্টার: গ্যাসের দামবৃদ্ধির পর এবার বিদ্যুতের দাম বাড়াতে যাচ্ছে সরকার। রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ বিদ্যুত উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) বিদ্যুতের পাইকারি ও খুচরা মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাব দিয়েছে। বিদ্যুত বিতরণকারী অন্য সংস্থা-কোম্পানিগুলোও মূল্যহার বাড়ানোর প্রস্তাব প্রায় চূড়ান্ত করেছে। দুই সপ্তাহের মধ্যে সবগুলো কোম্পানির দামবৃদ্ধির প্রস্তাব এ খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনে (বিইআরসি) জমা পড়বে।

বিদ্যুত, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়, বিইআরসি এবং পিডিবি সূত্র জানায়, বর্তমানে প্রতি ইউনিট (কিলোওয়াট) বিদ্যুতের গড়ে খুচরা মূল্য ৬ টাকা ৭৩ পয়সা। গত বৃহস্পতিবার ভোক্তা পর্যায়ে খুচরা মূল্য বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছে পিডিবি। ডিমান্ড চার্জ ও সার্ভিস চার্জ বৃদ্ধিসহ প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম অন্তত ৭ টাকা ৭১ পয়সা নির্ধারণ করতে চায় সংস্থাটি। অর্থাত প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের মূল্য ১৪ দশমিক ৫৬ শতাংশ বা ৯৮ পয়সা বৃদ্ধির প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। আগামী ১ এপ্রিল থেকেই নতুন পাইকারি ও খুচরা মূল্যহার কার্যকর করার অনুরোধ করা হয়।

এর আগে ২০১৫ সালের ১ সেপ্টেম্বর থেকে কার্যকর  হওয়া বর্তমান মূল্যহার সমন্বয়ের সময় পিডিবি ২২ শতাংশ মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাব করলেও বিইআরসি গড়ে ২ দশমিক ৯৩ শতাংশ দামবৃদ্ধি করেছিলো। বিদ্যুত বিতরণকারী ছয়টি সংস্থা ও অন্য কোম্পানিগুলোর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জানান, নতুন প্রস্তাবে তারা বিদ্যুতের দাম ২০ থেকে ২৫ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধির প্রস্তাব করতে যাচ্ছেন। তবে বিইআরসির সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তা জানান, গ্যাসের দাম বাড়লেও তেলের দাম কমায় বিদ্যুতের উত্পাদন খরচ বাড়ছে না। তবে এ খাতের উন্নয়নে ও সরকারের নির্দেশনার কারণে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম ৫ শতাংশ বা ৩৩-৩৫ পয়সা পর্যন্ত বাড়তে পারে। আগামী আগস্ট মাস থেকে কার্যকর হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

পিডিবির পর অন্য কোম্পানিগুলোর প্রস্তাব: গত ২০ ফেব্রুয়ারি পিডিবি বিদ্যুতের পাইকারি মূল্য (বিতরণ কোম্পানির কাছে বিক্রির মূল্য) বৃদ্ধির প্রস্তাব দেয়। ওই প্রস্তাবে পাইকারি বিদ্যুতের দাম প্রতি ইউনিটে ৭২ পয়সা বাড়ানোর প্রস্তাব দেয়া হয়। বর্তমানে বিতরণ কোম্পানিগুলোর কাছে পিডিবি প্রতি ইউনিট বিদ্যুত ৪ টাকা ৮৭ পয়সায় বিক্রি করে। নতুন প্রস্তাবে এই দাম বাড়িয়ে ৫ টাকা ৫৯ পয়সা নির্ধারণ করার কথা বলা হয়েছে। প্রস্তাব অনুযায়ী পাইকারি বিদ্যুতের দাম ১৪ দশমিক ৭৮ শতাংশ বাড়বে।

পিডিবি পাইকারি মূল্য বাড়ানোর আবেদনের পর বিতরণ কোম্পানিগুলো নতুন করে খুচরা মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাব জমা দেয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এ প্রসঙ্গে একটি বিতরণ কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, চলতি বছরের এপ্রিলের মধ্যেই বিদ্যুতের খুচরা মূল্যহার বাড়ানোর পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু সর্বশেষ প্রস্তাবনাটি জমা দেওয়া হয় ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে। গত ১৪ মাসে এ খাতে আরো পরিবর্তন ঘটেছে। বার্ষিক আয়-ব্যয়ের হিসাবেও পরিবর্তন এসেছে। আইনি ঝামেলা এড়াতে নতুন করে প্রস্তাব দেওয়া হচ্ছে।

