ইবিতে দু দিনব্যাপী আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় বিতর্ক প্রতিযোগিতার সমাপনীতে প্রফেসর ড. মিজানুর রহমান
ইবি প্রতিনিধি: বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের প্রফেসর ড. মো. মিজানুর রহমান বলেছেন, বিতর্ক এমন একটি মাধ্যম যে মাধ্যমে আমরা শুধুমাত্র যে যুক্তির অবতারণা করতে শিখি তা নয়, একজন আইনজীবী আদালতে গিয়ে যেভাবে যুক্তির অবতারণা করেন এবং প্রতিপক্ষকে যুক্তির মাধ্যমে ঘায়েল করার চেষ্ট করেন, একটা বিতর্ক অনুষ্ঠানেও আমরা প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করি কিন্তু জয় বা পরাজয় যেটিই আসুক না ভাগ্যে, যখন মঞ্চ থেকে নেমে যাই তখন আলিঙ্গন করি এবং বন্ধু হিসেবে সকলকে বুকের ভেতরে টেনে নিই। এই যে আমাদের পরস্পর পরমত সহিষ্ণুতা, অন্যের যুক্তি এবং মতের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন, এগুলো যদি বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে এসেও লালন ও পালন করতে না পারি তাহলে উচ্চ শিক্ষার কোনো অর্থ থাকে না। আর সে কারণেই আমার মনে হয় বিতর্ক চর্চাটা আজ প্রয়োজনীয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ড. মিজানুর রহমান বলেন, আমাদের বঙ্গবন্ধু জনবান্ধব রাজনীতি করেছেন। উন্নয়শীল একটি রাষ্ট্রের ছাত্র-ছাত্রী ও নাগরিক হিসেবে, মানুষ হিসেবে এই বিশ্ব পরিক্রমায় আমাদের কি ভূমিকা হবে, আমরা কী চিন্তা-চেতনার ধারক এবং বাহক হবো তা নির্ণয় করতে হবে জনবান্ধব রাজনীতির নিরিখে। তিনি বলেন, নিজের দেশের মাটিকে ছোট করে দেখা যাবে না। মাটির কথা, সত্যের কথা, সত্য অন্বেষণের কথা যখন আসে তখন আমাদেরকে বারবার মুক্তিযুদ্ধে ফিরে যেতে হয়। আজকের মানবতার যে জয়গান আমারা গাইতে চাই, মানুষের মুক্তির যে বার্তা আমরা সারা বিশ্বে পৌঁছে দিতে চাই, মানবের জয়গানের যে বার্তাবাহক হয়ে আমরা নিজেদেরকে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দিতে চাই, তার মূলেও কিন্তু রয়েছে আমাদের ১৯৭১ সাল, মহান মুক্তিযুদ্ধ। তিনি বলেন, আজ অনেকেই মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধের কথা বলেন। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত মূল্যবোধ কি তা আমরা অনেকেই জানি না। মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত মূল্যবোধ আমাদেরকে জানতে হবে এবং লালন করতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণাপত্রে সমতা, সামাজিক ন্যায় বিচার এবং মানবসত্তার মর্যাদার কথা বলা হয়েছে। আজ আমরা ২০১৭ সালে এই তিনটিকে যদি একত্রিত করি তাহলে তার নাম হয়ে যায় মানবাধিকার। আর মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধ হচ্ছে, বাংলাদেশ হবে মানবাধিকারের ধারণার ওপরে প্রতিষ্ঠিত একটি প্রজাতন্ত্র। তিনি বলেন, আজ প্রশ্ন করবার সময় এসেছে বাংলাদেশ তুমি আমায় কি দিয়েছ সেটা নয় বরং প্রশ্ন করতে হবে আমি বাংলাদেশকে কি দিয়েছি। আমি যখন আমার দেশকে দেব তখন আমি আমার রাষ্ট্রের কাছে দাবি করতে পারবো রাষ্ট্র তুমি এখন আমাকে দাও। তিনি বলেন, আমাদের সংবিধানের ৭ অনুচ্ছেদে বলা আছে যে প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ। এই কথাটি শুধু লেখা থাকলেই হবে না এর বাস্তুব রূপ আমরা দেখতে চাই।
গতকাল মঙ্গলবার সকালে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমান মিলনায়তনে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় পরিষদের উদ্যোগে এবং ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের আয়োজনে বাংলা ও ইংরেজি মাধ্যমে আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় বিতর্ক প্রতিযোগিতা-২০১৬’র সমাপনী অনুষ্ঠানে অতিথির বক্তৃতায় বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের প্রফেসর ড. মিজানুর রহমান এ কথা বলেন।
আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় বিতর্ক প্রতিযোগিতা আয়োজন কমিটির আহ্বায়ক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় ডিবেটিং সোসাইটির মডারেটর ইংরেজি বিভাগের প্রফেসর ড. মো. মামুনুর রহমানের সভাপতিত্বে সমাপনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস-চ্যান্সেলর প্রফেসর ড. মো. হারুন-উর-রশিদ আসকারী। অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর প্রফেসর ড. মো. শাহিনুর রহমান ও ট্রেজারার প্রফেসর ড. মো. সেলিম তোহা। