নিজেকে ছাপিয়ে ওপরে ওঠার গল্প ॥ স্মৃতিরোমন্থনে ড. এআর মালিক– সততাযুক্ত বুদ্ধিদীপ্ত পরিশ্রমই পৌঁছে দেয় সাফল্যের শীর্ষে

 

 

স্টাফ রিপোর্টার: পারবো না কেন, পারতে হবে। অন্যে পারলে আমি কেন নয়? ছোটবেলার এই জেদই যাদুর কাঠি এনে দিয়েছে যে মানুষের হাতে তার নাম এআর মালিক। নামের আগে শুধু ডক্টরেটই নয়, অসংখ্য বিশেষেণে ভূষিত করার পরও যেন অপূর্ণ থেকে যায়। ড. আতিয়ার রহমান মালিক চুয়াডাঙ্গারই কৃতীসন্তান। যার জন্ম দামুড়হুদার ইব্রাহিমপুরের সম্ভ্রান্ত পরিবারে। দেশের শিল্পপতিদের অন্যতম ড. এরআর মালিক সাফল্যের শীর্ষে ওঠার গল্প জানতে চাওয়া হলে তিনি স্বভাবসুলভ হাসিমাখা মুখে বললেন, সবই চেষ্টার ফসল।

ক’দিন আগে ঢাকাস্থ স্কাউট ভবনের বিশাল দফতরে কাজের ফাঁকে বিস্কুটে চিবুক দিয়ে যখনই জানতে চাওয়া হয় সাফল্যের গল্প, তখনই তিনি চোখবুঝে স্মৃতিরোমন্থনে মগ্ন হয়ে পড়েন। বলেন, জীবনে চলার পথে অনেক বড় বড় উদার মনের মানুষের সাথে দেখা পেয়েছি। তাদের সঙ্গ পেয়েছি, পেয়েছি ছোঁয়া। এদের মধ্যে মরহুম আগা ইউসুফ অন্যতম। তার হাত ধরেই মূলতঃ ব্যবসা শুরু। তিনি বলতেন, সততা, কঠোর পরিশ্রম আর বুদ্ধিদীপ্ততা ব্যবসায় সফল্য দিতে বাধ্য। ওতে মানুষকে শুধু সাফল্যই দেয় না, পৌঁছে দেয় খ্যাতির শিখরে। তার সেই গুরুবাক্য আজো মনে লালন করে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছি। ছুটছি অবিরাম। একসময় নিজের সাফল্যের জন্য ছুটেছি, এখন মানুষের জন্য কিছু করে যাওয়ার প্রত্যয়ে ছুটছি তো ছুটছি।

ব্যবসার আগে, তারও আগের গল্প বলবেন? ইব্রাহিমপুরে জন্ম। রামনগর-কলাবাড়ি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে লেখাপড়া। খুলনার বিএল কলেজ থেকে এইচিএসসি পাস। এমএসসি পাস করি রাজশাহী থেকে। তখন ১৯৮১ সাল। পিএইচডির জন্য লন্ডনে গেলাম। ৮৫তে দেশে ফিরে শুরু করলাম প্রশাসন সরকারি চাকরি। কেমন যেন বন্দি বন্দি লাগতে লাগলো। সে চাকরি ছেড়ে আমেরিকায় ক্যালটেক্স ওয়েল কোম্পানিতে চাকরি নিলাম। না, সেখানেও জমলো না। কয়েক বছরের মাথায় লন্ডনের আইসিআই বর্তমানে যে এসিআই- কোম্পানিতে চাকরি নিয়ে ভালোই চলতে লাগলো। আর আগে বলে নেয়া ভালো, লন্ডনে পিএইচডি করার সময়ই অক্সফোর্ডের ইংরেজিতে অধ্যায়নরত জুলিয়াকে বিয়ে করি। ১৯৮৬ সালেই। শ্বশুর বাংলাদেশের স্বনামধন্য শীর্ষস্থানীয় শিল্পপতি মরহুম মিনহাজ উদ্দীন আহম্মেদ। লন্ডনে আইসিআই’র চাকরি ছেড়ে দেশে ফিরলাম ১৯৯৩ সালে। আলফা টোবাকো গ্রুপে যোগদান করি। কিছুদিনের মধ্যেই ঘাড়ে চেপে বসে এ গ্রুপের গুরুত্বপূর্ণ সব বোঝা।

