বাসচালকের দণ্ড এবং পরিবহন শ্রমিক ধর্মঘট

সকলে মানুষ হলেও সকল মানুষ যেমন সমান নয়, তেমনই সব ঘটনাও দুর্ঘটনা নয়। চুয়াডাঙ্গা ডিলাক্স পরিবহনের চালক জামির হোসেন জমিরের যাবজ্জীবন কারাদ-াদেশ দেয়ার পর প্রসঙ্গটি দেশজুড়েই প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। কতো মানুষই তো দুর্ঘটনায় প্রাণ হারাচ্ছে, বৈধ-অবৈধ যানের কতো আনাড়ি চালক হরহামেশাই প্রাণ কেড়ে নিচ্ছে। এর মাঝে দূরপাল্লার বাসচালক জামির হোসেন জমিরের দ- যেমন দুর্ঘটনারোধে সহায়ক হবে বলে অনেকের অভিমত, তেমনই শ্রমিকদের ভিন্নমত। তাদের যুক্তি, আমরা যাবজ্জীবন কারাদ- নিয়ে রাস্তায় গাড়ি চালাবো না। এ যুক্তিতে ধর্মঘট অব্যাহত রেখেছে। প্রথমে চুয়াডাঙ্গা জেলার মধ্যে এ ধর্মঘট সীমিত থাকলেও পরবর্তীতে খুলনা বিভাগের ১০ জেলায় শুরু হয়। মঙ্গলবার থেকে শুরু হয়েছে সারাদেশে।
অবশ্যই চলচ্চিত্র নির্মাতা ও একটি নিউজ চ্যানেলের প্রধান নির্বাহী সকল মানুষের মতো নয়। এদের বহন করা মাইক্রোবাসের সাথে চুয়াডাঙ্গা-ঢাকা রুটে চলাচলকারী চুয়াডাঙ্গা ডিলাক্সের সংঘর্ষ হয়। চলচ্চিত্র নির্মাতা তারেক মাসুদ ও চ্যানেলের প্রধান নির্বাহী মিশুক মুনীরসহ ৫ জন নিহত হন। এ ঘটনায় মামলা হয়। বাসচালক ও কোচ মালিকপক্ষের দাবি, ঘটনাটি ছিলো দুর্ঘটনা। কিন্তু মামলার বাদীপক্ষের যুুক্তি ওটা দুর্ঘটনা নয়, অনিচ্ছাকৃত খুন। যে খুনের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে বাস। তাছাড়া কোচের এবং চালকের কিছু অনিয়মও আদালতে প্রমাণিত হয়েছে। অনিচ্ছাকৃত খুনের বিষয়টি আদালতে বাদীপক্ষ প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছেন বলেই বোধকরি আইনের দৃষ্টিতে চালককে যাবজ্জীবন কারাদ-াদেশ দেয়া হয়েছে। আইনের দৃষ্টিতে আদালতের আদেশ আইনগতভাবেই চ্যালেঞ্জ করার সুযোগ আছে। তাহলে ধর্মঘট কেন? এ ধর্মঘটকে সড়ক যোগাযোগ ও সেতুমন্ত্রী অযৌক্তিক বলে দাবি করে অবিলম্বে প্রত্যাহারের আহ্বান জানিয়েছেন। অপরদিকে নৌপরিবহন মন্ত্রী বলেছেন, পরিবহন শ্রমিকরা ধর্মঘট নয়, স্বেচ্ছায় অবসরে পরিবহন শ্রমিকরা। যে যাই বলুক, যার যুক্তি যেমনই হোক। পরিবহন ধর্মঘটের কারণে জনদুর্ভোগ চরমে পৌছেছে। ফলে সমাধানের পথ খুঁজতে হবে। সড়ক দুর্ঘটনা যে হারে বেড়েছে তা রোধে আবেগতাড়িত হওয়ার চেয়ে বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ নিতে হবে। এমন কোনো যুক্তি নেই যে, সড়ক দুর্ঘটনা মেনে নেয়া যায়। যদিও সড়ক দুর্ঘটনার দায় বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই হয় উভয় বা বহুপক্ষীয়। আমাদের অধিকাংশ রাস্তাই অপ্রশস্ত। অবৈধ স্থাপনা প্রকাশ্যে নির্মাণ হলেও আইনের প্রয়োগ নেই। চুয়াডাঙ্গা-মেহেরপুর সড়কের ভালাইপুর মোড়েই তার অন্যতম উদাহরণ। নিয়মিত সংস্কার হয় না বহু সড়ক-মহাসড়ক। বেশির ভাগ সড়কের মোড়, গতিরোধক ও ডিভাইডার প্রভৃতি ঝুঁকিপূর্ণ স্থানেই সড়ক নির্দেশনা বা রোডসাইন নেই। অস্বীকার করার জো নেই যে, অনেক চালক গাড়ি চালান বেপরোয়াভাবে। অযথাই ওভারটেকিংয়ের প্রতিযোগিতা করেন। চালকদের অনেকেই বেশি বেশি ট্রিপ দিতে গিয়ে যেমন বিশ্রামের সুযোগ পান না, তেমনই একটি বাসের অধিক খ্যাপের জন্যও বেপরোয়া গতিতে চালাতে হয় কোনো কোনো চালকের। তাছাড়া লক্কড়ঝক্কড় তথা ত্রুটিপূর্ণ যানবাহনও সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ। সর্বোপরি যাত্রী ও পথচারীদের অসচেতনতার কারণেও অনেক সময় ঘটে থাকে ভয়াবহ সড়ক দুর্ঘটনা। সুতরাং চালক দক্ষ হলেও সামগ্রিক অব্যবস্থা ও অসতর্কতার কারণেও দুর্ঘটনা ঘটতে সময় লাগে না।
সড়কে দুর্ঘটনারোধে কার্যকর সমাধানের বাস্তবমুখি পথ খুঁজতে হবে। দেশজুড়ে শুরু হওয়া অনির্দিষ্টকালের পরিবহন শ্রমিক ধর্মঘট যতোই দীর্ঘ হবে দুর্ভোগ ততোই বাড়বে। যোগাযোগ ব্যবস্থায় স্থবিরতা নেমে আসা অবশ্যই সরকারের ব্যর্থতা। সপ্তাহজুড়ে চুয়াডাঙ্গায় পরিবহন ধর্মঘটের কারণে ট্রেনের ওপর চাপ বেড়েছে। অথচ বাড়তি ট্রেনের ব্যবস্থা করা হয়নি। এ অবস্থায় যদি ধর্মঘটের সময়সীমা বাড়তেই থাকে তাহলে সর্বস্তরে জীবনযাত্রায় বিরূপ প্রভাব পড়তে বাধ্য। ইতোমধ্যেই ডিজেল সংকটের কারণে আবাদে সেচকাজ ব্যাহত হচ্ছে। বাড়ছে ক্ষোভ। যেকোনো সমস্যা সমাধানের অন্যতম ও প্রধান পথ আলোচনা। আলোচনার মাধ্যমেই সমস্যা সমাধানের পথ খুঁজে পরিস্থিতি যতো দ্রুত স্বাভাবিক করা সম্ভব হবে ততোই মঙ্গল।