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি প্রফেসর ড. হারুন-উর-রশিদ আসকারী বলেন, দু দিনব্যাপী এ বিতর্ক প্রতিযোগিতায় বিতার্কিকরা যে ক্ষুরধার যুক্তি এবং পাল্টা যুক্তি উপস্থাপন করে বিতর্কের বিভিন্ন বিষয়কে নিজেদের পক্ষে আনার চেষ্টা করেছে তা দেখে আমি মুগ্ধ ও বিস্মিত হয়েছি। তিনি বলেন, ৩টি বিষয়ে গুনান্বিত ব্যক্তি একজন ভালো বিতার্কিক হতে পারে, যেমন- বিষয়বস্তু, স্টাইল এবং কৌশল। আমি আশা রাখবো, তোমরা যারা উদীয়মান বিতার্কিক তারা অবশ্যই এই ৩টি বিষয়ের প্রতি লক্ষ্য রাখবে। ভাইস-চ্যান্সেলর বলেন, যদি আমাদের ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় প্রতিটি ক্ষেত্রে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে চাই, তাহলে আমাদের যুক্তিবাদী, বুদ্ধিবাদী, বস্তুনিষ্ঠ, তর্কপ্রিয়, বিজ্ঞানমনস্ক, প্রগতিশীল এবং আলোকিত একদেশ মানুষ বিনিমার্ণের জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন হচ্ছে বিতর্কের চর্চা করা। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে এ প্রতিযোগিতা আয়োজনের সুযোগ করে দেয়ায় বিশ্ববিদ্যালয় পরিষদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানানোর পাশাপাশি অংশগ্রহণকারী সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও অংশগ্রহণকারীদের প্রতি আন্তরিক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানান।
অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি প্রফেসর ড. মো. শাহিনুর রহমান বলেন, আমি মনে-প্রাণে বিশ্বাস করি, বিতর্কের মধ্যদিয়ে সত্যকে উদঘাটন করা যায়। তিনি শিক্ষার্থীদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, তোমরা এই বিতর্ক প্রতিযোগিতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে না, নিজেদের পথ চলার পথ খুঁজে নেবে এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে জায়গা করে নেবে এই প্রত্যাশা করি।
অপর বিশেষ অতিথি প্রফেসর ড. মো. সেলিম তোহা বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় জ্ঞান চর্চার জায়গা। এ প্রতিযোগিতায় বিতার্কিকরা বিভিন্ন তথ্য, উপাত্ত দিয়ে দেশ-বিদেশের যে অজানা তথ্যাবলী উপস্থাপন করেছে, তাতে আমরা মুগ্ধ। অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ইশরাত জাহান। দু দিনব্যাপী এ বিতর্ক প্রতিযোগিতা ব্যাপক জমে উঠেছিলো। দর্শক-শ্রোতাদের ছিলো উপছে পরা ভিড়। অডিটোরিয়াম ছিলো কানায়-কানায় পরিপূর্ণ। বাংলা মাধ্যমে চূড়ান্ত পবের্র প্রতিযোগিতার বিষয়বস্তু ছিলো দুর্বল গণতন্ত্রের চেয়ে শক্তিশালী একনায়কতন্ত্র তৃতীয় বিশ্বের জন্য উপযোগী গ্রহণযোগ্য। এ বিষয়ের উপর যুক্তিতর্ক শেষে সরকারি দল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করে এবং বিরোধীদল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় রানারআপ হয়। শ্রেষ্ঠ বক্তা নির্বাচিত হন সরকারি দল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথী আব্দুল্লাহ্। এ পর্বে স্পিকারের দায়িত্ব পালন করেন ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষক আরমিন খাতুন এবং বিচারকের দায়িত্ব পালন করেন ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক প্রফেসর ড. একেএম মতিনুর রহমান, প্রফেসর ড. নাসিম বানু ও প্রফেসর ড. মিয়া রাশিদুজ্জামান। অপরদিকে ইংরেজি মাধ্যমে বিতর্কের বিষয়বস্তু ছিলো দিজ হাউস উড সাপোর্ট এক্সসেপশনস টু জেন্ডার ইকোয়ালিটি এট ওয়ার্কপ্লেস। এ বিষয়ের ওপর যুক্তিতর্ক শেষে বিরোধী দল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করে এবং সরকারি দল স্বাগতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় দল রানারআপ হয়। শ্রেষ্ঠ বক্তা নির্বাচিত হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শফিউল ইসলাম শুভ। এ পর্বে স্পিকারের দায়িত্ব পালন করেন ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের প্রফেসর ড. রেজাউল হক এবং বিচারকের দায়িত্ব পালন করেন কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক শওকত জামিল সৈকত, পাবনা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হুময়ুন কবির ও ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক শাহিনুর রহমান। নক-আউট ভিত্তিতে এ প্রতিযোগিতায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, বঙ্গবন্ধু মেরি টাইম বিশ্ববিদ্যালয়, শাহ্জালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, পাবনা বিশ্ববিদ্যালয়, কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিযোগিরা অংশগ্রহণ করে। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের ৭টি ভ্যেনুতে এ প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়।