ব্যক্তিগত জীবনে একমাত্র কন্যার পিতা। কন্যা আদিনা মালিক বর্তমানে নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির লেকচারার। স্ত্রী জুলিয়া মালিককে নিয়ে ঢাকাতেই বসবাস করেন। চুয়াডাঙ্গা জেল শহরের পুলিশ সুপারের কার্যালয়ের সামনের বাড়িতে সম্প্রতি ইংরেজি মাধ্যমের স্কুল চালু করা হয়েছে। তার বড় ভাই নাসা’র অবসরপ্রাপ্ত বিজ্ঞানী ড. এসআর মালিক প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে এ স্কুলের উদ্বোধন করেন। সম্প্রতি অপর বড় ভাই বিশিষ্ট বীজ ব্যবসায়ী জাফর মালিক ইন্তেকাল করেন। বড় ভাই জাফরের মৃত্যুর পর থেকে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছেন ড. এআর মালিক। সম্প্রতি তার দফতরে বসে আলাপচারিতার মাঝে বড়ভাই জাফর মালিকের প্রসঙ্গও ঘুরে ফিরে তুলে আনেন। তিনি বলেন, একজনকে উপরে উঠতে হলে পরিবারের অন্যদেরও অকৃত্রিম সহযোগিতা লাগে। আমার সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার অন্যতম প্রেরণা হলেন নাসার বিজ্ঞানী এসআর মালিক ও জাফর মালিক।

ছাত্র জীবনটা কি খুব কষ্টের ছিলো? না, স্বচ্ছল সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান হওয়ার সুবাদে তেমনটি ছিলো না। তবে অর্থ ঐশ্বর্য-বৈভবের মধ্যে থাকলে অনেকেই বখে যান। আমার ক্ষেত্রে তেমনটি হয়নি। বরঞ্চ সেদিকে না তাকিয়ে নিজেকে গড়ার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করেছি। ছাত্রজীবনেও ভালো করার ইচ্ছে যেমন ভালো ফল দিয়েছে, তেমনই কর্মজীবনে নেমেও ভালো কিছু করার ইচ্ছে আমাকে এগিয়ে আজকের এই জায়গায় এনে দিয়েছে। তবে কোনো কাজই প্রথমে অতোটা সহজ থাকে না, কঠোর পরিশ্রম করেই অসম্ভবকে সম্ভব করতে হয়। পড়েছি, উচ্চশিক্ষা নেয়ার জন্য সব সময়ই উদগ্রিব থেকেছি। লেখাপড়ার পর চাকরি করেছি। সেখানেই নিজেকে বন্দি না করে খোলা জানালার দিকে তাকিয়েছি, নিজেকে সফল করতে চেয়েছি। ব্যবসার শুরুতে সব সময়ই নানা প্রতিবন্ধকতা থাকে। আমার ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম ছিলো না। সততা আর পরিশ্রম এগিয়ে দিয়েছে অনেকটা।

ড. এআর মালিক- আলফা ফার্মাসিটিকেলস, আলফা একোটিস লিমিটেড. উত্তরায়ন কোম্পানি লিমিটেডের চেয়ারম্যান, আলফা এগ্রো লিমিটেড ও আলফা বায়োটেকনোলজি লিমিটেডের ব্যবস্থপনা পরিচারক। আর আলফা অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েট কোম্পানির প্রশাসনিক কর্মকর্তা। আলফা টোবাকো, এগ্রো ফার্মেসি (বাংলাদেশ) লিমিটেডের পরিচালক। আইএফআইসি ব্যাংক লিমিটেডের পার্টনার ডাইরেক্টর। এছাড়াও তার রয়েছে অসংখ্য প্রতিষ্ঠান। নিজ গ্রামে মায়ের নামে গড়ে তুলছেন বিশাল বিনোদন কেন্দ্র। মায়ের নামে নাম দিয়েছেন মেহেরুন নেছা পার্ক। প্রায় তিনশ বিঘা জমির একপাশে বিশাল বাগান আর একপাশে এ বিনোদনকেন্দ্রটি ইতোমধ্যেই পিকনিক স্পট হিসেবে দেশজুড়ে পরিচিতি পেতে শুরু করেছে। এটা নিজ গ্রামের অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা ফেরাতে যেমন সহায়ক হবে তেমনই তিনি এলাকার দুস্থদের স্বনির্ভর করতে প্রতি বছরই নানামুখি পদক্ষেপ নেন।

তিনি প্রজন্মের উদ্দেশে বলেছেন, বড় হতে হলে অবশ্যই সময়ের ¯্রােতে টিকে থাকার মতো সাঁতার কাটতে হবে। দম রেখে নিজের মধ্যে লালিত স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথে হাঁটতে পারলে সাফল্য সত্যিই যাদুর কাঠির মতোই হাতে এসে ধরা দেবে। শুধু চাকরি করবো নয়, চাকরি দেবো ভেবেও নিজেকে গড়তে হবে ছাত্রজীবন থেকেই। আর আমাদের দেশ যেহেতু ঊর্বর, সেহেতু শিক্ষিতদেরও কৃষিবিপ্লবে এগিয়ে এসে নিজের এবং দেশের কল্যাণে অবদান রাখতে হবে। মনে রাখতে হবে, দেশ এগিয়ে যাচ্ছে, নিজেকে সকলের মাঝে তুলে ধরার প্রতিযোগিতা বাড়ছে। বসে থাকলে পিছিয়ে পড়তে হবে। ফলে সময়ের অপচয় আর নয়। যথাসময়ে সঠিক কাজটি করতে পারাটাই বুদ্ধিদীপ্ততা।

Leave a comment