অভাব ঘোচাতে ভিক্ষুকদের পুনর্বাসন : স্বভাব তাড়তে প্রস্তুত আইন
কামরুজ্জামান বেল্টু: ভিক্ষুকমুক্ত দেশ গড়ার নিমিত্তে ওদের অভাব ঘোচানোর সর্বাত্মক চেষ্টা চলছে, কিন্তু স্বভাব? ওটাও বদলাতে আইন বিদ্যমান। ভিক্ষাবৃত্তি আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ হলেও এখনও তা তেমন প্রয়োগ নেই। আর এ কারণেই স্বয়ং প্রশাসনের শীর্ষ কর্তাদের দফতরেও ঘুর ঘুর করে অসংখ্য ভিক্ষুক। গত বুধবার চুয়াডাঙ্গা জেলা কালেক্টরেট ভবনে ভিক্ষা করা এক নারী ভিক্ষুকের সাথে কথা বলতে গেলে তিনি জানান, তার ভয়াবহ অভাবের কথা। অথচ বাস্তবে তার সম্পর্কে খোঁজ নিতে গেলে পাওয়া যায় ভিন্ন চিত্র। যতোটা না অভাব, তার চেয়ে ঢের বেশি স্বভাব।
নাম নূরজাহান খাতুন। বয়স আনুমানিক ৫৫ বছর। বাড়ি কুষ্টিয়ার পাংশায়। চুয়াডাঙ্গায় ভিক্ষা করে অর্জিত বা গচ্ছিত টাকা চাল নিয়ে প্রতিমাসে অন্তত একবার বাড়ি যান। চুয়াডাঙ্গা ফার্মপাড়ার একটি বাড়িতে ভাড়ায় থাকেন। বাড়িটা বাঁশ-মাটির। যদিও ফার্মপাড়ার ভাড়ার বাড়িটার বদৌলতে ফার্মপাড়াই হয়ে গেছে তার স্থায়ী ঠিকানা। আসাল ঠিকনা তিনি সহজে বলেন না। তিনি বলেছিলেন, বিয়ের পর সন্তান হলে স্বামী হারিয়ে যায়। সেই ছেলে আর ঘরে থাকা অসুস্থ মায়ের জন্যই ভিক্ষা করতে হয়। অসুস্থ মায়ের জন্য প্রতি সপ্তাহে তিনশ টাকার ওষুধ কিনতে হয়। অতো টাকা ভিক্ষা করে ছাড়া জোগাড় করবো কীভাবে?
নূরজাহানের এ কথায় সেদিন মায়া জাগলেও তার সম্পর্কে খোঁজখবর নিতে গেলে পাওয়া যায় ভিন্ন চিত্র। ফার্মপাড়ায় তার মা-বাবা ছেলে থাকে না। মহিলা একই ফার্মপাড়ার মৃত শাহাবুদ্দিনের স্ত্রীর নিকট থেকে কিছু জমি নিয়ে ঝুপড়ি তৈরি করে সেখানেই বসবাস করেন। মাসে মাসে ভাড়া দেন। তিনি অধিকাংশ শুক্রবারেই ছুটি কাটান। বাকি দিনগুলোতে ভিক্ষা করতে বের হন। রাতে ফিরে চুপচাপ থাকেন। এ তথ্য দিয়ে মৃত শাহাবুদ্দিনের স্ত্রী লতা খাতুন বলেন, নূরজাহান খাতুন আনুমানিক ১৫ বছর ধরে আমাদের এখানে থাকে। ভিক্ষা করে। অতোদিনে নূরজাহানের আপনজনদের তেমন কাউকে এখানে আসতেও দেখা যায়নি। ভিক্ষা না করে ঝিয়ের কাজ করলেও করতে পারেন। কিন্তু ওই কাজ করবে কেন। ভিক্ষায় তো অনেক আয়। প্রতিদিন ভিক্ষা করে কমপক্ষে ১শ টাকা হয়। সপ্তাহের ভিক্ষা করা ছয়দিনের মধ্যে শনিবার বড় বাজার, রোববার রেজিস্ট্রি অফিস চত্বর, সোমবার কোর্টপাড়া, মঙ্গল ও বুধবার কোর্ট ও জেলা প্রশাসকের কার্যালয় এলাকা এবং বৃহস্পতিবার ফার্মপাড়া। শুক্রবার মূলত ছুটিতেই থাকেন তিনি। নূরজাহান খাতুন সম্পর্কে মন্তব্য জানতে চাওয়া হলে এলাকার পৌর কাউন্সিলর সিরাজুল ইসলাম মনি বলেন, উনি অভাবী ভিক্ষুক নন। ভিক্ষা করা ওনার স্বভাব। ফলে কিছুতেই কিছু হয় না। আমরা আগেও তাকে ভিক্ষা না করার জন্য পুনর্বাসনের চেষ্টা করেছি। হয়নি। এবার যেহেতু সারাদেশই ভিক্ষুকমুক্ত করার চেষ্টা চলছে, সেহেতু দেখা যাক নূরজাহান তার পুরোনো পেশা ছাড়েন কি-না।
প্রসঙ্গত: দেশের অন্যান্য জেলার মতো চুয়াডাঙ্গা জেলাও ভিক্ষুকমুক্ত করার কার্যক্রম জোরেসরে চলছে। ইতোমধ্যেই ভিক্ষুকদের তালিকাও করা হয়েছে। চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলায় মোট ৬৪৫, আলমডাঙ্গা ৫৬১, জীবননগরে ২৬২ ও দামুড়হুদা উপজেলায় ৫৩৯ জন তালিকাভুক্ত ভিক্ষুক। এদেরকে দু বছর ধরে প্রতিমাসে ৩০ কেজি করে চাল দেয়ার পাশাপাশি কাজ করে খাওয়ার মতো উপকরণ অথবা পুঁজি দেয়ার চেষ্টা চলছে। ইতোমধ্যেই বহু ভিক্ষুককে ব্যবসার উপকরণও দেয়া হয়েছে। কারো দেয়া হচ্ছে চা তৈরির কেটলি ও বড় ফ্লাক্স। ভিক্ষা নয়, যাতে তিনি চা বিক্রি করে সংসার চালাতে পারেন। গত বুধবার চুয়াডাঙ্গা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের একটি দফতরে ভিক্ষার হাত পাতা নূরজাহান অবশ্য গতকাল পর্যন্ত তেমন কিছুই পাননি। ফার্মপাড়া এলাকার কাউন্সিলর সিরাজুল ইসলাম মনি বলেছেন, নূরজাহানকে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। তিনিও বরাদ্দকৃত চাল পাবেন। দেখা যাক, সরকারি চাল পেয়ে তিনি ভিক্ষা ছাড়েন কি-না। না ছাড়লে এবার সোজা জেল।