নারীর গৌরবময় অগ্রযাত্রা

 

আন্তর্জাতিক নারী দিবস আজ। নারীর প্রতি সাধারণ সম্মান ও শ্রদ্ধা প্রদর্শন এবং তাহাদের আর্থিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক অধিকার প্রতিষ্ঠার বিষয়টিকে গুরুত্বসহকারে তুলে ধরতে বিশ্বে প্রতিবছর এই দিবসটি পালন করা হয়। দিবসটি উদযাপনের পশ্চাতে নারী শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের সংগ্রামের ইতিহাস রয়েছে। ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে মজুরি বৈষম্য নিরসন, কর্মঘণ্টা নির্দিষ্টকরণ ও কাজের মানবিক পরিবেশের দাবিতে নিউইয়র্কে সুতা কারখানার নারী শ্রমিকেরা রাস্তায় নামলে সরকারি বাহিনীর বেপরোয়া দমন-পীড়ন চলে তাদের ওপর। অতঃপর নানান সংগ্রাম-আন্দোলনের পথ বেয়ে ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবসের মর্যাদাপ্রাপ্ত হয়।

দেশে দেশে নারীদের প্রতি যে বৈষম্য, নির্যাতন আর অবজ্ঞা-উপেক্ষা চোখে পড়ে তার বিরুদ্ধে গণমানুষের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি ও তাদেরকে প্রতিবাদী ভূমিকায় অবতীর্ণ করতে এই দিনটি যেন নারী জাগরণের অভয়বাণী বহন করে আনে। তাই এর আবাহন নিয়ত ও আবেদন শাশ্বত। নারীর সমঅধিকার আর মর্যাদা প্রতিষ্ঠার সংগ্রামী পথ পরিক্রমণে বাংলাদেশের নারীরাও তাত্পর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। আমাদের দেশে একদিকে যেমন সমাজের সর্বক্ষেত্রে নারীদের গৌরবময় সাফল্য ও অগ্রযাত্রা অব্যাহত থাকতে দেখা যায়, অন্যদিকে তেমনই আবার নারীদের প্রতি বৈষম্য আর নির্যাতন, অবিচার-অত্যাচারের চিত্রও কম চোখে পড়ে না। আমরা শিক্ষা-দীক্ষায়, মেধা-যোগ্যতায়, এমনকি রাষ্ট্র পরিচালনায়ও নারীদের যে অভাবিত সাফল্যজনক ভূমিকা পালন করতে দেখি, তা এক কথায় বিস্ময়কর। আবার যখন নারী নির্যাতন আর বৈষম্যের কালিমালিপ্ত চেহারাটি ফুটে উঠতে দেখা যায় তখন নারীর এই অগ্রযাত্রা অনেকটাই নিষ্প্রভ হয়ে পড়ে বৈকি। বলাবাহুল্য যে সমাজে নারীকে মানুষরূপে গণ্য করার চেতনা যতবেশি শক্তিশালী, সেই সমাজ ততো বেশি সভ্য এবং উন্নত। আমাদের নারী সমাজের সামনে বেগম রোকেয়ার ন্যায় প্রগতিশীল, আধুনিক, বিদ্যুষী ও সত্সাহসী এক মহীয়সী নারী আদর্শরূপে জ্বলজ্বল করছেন।

পাশ্চাত্যের নারীবাদী দর্শনের যে অংশ নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠা ও তার স্বাধীনতার নামে প্রকারান্তরে তাকে ফুটন্ত কড়াই থেকে জ্বলন্ত চুলায় নিক্ষেপ করছে, বাংলাদেশের নারীরা সে পথ নিশ্চয়ই মাড়িয়ে আগ্রহী নয়। তারা আমাদের সভ্যতা, কৃষ্টি ও ঐতিহ্য চেতনার সাথে সম্পৃক্ত পথ বেয়েই অভিষ্ট লক্ষ্যে উপনীত হতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকবে এটিই তো কাম্য। কবি যে বলেছেন, বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর, অর্ধেক তার করিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর এটা কি কেবলই কথার কথা? একটু তলিয়ে দেখলেই এই কথার সারবত্তা উপলব্ধি করা কঠিন নয়। নারীর কর্মনিষ্ঠা, সংস্কৃতি চেতনা আর অপত্য স্নেহ-মায়া-মমতা সুধায় জগত সংসারে এক অপার্থিব প্রেরণা সঞ্চারিত হয়। মানবজীবনে ও প্রকৃতিতে এই সুধারস সর্বত্রই প্রকটভাবে দৃশ্যমান। আর এই সারসত্যকে হৃদয়ঙ্গম করতে কারও কষ্ট হয় না নিশ্চয়ই। এখানে কর্মজীবনে নারী অনেক অনেক সাফল্যের স্বাক্ষর বহন করছে চলছে। নারীকে আপন ভাগ্য জয় করার অধিকার থেকে বঞ্চিত রাখার দিন বুঝি ফুরিয়ে আসছে। অবশ্য নারীর ওপর হিংসাশ্রয়ী ও পাশবিক নির্যাতন চালানোর মতো পরিস্থিতি এখনো সমাজের অভ্যন্তরে দগদগে ঘায়ের মতো চেপে বসে আছে। এই অপশক্তিকে দমন করতেই বিদ্রোহী কবি জাগো নারী জাগো বহ্নি শিখা বলিয়া তাদের জেগে ওঠার জন্য আহ্বান জানিয়েছেন। বাংলাদেশের নারীরা বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের মতো আত্মবলে বলিয়ান হয়ে বিশ্বসভায় নিজস্ব সভ্যতা সংস্কৃতির ধারায় নিজেদের আসন একদিন সুপ্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হবে অনায়াসে সে ভরসা করা যায় নিশ্চয়ই।