তত্ত্বাবধায়ক ছেড়ে সহায়ক সরকার ফর্মুলায় বিএনপি : মার্চে রূপরেখা উপস্থাপন করতে পারেন খালেদা জিয়া

 

স্টাফ রিপোর্টার: নির্বাচনকালীন ‘নির্দলীয়-নিরপেক্ষ’ বা ‘তত্ত্বাবধায়ক’ সরকার পদ্ধতির দীর্ঘদিনের দাবি থেকে কার্যত সরে এসেছে বিএনপি। তত্ত্বাবধায়কের বদলে এখন ‘নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকার’-এর ফর্মুলা সামনে আনতে যাচ্ছে দলটি। এ নিয়ে দলের ভেতর-বাইরের অভিজ্ঞ ও বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে গঠিত একটি কমিটি ইতোমধ্যে কাজ শুরু করেছে।

দলটির দায়িত্বশীল একাধিক নেতা জানান, সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে মার্চের মধ্যেই সহায়ক সরকারের রূপরেখা জাতির সামনে উপস্থাপন করতে পারেন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। তত্ত্বাবধায়ক থেকে সহায়ক সরকার ব্যবস্থায় প্রত্যাবর্তন সম্পর্কে বিএনপির স্থায়ী কমিটির তিনজন সদস্যের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিদ্যমান সাংবিধানিক ব্যবস্থা, উদ্ভূত রাজনৈতিক বাস্তবতা, আঞ্চলিক রাজনীতির প্রেক্ষাপট ও দলের সাংগঠনিক সক্ষমতা বিবেচনায় নিয়েই সহায়ক সরকার ব্যবস্থার বিষয়টি সামনে আনা হচ্ছে। তাদের মতে, তত্ত্বাবধায়ক বা সহায়ক সরকার এখানে মুখ্য নয়, ‘যে কোনো ব্যবস্থা’য় সকল রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণে অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ এবং দেশে ও আন্তর্জাতিক মহলে গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি আদায় করাই প্রধান লক্ষ্য। ‘সংশোধিত’ এই দাবি আদায়ে নতুন করে আন্দোলনে যাওয়া না যাওয়া এবং আগামী সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতিসহ একাধিক বিকল্প নিয়ে দলে চিন্তাভাবনা চলছে বলেও তারা জানান।

জানা গেছে, সব দলের অংশগ্রহণে সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবি আদায়ে আন্দোলনের বদলে সরকারপক্ষের সঙ্গে সমঝোতাকেই বেশি প্রাধান্য দিচ্ছে বিএনপি। দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদের বক্তব্যেও সেই ইঙ্গিত স্পষ্ট। গতকাল শনিবার ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে মওদুদ আহমদ বলেছেন, বিএনপি শান্তিপূর্ণভাবে আলাপ আলোচনা, সমঝোতার মাধ্যমে রাজনৈতিক সঙ্কট নিরসন করতে চায়। তা সম্ভব না হলে আন্দোলন ছাড়া বিকল্প থাকবে না। তার মতে, নির্বাচন কমিশন বা নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকার বড় কথা নয়। গণতান্ত্রিক পরিবেশ বজায় রাখতে হবে। সব নেতা-কর্মীর নামে থাকা মামলা প্রত্যাহার করে নিতে হবে। তাহলে বোঝা যাবে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের সম্ভাবনা আছে। গণতান্ত্রিক পরিবেশের জন্য বিএনপি আন্দোলন চিন্তার সমান্তরালে নির্বাচনের প্রস্তুতিও নেবে বলে তিনি জানান ।

নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের রূপরেখার বিষয়ে জানা গেছে, বিএনপির স্থায়ী কমিটির একাধিক সদস্য, দল সংশ্লিষ্ট একাধিক বুদ্ধিজীবী, দেশ-বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক এবং নির্বাচন বিষয়ে আন্তর্জাতিকভাবে অভিজ্ঞ-এমন কয়েকজন এই রূপরেখা প্রণয়নে কাজ করছেন। বিদ্যমান সাংবিধানিক কাঠামোর ভেতরে থেকেই, নাকি এর বাইরে গিয়ে এই রূপরেখা তৈরি করা হচ্ছে-সে বিষয়ে এখনও চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। তবে একাধিক বিকল্প নিয়ে ভাবছেন রূপরেখা প্রণয়নের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা। কারো মতে, বিদ্যমান সংবিধানের ভেতরে থেকেই নিরপেক্ষ সহায়ক সরকার গঠন সম্ভব, কারও মতে-দলনিরপেক্ষ সহায়ক সরকার ব্যবস্থা করতে হলে সংবিধান সংশোধন ছাড়া সম্ভব নয়। দলের ভেতর থেকেই কেউ যুক্তি দিচ্ছেন- প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে স্বপদে রেখেও সহায়ক সরকার গঠন সম্ভব। সেক্ষেত্রে নির্বাচনকালীন সময়ে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার বিষয়ে কিছু সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব দেয়া যেতে পারে। দলের একটি সূত্র জানায়, এমনও হতে পারে-নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকার প্রধানের বিষয়ে আপাতত স্পষ্ট কিছু না বলেই রূপরেখা উপস্থাপন করা হবে। নির্বাচন সামনে এলে সম্পূরক প্রস্তাব আকারে সহায়ক সরকারের প্রধানের বিষয়টি খোলাসা করা হতে পারে।

