ইবিতে ইউনিট সমন্বয়কারীর মাধ্যমে প্রশ্ন ফাঁস শিক্ষক-ছাত্রসহ বহিষ্কার ৪

ইবি প্রতিনিধি: কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক (সম্মান) প্রথম বর্ষের ভর্তি পরীক্ষার এফ ইউনিটের প্রশ্নপত্র ফাঁসের সত্যতা পাওয়ায় ওই ইউনিটের ভর্তি বাতিল করা হয়েছে। নতুন করে ওই ইউনিটের পরীক্ষা নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। তাছাড়া এ ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষককে সাময়িক বহিষ্কার, দুজন শিক্ষককে পরীক্ষা সংক্রান্ত দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি ও স্নাতকোত্তর বিভাগের এক শিক্ষার্থীর ছাত্রত্ব এবং স্নাতক শ্রেণির সনদ বাতিল করা হয়েছে। সোমবার সন্ধ্যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হারুন অর রশীদ আসকারী এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। এর আগে বেলা ১১টার দিকে উপাচার্যের বাসভবনের মিলনায়তনে সিন্ডিকেট সভার আয়োজন করা হয়। বিকেল চারটায় সভা শেষে সেখানে উপাচার্য সংবাদ সম্মেলন করেন।

উপাচার্য হারুন অর রশীদ আসকারী বলেন, ২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষের ফলিত বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি অনুষদভুক্ত এফ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা আবারও নেয়া হবে। সে সময় যারা আবেদন করেছিলেন, শুধু তারাই এই পরীক্ষায় অংশ নিতে পারবেন। দ্রুত এ ব্যাপারে সংবাদমাধ্যমে বিজ্ঞপ্তি দেয়া হবে। বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা যায়, গত বছরের ৭ ডিসেম্বর বিজ্ঞান অনুষদভুক্ত এফ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। ভর্তি পরীক্ষার আগেই ওই ইউনিটের উত্তরপত্র ফাঁস হয়ে যায়। সংশ্লিষ্ট ইউনিট সমন্বয়কারী সহকারী অধ্যাপক নুরুল ইসলামের মাধ্যমে উত্তরপত্র বাইরে চলে যায়। এ ঘটনা তদন্তে গত ২৫ জানুয়ারি গণিত বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. এসএম মোস্তফা কামালকে আহ্বায়ক করে তিন সদস্যবিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। কমিটি গত শনিবার সাত পৃষ্ঠার একটি প্রতিবেদন জমা দেয়। তদন্তে প্রশ্ন ফাঁসের বিষয়টি প্রমাণিত হয় এবং এ ঘটনার সাথে সংশ্লিষ্ট ইউনিট সমন্বয়কারী ও গণিত বিভাগের সভাপতি সহকারী অধ্যাপক নুরুল ইসলাম, একই বিভাগের মাস্টার্সের ছাত্র মনোজিত কুমার, বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাব শাখার সিনিয়র অডিটর সাইফুল ইসলাম, কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের ফটোকপি অপারেটর আলাউদ্দিন আলাল ও স্থানীয় পল্লি চিকিৎসক মিজানুর রহমান লাল্টুর সম্পৃক্ততার প্রমাণ পাওয়া যায়। এ ঘটনায় সহকারী অধ্যাপক নুরুল ইসলাম, কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম ও কর্মচারী আলাউদ্দিন আলালকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়েছে। একই ঘটনায় গণিত বিভাগের শিক্ষার্থী মনোজিত কুমারের ছাত্রত্ব ও সনদ বাতিল করা হয়েছে। এছাড়া পল্লি চিকিৎসক মিজানুর রহমান লাল্টুর বিরুদ্ধে ফৌজদারি কার্যবিধি অনুয়ায়ী ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সুপারিশ করেছে বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেট। এছাড়া ভর্তি পরীক্ষা বাতিল করে নতুন করে নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। সোমবার বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৩৩তম সিন্ডিকেট সভায় এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।

