স্টাফ রিপোর্টার: ২০টি দেশীয় ওষুধ কোম্পানির সব ধরনের ওষুধ উত্পাদন বন্ধই থাকছে। সেইসাথে আরও ১৪ কোম্পানি কোনো ধরনের (নন-পেনিসিলিন, পেনিসিলিন ও সেফালোস্পোরিন গ্রুপ) এন্টিবায়োটিক ওষুধ উত্পাদন করতে পারবে না। ওষুধ উত্পাদনের ক্ষেত্রে এসব কোম্পানি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গুড ম্যানুফ্যাকচারিং প্র্যাকটিস (জিএমপি) নীতিমালা যথাযথভাবে অনুসরণ না করায় হাইকোর্ট এ রায় ঘোষণা করেছে। বিচারপতি সৈয়দ মোহাম্মদ দস্তগীর হোসেন ও বিচারপতি মো. আতাউর রহমান খানের ডিভিশন বেঞ্চ গতকাল সোমবার এই রায় দেন।
যে ২০ কোম্পানি কোনো ওষুধ উত্পাদন করতে পারবে না সেগুলো হচ্ছে- এক্সিম ফার্মাসিউটিক্যাল, এভার্ট ফার্মা, বিকল্প ফার্মাসিউটিক্যাল, ডলফিন ফার্মাসিউটিক্যাল, ড্রাগল্যান্ড লিমিটেড, গ্লোব ল্যাবরেটরিজ (প্রা.), জলপা ল্যাবরেটরিজ, কাফমা ফার্মাসিউটিক্যাল, মেডিকো ফার্মাসিউটিক্যাল, ন্যাশনাল ড্রাগ ফার্মা, নর্থ বেঙ্গল ফার্মাসিউটিক্যাল, রেমো কেমিক্যাল, রিড ফার্মাসিউটিক্যাল, স্কাইল্যাব ফার্মাসিউটিক্যাল, স্পার্ক ফার্মাসিউটিক্যাল, স্টার ফার্মাসিউটিক্যাল, সুনিপুণ ফার্মাসিউটিক্যাল, টুডে ফার্মাসিউটিক্যাল, ট্রপিক্যাল ফার্মাসিউটিক্যাল এবং ইউনিভার্সেল ফার্মাসিউটিক্যাল লিমিটেড।
আর এন্টিবায়োটিক উত্পাদন করতে পারবে না যে ১৪ কোম্পানি সেগুলো হচ্ছে- আদ-দ্বীন ফার্মাসিউটিক্যাল, আলকাদ ল্যাবরেটরিজ, বেলসেন ফার্মাসিউটিক্যাল, বেঙ্গল ড্রাগস, ব্রিস্টল ফার্মা, ক্রাইস্ট্যাল ফার্মাসিউটিক্যাল, ইন্দো-বাংলা ফার্মাসিউটিক্যাল, মিল্লাত ফার্মাসিউটিক্যাল, এমএসটি ফার্মা অ্যান্ড হেলথ কেয়ার, অরবিট ফার্মাসিউটিক্যাল, ফার্মিক ল্যাবরেটরিজ, ফনিক্স কেমিক্যাল, রাসা ফার্মাসিউটিক্যাল এবং সেভ ফার্মাসিউটিক্যাল লিমিটেড।
এদিকে সংসদীয় স্থায়ী কমিটি কর্তৃক গঠিত বিশেষজ্ঞ তদন্ত কমিটি তাদের প্রতিবেদনে আরও ২৮ ওষুধ কোম্পানির নাম উল্লেখ করেছিলো যারা জিএমপি নীতিমালা না মেনে এন্টিবায়োটিক, স্টেরয়েড, হরমোন, এন্টিক্যান্সারসহ বিভিন্ন জীবন রক্ষাকারী ওষুধ উত্পাদন করছে। কিন্তু কোম্পানিগুলোর কারখানায় এ ধরনের ওষুধ তৈরির উপযুক্ত প্রযুক্তি দেখতে পায়নি তদন্ত কমিটি। বিশেষজ্ঞদের মতে, অনুপযুক্ত পরিবেশে যেনতেনভাবে এ ধরনের ওষুধ উত্পাদন ও বাজারজাত করে স্বাস্থ্যসেবাকে ঝুঁকির মুখে ফেলে দিয়েছে এরা। এই ২৮টি কোম্পানির বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে যথাযথ আইনগত পদক্ষেপ নেয়া উচিত বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। বিশেষজ্ঞদের অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের কতিপয় দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা তদারকির নামে ওই সব নিম্নমানের ও ভেজাল ওষুধ উত্পাদনকারী প্রতিষ্ঠান থেকে নিয়মিত মাসোহারা পেতেনে। কোনো কোনো কর্মকর্তা ওইসব কোম্পানির পরামর্শক হিসেবেও অলিখিতভাবে দায়িত্ব পালন করতেন। বিনিময়ে পেতেন মোটা অঙ্কের মাসিক সম্মানি।