এ ব্যাপারে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন গতকাল বলেন, ‘সময়মতো সহায়ক সরকারের রূপরেখা দেওয়া হবে। রূপরেখার এখনও কোনো ফরমেট দাঁড়ায়নি।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘সহায়ক সরকারের রূপরেখায় কি থাকবে কি থাকবে না-তা নিয়ে যেসব লেখালেখি ও বলাবলি হচ্ছে সেগুলো মূলত ধারণাগত।’

উল্লেখ্য, নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের কথাটি সামনে এনেছিলেন খোদ খালেদা জিয়া নিজেই। নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনকে সামনে রেখে গত বছরের নভেম্বরে বিএনপি চেয়ারপারসন জাতির সামনে যে ১৩ দফা প্রস্তাবনা দিয়েছিলেন, তাতে তিনি বলেন, ‘শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন ও নির্বাচনকালীন একটি সহায়ক সরকার ছাড়া দেশে অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। বিএনপির পক্ষ থেকে যথা শিগগির সম্ভব সহায়ক সরকারের রূপরেখা উপস্থাপন করা হবে।’

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জানান, সহায়ক সরকারের রূপরেখা প্রণয়ন নিয়ে কাজ চলছে। কাজ শেষে দলের চেয়ারপারসন আনুষ্ঠানিকভাবে সেটি জাতির সামনে পেশ করবেন। বিএনপির চিন্তক হিসেবে পরিচিত কয়েকজনের সঙ্গে গতকাল পৃথকভাবে কথা বলে জানা গেছে, নির্দলীয় ও অনির্বাচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংবিধানে ফিরিয়ে আনতে বর্তমান সরকারকে সম্মত করা যাবে না, আন্দোলনের মাধ্যমে সরকারকে সম্মত করাতে প্রয়োজনীয় সাংগঠনিক শক্তিও নেই-এই বাস্তবতা উপলব্ধি করেই সহায়ক সরকারের রূপরেখা দিতে যাচ্ছে বিএনপি।

প্রসঙ্গত, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের পরপর দুই মেয়াদে প্রায় পাঁচ বছর ধরে আন্দোলন করা এবং নিজ দাবিতে অটল থেকে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জনকারী খালেদা জিয়া ২০১৫ সালের ২৫ জুলাই বলেছেন, ‘আমি বলবো না, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনেই আগামী নির্বাচন হতে হবে। যে নামেই হোক, একটি নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে সব দলের অংশগ্রহণে আমরা সুষ্ঠু জাতীয় নির্বাচন চাই।’

এদিকে বিএনপি সূত্রে জানা গেছে, সহায়ক সরকারের রূপরেখা বাস্তবায়নের দাবি আদায়ের লক্ষ্যে কর্মসূচি প্রণয়ন ও আগামী নির্বাচনের প্রস্তুতি শুরুর আগে আগে দলকে সংগঠিত করারও উদ্যোগ রয়েছে। বিশেষ করে, বিভিন্ন সময়ে দল ছেড়ে যাওয়া নেতাদের মধ্যে যাদের ইতিবাচক ভাবমূর্তি রয়েছে এবং নানা কারণে যারা দীর্ঘদিন ধরে দল থেকে দূরে সরে আছেন-তাদেরকে দলে ফেরানোর ও সক্রিয় করার কার্যক্রম হাতে নেওয়া হয়েছে। যার অংশ হিসেবে দীর্ঘদিন দল থেকে দূরে সরে থাকা দুই নেতা- জহির উদ্দিন স্বপন ও সরদার সাখাওয়াত হোসেন বকুলকে শুক্রবার ডেকে দীর্ঘক্ষণ কথা বলেছেন খালেদা জিয়া। জানা গেছে, ওয়ান-ইলেভেনের সময় ‘সংস্কারপন্থি’ হিসেবে পরিচিতি পাওয়া এই দুই নেতাকে দলে সক্রিয় হওয়ার পাশাপাশি কিছু দিক-নির্দেশনাও দিয়েছেন বিএনপি প্রধান।

এ ছাড়া বিএনপির প্রতিষ্ঠাকালীন মহাসচিব অধ্যাপক এ.কিউ.এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী এবং দলের স্থায়ী কমিটির দীর্ঘদিনের প্রাক্তন সদস্য ড. কর্নেল অলি আহমদকে (অব.) দলে ফিরিয়ে আনারও নতুন করে উদ্যোগ নিতে যাচ্ছে বিএনপি। তাদের সঙ্গে কথা বলার জন্য বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া একবার দায়িত্ব দিয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক এমাজউদ্দিন আহমাদ ও চেয়ারপাসনের উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেনকে। সেই উদ্যোগের তেমন অগ্রগতি না হওয়ায় নতুন করে পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে বলে জানা গেছে।