বিইআরসির এক সদস্য বলেন, বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব আসতে শুরু করেছে। এগুলো আসার পর কারিগরি কমিটি মূল্যায়ন করবে এবং গণশুনানির আয়োজন করা হবে। সার্বিকভাবে মূল্য সমন্বয়ের পরবর্তী ঘোষণা আসতে অন্তত আগস্ট পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, আরইবি এবং নবগঠিত বিদ্যুত বিতরণ কোম্পানি নর্থ ওয়েস্ট জোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (এনডব্লিউজেডপিডিসি) চলতি সপ্তাহে বিইআরসিতে দামবৃদ্ধির প্রস্তাব পাঠাবে। মার্চের তৃতীয় সপ্তাহের মধ্যে ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ডিপিডিসি), ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি (ডেসকো), ওয়েস্ট জোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ওজোপাডিকো) নতুন প্রস্তাব বিইআরসিতে পাঠাবে। এদিকে বিদ্যুতের হুইলিং চার্জ (সঞ্চালন ও বিতরণ মাসুল) বাড়ানোর প্রস্তাবও এ মাসেই জমা দিবে পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ (পিজিসিবি)। এনডব্লিউজেডপিডিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. জাকিউল ইসলাম বলেন, বিদ্যুতের উত্পাদন খরচের চেয়ে বিক্রয় মূল্য কম। মূল্য সমন্বয়ের প্রস্তাব আগামী সপ্তাহে বিইআরসিতে দেয়া হবে।

পিডিবির চেয়ারম্যান খালেদ মাহমুদ বলেন, বর্তমানে যে দামে বিদ্যুত্ কেনা হচ্ছে, তার চেয়ে পাইকারি ও খুচরা বিক্রি মূল্য অনেক কম। আমরা ঘাটতিতে রয়েছি। পিডিবি প্রতি বছর লোকসান করছে। এভাবে চলতে পারে না। দাম সমন্বয় করা জরুরি। তাই দামবৃদ্ধির প্রস্তাব দিচ্ছি। বিদ্যুত খাতের টেকসই উন্নয়নের জন্যও দামবৃদ্ধি প্রয়োজন।

পিডিবি সূত্র জানায়, গত অর্থবছরে (২০১৫-১৬) পিডিবির প্রায় ৮ হাজার ৯৪০ কোটি টাকা আর্থিক লোকসান হয়েছে। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সবচেয়ে লোকসানি সংস্থা এটি। চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে লোকসানের পরিমাণ বেড়েছে। বেসরকারি ভাড়াভিত্তিক ও আইপিপি (ইনডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসার) কেন্দ্রগুলো থেকে উচ্চ মূল্যে বিদ্যুত কিনে কম দামে বিতরণ কোম্পানির কাছে বিক্রি করায় লোকসান বাড়ছে। বিশেষ করে তেলভিত্তিক বিদ্যুত কেন্দ্রগুলো থেকে গড়ে ইউনিট প্রতি আট থেকে নয় টাকায় বিদ্যুত্ কিনতে হয়। পিডিবি নিজস্ব কেন্দ্র ছাড়াও সরকারি-বেসরকারি কেন্দ্রগুলো থেকে বিদ্যুত কিনে বিতরণ কোম্পানিগুলোর কাছে বিক্রি করে। বিতরণ কোম্পানিগুলো ভোক্তাদের কাছে বিদ্যুত্ পৌঁছে দেয়।

গ্যাসের দামবৃদ্ধির প্রভাব পড়বে না বিদ্যুত উত্পাদনে: গত ফেব্রুয়ারিতে গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির সময় বিইআরসির এক মূল্যায়নে বলা হয়েছে তেলের দাম কমায় প্রতি ইউনিট বিদ্যুত উত্পাদনে ব্যয় কমেছে ৩৪ পয়সা। আর বিদ্যুত উত্পাদনে দুই ধাপে গ্যাসের মূল্য বাড়বে ১২ দশমিক শূন্য ৬ শতাংশ। এর ফলে প্রতি ইউনিটে উত্পাদন ব্যয় বাড়বে ৩৪ পয়সা। অর্থাত সার্বিকভাবে গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব বিদ্যুতের উত্পাদন ব্যয়ে পড়বে না। গ্যাসের দাম বাড়ায় যে খরচ বাড়বে, তেলের দাম কমায় তা মিটে যাবে। আর তেলের দাম আরো কমানোর সুযোগ সরকারের হাতে রয়েছে।

এ প্রসঙ্গে কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক শামসুল আলম বলেন, গ্যাসের দাম বাড়ানো অন্যায্য হয়েছে। এখন বিদ্যুতের যে দাম বাড়ানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে তাও অযৌক্তিক।