বাংলাদেশ ওষুধ শিল্প সমিতির মহাসচিব শফিউজ্জামান বলেন, আমরা সুনামের সাথে ১২৭ দেশে ওষুধ রফতানি করে আসছি। ২৮৭ ওষুধ কোম্পানির মধ্যে যারা নিম্ন মানের ওষুধ তৈরি করে আন্তর্জাতিক বাজারে আমাদের সুনাম নষ্ট করছে তাদের বিরুদ্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা নেয়া হোক—এটাই আমাদের দাবি। আদালত ৩৪ কোম্পানির ওষুধ উত্পাদন বন্ধ রাখতে যে রায় দিয়েছে তা যুগান্তকারী। এ রায় নিম্নমানের ও ভেজাল ওষুধ উত্পাদনকারীদের জন্য বড় সতর্ক বার্তা। এ রায়ের বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানতে ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের মহাপরিচালক ও দফতরের মুখপাত্রকে একাধিকবার ফোন করলেও তারা ফোন রিসিভ করেননি।
গতকাল দেয়া রায়ে আদালত বলেছেন, নিষেধাজ্ঞাপ্রাপ্ত ৩৪ কোম্পানির মধ্যে যারা ইতিমধ্যে জিএমপি পেয়েছে বলে দাবি করেছে তাদের বিষয়টি বিবেচনা করতে ৫ সদস্যের কমিটি গঠন করে দেয়া হলো। কমিটির প্রধান হবেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার একজন প্রতিনিধি। এই কমিটি জিএমপি লাইসেন্স এর সুপারিশ করলে ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর তা বিবেচনা করবে। ওই কমিটির সদস্য হিসেবে থাকবেন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর, সংসদীয় কমিটি কর্তৃক গঠিত বিশেষজ্ঞ কমিটির একজন করে প্রতিনিধি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি বিভাগের একজন শিক্ষক।
প্রসঙ্গত, ইতঃপূর্বে হাইকোর্টের অন্তর্বর্তীকালীন আদেশের পরিপ্রেক্ষিতে ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর ২০ কোম্পানির মধ্যে ১১ কোম্পানির লাইসেন্স বাতিল করে দেয়। হাইকোর্টের রায়ে লাইসেন্স বাতিলের ওই সিদ্ধান্ত বহাল রাখা হয়েছে। পাশাপাশি বাকি ৯ কোম্পানির সকল ওষুধ (এন্টিবায়োটিক, স্টেরয়েড, হরমোন, এন্টিক্যান্সারসহ সব ধরনের জীবন রক্ষাকারী ওষুধ) উত্পাদনও বন্ধ রাখার নির্দেশও বহাল রেখেছে আদালত। এই ৯ কোম্পানি হলো গ্লোব ল্যাবরেটরিজ, মেডিকো ফার্মাসিউটিক্যাল, এভার্ট ফার্মা, বিকল্প ফার্মাসিউটিক্যাল, স্পার্ক ফার্মাসিউটিক্যাল, স্টার ফার্মাসিউটিক্যাল, ট্রপিক্যাল ফার্মাসিউটিক্যাল ও স্কাইল্যাব ফার্মাসিউটিক্যাল।
২০১৪ সালের ২০ সেপ্টেম্বর ভেজাল এবং নিম্নমানের ওষুধ উত্পাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো চিহ্নিত করতে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি ৫ সদস্যের একটি বিশেষজ্ঞ তদন্ত কমিটি গঠন করে দেয়। এই কমিটির প্রধান করা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগের অধ্যাপক আবম ফারুককে। উক্ত তদন্ত কমিটি দেশের ৮৪ ওষুধ কারখানা পরিদর্শন করেন। এর মধ্যে ছিলো নতুন ১৫ এবং পুরনো ৬৯ প্রতিষ্ঠান। দীর্ঘ তদন্ত শেষে গত বছরের ১ ফেব্রুয়ারি কমিটি তাদের প্রতিবেদন সংসদীয় কমিটির কাছে জমা দেয়। প্রতিবেদনে ২০ কোম্পানির ওষুধ উত্পাদন বন্ধ ও লাইসেন্স বাতিলের সুপারিশ করে।
