সাতই মার্চের অমর কবিতা

 

একটি ভাষণ একটি জাতির মানসে কতো গভীর ও সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলিতে পারে একাত্তরের সাতই মার্চের প্রেক্ষাপট সম্পর্কে যাদের যিকঞ্চিত্ ধারণা আছে, একমাত্র তাদের পক্ষেই তা সঠিকভাবে অনুধাবন করা সম্ভব। বাংলার ইতিহাসের অনন্য সেই সময়টিতে নেতার মহামূল্যবান ভাষণ শুনার জন্য যারা তত্কালীন রেসকোর্স ময়দানে সমবেত হয়েছিলেন এবং দেশের আনাচে-কানাচে যারা রেডিওর সামনে কান পেতে বসেছিলেন, সকলেই শুধু যে মন্ত্রমুগ্ধের মতো সেই ভাষণ শুনেছেন তাই নয়, কী এক অনির্বচনীয় আবেগে-উদ্দীপনায় আন্দোলিতও হয়েছেন সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো। কী প্রবল তার গর্জন! কী বিপুল তার শক্তিমত্তা! বাংলার নিরীহ নির্বিরোধ মানুষকে আশ্চর্য এক ঐক্যসূত্রে গ্রথিত করে ফেলেছিলো সেই ভাষণ। এটি সুবিদিত যে মুক্তিযুদ্ধের ঝঞ্ঝাক্ষুব্ধ চরম অনিশ্চিত সেই দিনগুলোতে জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের এই বজ্রকণ্ঠই আমাদের সাহস ও প্রেরণা জুগিয়েছে। এমনকি পঁচাত্তরের কালরাত্রি-পরবর্তী বিভীষিকাময় অন্ধকারেও এই ভাষণই বাতিঘরের মতো পথ দেখিয়েছে— উদ্দীপিত করেছে দিশাহারা বিপন্ন জাতিকে।

বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণটি ইতোমধ্যে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ভাষণগুলোর মধ্যে স্থান করিয়া লইয়াছে। দেশে-বিদেশে ভাষণটি লইয়া বিস্তর বিচার-বিশ্লেষণ হইয়াছে। ভবিষ্যতে আরও হবে। সন্দেহ নেই যে হাজার বছরের পরাধীনতার জোয়াল ছুড়ে ফেলে স্বাধীনতার সোনালি সোপানে উত্তরণের পথে এই ভাষণটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি মাইলফলক। এইখানে শিক্ষণীয় বহু কিছু রয়েছে যা রাজনীতি যারা করেন তাদের জন্য তো বটেই, এমনকি জাতিরও চিরকালের সম্পদ হিসাবে বিবেচিত হতে পারে। বস্তুত সংগঠন ও নেতৃত্বের ক্যারিশমা তথা জাদুকরি ক্ষমতার সফল মিথস্ক্রিয়ার একটি অভূতপূর্ব প্রদর্শনী ছিলো সাতই মার্চ। মনে রাখতে হবে যে, ভাষণটি শুরু হওয়ার আগেই জনসমুদ্রে পরিণত হয়েছিলো রেসকোর্স ময়দান। শুধু যে যার যা কিছু ছিলো তা নিয়েয়া দূর-দূরান্ত থেকে ছুটে এসেছিলো সর্বস্তরের মানুষ তাই নহে, সারা দেশের মানুষও অধীর আগ্রহে অপেক্ষমাণ ছিলো এই ভাষণটি শোনার জন্য। এর অর্থ হলো- জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করার দুরূহ কাজটি আগেই সাধিত হয়ে গিয়েছিলো বঙ্গবন্ধুর জাদুকরি নেতৃত্বে। আর জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করা গেলে যে অসম্ভবকেও সম্ভব করা যায়— তাও আমরা প্রত্যক্ষ করেছি মুক্তিযুদ্ধের রক্তস্নাত সেই দিনগুলোতে। সাতই মার্চের ভাষণ জনগণের সেই ঐক্যে নতুন মাত্রা যোগ করেছিলো। জনতার হৃদয়ের কথা মূর্ত হয়ে উঠেছিলো বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠে। আর কে না জানেন যে মানুষ কী চায়— সেইটাকে যিনি যত সফলভাবে ভাষা দিতে পারেন তিনি ততো বড়ো নেতা।

স্বাধীনতার আগেই বঙ্গবন্ধু পোয়েট অব পলিটিক্স বা রাজনীতির কবি অভিধা পেয়েছিলেন। এই নিরিখে সাতই মার্চের ভাষণকে বিবেচনা করা যায় তার রচিত একটি অমর কবিতা হিসাবে— যা আমাদের মুক্তিযুদ্ধে যেমন প্রেরণা জুগিয়েছে, তেমনি ভবিষ্যতেও প্রেরণার অবিনাশী উত্স হয়ে থাকবে।