যেভাবে প্রশ্ন ফাঁস হলো: তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, ভর্তি পরীক্ষার এক মাসে আগে থেকেই এই চক্রটি পরীক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকদের সাথে যোগাযোগ শুরু করে। স্থানীয় পল্লি চিকিৎসক লাল্টুর মেয়ে জান্নাতুল ফেরদৌস শিপ্রা (এফ ইউনিটে মেধা তালিকায় তিন) কুষ্টিয়ার কাটাইখানা মোড়ে অবস্থিত আন্তরিক কোচিং সেন্টারে ভর্তি হয়। সে কোচিং থেকে বেশির ভাগ শিক্ষার্থী সংগ্রহ করে। কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম, কর্মচারী আলাউদ্দিন আলাল ও গণিত বিভাগের ছাত্র মনোজিত কুমার বাকি শিক্ষার্থীদের সংগ্রহ করে। পরীক্ষার রাতে মনোজিতকে উত্তরপত্র সরবরাহ করেন এফ ইউনিটের সমন্বয়কারী ও গণিত বিভাগের সভাপতি সহকারী অধ্যাপক নুরুল ইসলাম। পরীক্ষার দিন শিক্ষার্থীদের উত্তরসহ প্রশ্ন সরবরাহ করা হয়। তদন্ত কমিটির সদস্য ও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. মাহবুবর রহমান বলেন, অতি কৌশলে বিভাগীয় সভাপতি ও ওই বিভাগের শিক্ষার্থীর সম্পৃক্ততার প্রমাণ পাওয়া যায়। তিনি বলেন, মনোজিতকে ফোন করে বলা হয়-তুমি শুধু বলো তোমাকে প্রশ্ন কে দিলো? তবে কোন ইউনিটের প্রশ্ন বলা হয়নি। পরে কল রেকর্ড সংগ্রহ করে জানা যায়, আমার কাছ থেকে ফোন পাওয়ার পর সে প্রথমে শিক্ষক নুরুল ইসলামের কাছে ফোন করে। এরপর থেকে মনোজিতের ফোন খোলা পাওয়া যায়নি। তিনি আরও বলেন, মনোজিতের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের যে উত্তরপত্র সরবরাহ করা হয়েছিলো তা ইউনিট সমন্বয়কারী হিসেবে নুরুল ইসলামের কাছে থাকার কথা। তার কাছ থেকে বিভাবে উত্তরপত্র বাইরে এলো তা প্রশ্ন ছিলো। পরে ইউনিট সমন্বয়কারী ও বাকি সদস্যদের একসাথে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। এসময় দেখা যায়, উত্তরপত্রের খাম খোলা এবং তাতে শুধু সমন্বয়কারীর স্বাক্ষর আছে। ইউনিট সমন্বয়কারীর এর ব্যাখ্যা দিতে পারেননি। জিজ্ঞাসাবাদের এক পর্যায়ে তিনি তার দায় স্বীকার করেন। ড. মাহবুরর রহমান আরও বলেন, এফ ইউনিটে ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীদের আগের প্রশ্ন ও সমমনা প্রশ্নে পরীক্ষা নেয়া হয়েছিলো। উত্তরপত্র মূল্যায়নে দেখা যায়, উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শিক্ষার্থী গণিতে কেউ শূন্য ও ৫ এর বেশি পাইনি। অথচ তারা ভর্তি পরীক্ষায় গণিত অংশে ৬০ এর মধ্যে ৫০ পেয়েছিলো। সাক্ষাতকারের শিক্ষার্থীদের এসব ব্যাপারে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে তারা এক পর্যায়ে প্রশ্ন ফাঁসের বিষয়টি বলে দেয়।

গতকাল সোমবার বেলা ১১টা থেকে বিকাল চারটা পর্যন্ত সিন্ডিকেট সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভা শেষে বিকাল সাড়ে চারটার দিকে সংবাদ সম্মেলন করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। সংবাদ সম্মেলনে উপাচার্য বলেন, প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় ওই ইউনিটের পরীক্ষা সমন্বয়কারী গণিত বিভাগের শিক্ষক নুরুল ইসলামকে বরখাস্ত করা হয়েছে। এ ব্যাপারে তাকে কেন স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করা হবে না তা জানতে চেয়ে নোটিশ দেয়া হবে। এছাড়া সমন্বয়কারীর সহযোগী হিসেবে গণিত বিভাগের শিক্ষক মিজানুর রহমান ও পরিসংখ্যান বিভাগের সভাপতি আলতাফ হোসেনকে দায়িত্বে অবহেলার কারণে আগামী দুই বছর পরীক্ষাসংক্রান্ত সব দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। এছাড়া এ ঘটনায় গণিত বিভাগের স্নাতকোত্তর শ্রেণির শিক্ষার্থী মনোজিৎ কুমারের ছাত্রত্ব ও স্নাতকের সনদ বাতিল করা হয়েছে।

তদন্ত প্রতিবেদন সূত্রে আরও জানা যায়, শিক্ষার্থীরা দেড় থেকে আড়াই লাখ টাকায় প্রশ্ন কিনে নেন। ফলাফল প্রকাশিত হলে অভিযুক্তরা স্থানীয়দের বাসায় গিয়ে টাকা আদায় করেন। এছাড়া বাইরের শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাস পার্শ্ববর্তী শেখপাড়ায় এসে টাকা দিয়ে যান। ভর্তি হওয়া অন্তত ৭০ ভাগ শিক্ষার্থী ফাঁস হওয়া প্রশ্নের মাধ্যমে চান্স পেয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।

 

Leave a comment