গত বছর ২১ এপ্রিল ‘জীবন রক্ষাকারী ওষুধে ভেজাল’ শিরোনামে এক জাতীয় দৈনিকে বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। সেখানে ওই ২০ কোম্পানির ওষুধে ভেজাল সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য উপস্থাপন করা হয়। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, সংসদীয় স্থায়ী কমিটি কর্তৃক গঠিত বিশেষজ্ঞ কমিটি এসব কোম্পানির ওষুধ উত্পাদন ও লাইসেন্স বাতিলের সুপারিশ করে। কিন্তু দীর্ঘ দিনেও কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়ন করেনি সরকার।
এ পরিস্থিতিতে হাইকোর্টে রিট দায়ের করেন ‘হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ’র পক্ষে অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ। ওই রিটের প্রেক্ষিতে গত বছরের ৭ জুন হাইকোর্ট অন্তবর্তীকালীন আদেশে ৩৪ কোম্পানির ওষুধ উত্পাদন বন্ধের নির্দেশ দেয়। পাশাপাশি রুল জারি করে। ওই রুলের শুনানিতে মনজিল মোরসেদ বলেন, ওষুধ (নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাদেশ ১৯৮২ এর ১৫(১) ধারায় বলা হয়েছে প্রতিটি কোম্পানিকে অবশ্যই জিএমপি নীতিমালা অনুসরণ করে ওষুধ উত্পাদন করতে হবে। এই নীতিমালা অনুসরণ না করলে কোম্পানির লাইসেন্স বাতিল বা স্থগিতের বিধান রয়েছে।
গতকালের রায়ে নিষেধাজ্ঞাপ্রাপ্ত ওষুধ কোম্পানিগুলো গোপনে বা অবৈধভাবে ওষুধ উত্পাদন করছে কি-না তা মনিটর করে ৩ মাস পরপর হাইকোর্টে প্রতিবেদন দাখিল করতে ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের মহাপরিচালকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
রায়ের পর অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ সাংবাদিকদের বলেন, এ রায় যুগান্তকারী। এ রায়ের ফলে ৩৪ কোম্পানির ওষুধ উত্পাদন বন্ধই থাকছে। তবে এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করবে বলে জানিয়েছেন দুটি ওষুধ কোম্পানির আইনজীবী আব্দুল্লাহ আল বাকী। তিনি বলেন, আমরা এ রায়ে সংক্ষুব্ধ।
এদিকে স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম বলেছেন, বিশেষজ্ঞ কমিটি কর্তৃক সুপারশকৃত ওষুধ কোম্পানির বিরুদ্ধে মন্ত্রণালয় থেকে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছিলো। উচ্চ আদালতেও ওইসব কোম্পানির বিরুদ্ধে একই ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছেন। এ রায়ের মধ্য দিয়ে নিম্নমানের ওধুষ উত্পাদনকারীরা সতর্ক ও নিরুত্সাহিত হবে এবং তারা এ ধরনের উত্পাদনের সাহস পাবে না।