অবৈধ সমিতি ভোক্তা সংরক্ষণ আইনের পরিপন্থি মনে করেন আইনজ্ঞরা
ঝিনাইদহ প্রতিনিধি: ঝিনাইদহের সাব-রেজিস্ট্র্রি অফিসগুলোতে দলিল লেখক সমিতির নামে ‘গলাকাটা সিন্ডিকেট’ গঠন করে জমি রেজিস্ট্রিতে প্রতিদিন কৃষকের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা লুটে নিচ্ছে। ফলে ক্রেতা বিক্রেতারা দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। দলিল লেখক সমিতির এই অবৈধ গলাকাটা সিন্ডিকেট ঠেকাতে প্রশাসনিক হস্তক্ষেপ জরুরি হয়ে পড়েছে।
তথ্যানুসন্ধান করে জানা গেছে, ঝিনাইদহ জেলার ৬ উপজেলায় এ রকম সিন্ডিকেট বছরের পর বছর ধরে কায়েম আছে। কথিত সেরেস্তা খরচের নামে দলিল লেখক সমিতির বেপরোয়া চাঁদাবাজিতে মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। বছরের পর বছর এই সিন্ডিকেট কৃষকদের জিম্মি করে তাদের কষ্টার্জিত টাকা অবৈধভাবে হাতিয়ে নিচ্ছে। সাধারণ দলিল লেখকদের ভাগ্য পরিবর্তন না হলেও অনেক সমিতির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদ ফুলে ফেঁপে উঠেছেন।
রাস্তায় দামি গাড়ি ও গ্রামে আলীশান বাড়ি তৈরি হয়েছে গ্রামের হতদরিদ্র কৃষকের রক্ত চোষা টাকায়। রাজনৈতিক নেতাদের ছত্রছায়ায় গড়ে ওঠা এসব সমিতি সম্পূর্ণ অবৈধ ও ভোক্তা অধিকার আইনের পরিপন্থি বলে মনে করেন আইনজ্ঞরা। ফলে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে এসব অবৈধ আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে প্রশাসন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন সাব রেজিস্ট্রার জানান, গত বছরের নিয়মানুযায়ী একটি দলিল রেজিস্ট্রি করতে সরকারকে পৌরসভা এলাকায় প্রতি লাখে সাড়ে ১১ হাজার ও পৌরসভার বাইরে সাড়ে ৯ হাজার টাকা করে ফি দিতে হয়। কিন্তু বেআইনীভাবে গঠিত এই সমিতি সরকার নির্ধারিত ফির বাইরে পৌরসভা এলাকায় প্রতি লাখে ১৬ হাজার ও ইউনিয়নে নিচ্ছে ১৫ হাজার করে।
রসিদ বিহীন এই টাকা দলিল লেখক সমিতির কর্মকর্তারা কোনো ব্যাংক একাউন্টে রাখেন না এবং সাধারণ সদস্যদেরও কোনো হিসাব দেন না। অফিসকে একটি অংশ দিয়ে বাকি টাকা সপ্তাহ শেষে ভাগ-বাটোয়ারা করে নেয়া হয়।
কয়েকজন সাধারণ দলিল লেখক জানান, আমাদের কাছ থেকে সেরেস্তা খরচ ও বিভিন্ন খাতে দেয়ার নামে মোটা অঙ্ককের টাকা সভাপতি ও সম্পাদক লোপাট করেন।
অভিযোগ উঠেছে দীর্ঘদিন ধরে নিরুপায় হয়েই এ টাকা দিতে হচ্ছে জমির মালিকদের। লেখক সমিতির এ আইন কেউ না মেনে চললে জমি রেজিস্ট্র্রি করা হয় না। এমনকি সাব রেজিস্ট্রাররাও লেখক সমিতির কাছে জিম্মি। প্রতিটি সমিতির রয়েছে পেটোয়া বাহিনী। এই সমিতি গঠনও অবৈধভাবে করা হয়েছে। প্রভাবশালী নেতারা বলে দেন অমুক সভাপতি ও অমুক সম্পাদক। ব্যাস! এভাবেই চলবে বছরের পর বছর।
ঝিনাইদহ সদর সাব রেজিস্ট্রি অফিসে এ ধরণের একটি গলাকাটা কমিটি রয়েছে। যার সভাপতি আক্তার হোসেন ও সাধারণ সম্পাদক আলম। এই সিন্ডকেট ঝিনাইদহ সদর উপজেলার জমি ক্রেতা বিক্রেতাদের জিম্মি করে কাড়ি কাড়ি টাকা হাতিয়ে নিলেও প্রতিবাদ করার কেও নেই। অফিসও এই সমিতির ওপর নাখোশ।
শৈলকুপায় দলিল লেখক সমিতির সভাপতি নান্নু মোল্লা ও সাধারণ সম্পাদক মনিরুল ইসলাম। তারাও সমিতির নামে চাঁদাবাজিতে লিপ্ত। হরিণাকু-ুুতে দীর্ঘদিন ধরে সভাপতি হিসেবে ওয়াজেদ আলী ও সম্পাদক হিসেবে বিশারত আলী দায়িত্ব পালন করছেন। এখন সমিতির কার্যক্রম ঝিমিয়ে পড়েছে বলে লেখকরা জানান।
মহেশপুর একতা দলিল লেখক সমিতি নামে একটি অবৈধ কমিটির সভাপতি হিসেবে কৃষকদের কাছ থেকে অতিরিক্ত টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন জাকির হোসেন ও তাজুল ইসলাম। স্থানীয় এমপি নবী নেওয়াজ এমন কমিটির ঘোর বিরোধী হলেও এমপির কোনো নিষেধ এই সমিতি মানছে না।
কালীগঞ্জে দলিল লেখক সমিতির গঠন করে একছত্র আধিপত্ত বিস্তার করে রয়েছেন সভাপতি মো. আব্দুল হক ও সাধারণ সম্পাদক নাছির চৌধুরী। এই সিন্ডিকেটের কাছে অফিসও জিম্মি। সমিতির কথা না শুনে কালীগঞ্জের একাধিক সাবরেজিস্ট্রার অপমান অপদস্ত হয়েছেন।
কোটচাঁদপুর দলিল লেখক সমিতির সভাপতি ইসমাইল হোসেন ও সাধারণ সম্পাদক সন্তোষ কুমার পাল কৃষকদের কাছ থেকে সেরেস্তা খরচের নামে যথেচ্ছা গলাকাটা ফি আদায় করছেন বলে অভিযোগ। কথিত আছে এ সব সমিতির নেতাদের কেও ভ্যানচালক ও ইটভাটার লেবার সরদার থেকে উঠে এসে এখন কোটি কোটি টাকার মালিক।
তাছড়া বিভিন্নসূত্রে জানা গেছে, দলিল লেখক সমিতির নামে জোর জবরদস্তি করে টাকা আদায় বন্ধ করতে জেলা ও উপজেলা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী কমিটিতে সিদ্ধিান্ত হয়। কিন্তু প্রশাসনের এসব কাগোজে সিদ্ধান্ত কেও আমলে নেননি। তবে ঝিনাইদহের কোনো দলিল লেখক সমিতির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক এ নিয়ে কথা বলতে চান নি।
এ বিষয়ে ঝিনাইদহ জেলা রেজিস্ট্রার বীর বিক্রম চাকমা জানান, সরকারি আইন মেনে যে কেও সমিতি করতে পারে। তবে দলিল লেখক সমিতির নামে অতিরিক্ত টাকা আদায় বেআইনী। তিনি বলেন, কোনো কৃষক আমার কাছে এ পর্যন্ত অভিযোগ করেনি।