রাষ্ট্রয়াত্ব ব্যাংকে ঋণ দুর্নীতি : শীর্ষ খেলাপিরা ধরা ছোঁয়ার বাইরে

 

স্টাফ রিপোর্টার: ব্যাংক খাতে অনিয়ম ও যাচাই-বাছাই ছাড়া বিতরণের বেশির ভাগ ঋণই এখন খেলাপি। এসব ঋণ আদায়ে বাংলাদেশ ব্যাংক কড়াকড়ি করলেও সন্তোষজনক সাড়া পাচ্ছে না। বিশেষ করে সরকারি ব্যাংকে দুর্নীতির মাধ্যমে দেয়া সব ঋণ মন্দ ঋণে পরিণত হয়েছে। অথচ ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়েছে শীর্ষ ঋণখেলাপিরা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। কারণ শীর্ষ খেলাপিদের বেশির ভাগ ঋণ দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে দেয়া হয়েছে। এদের কেউ ব্যবসা বন্ধ করে দিয়েছে। আবার কেউ দেশ ছেড়েও পালিয়েছে। আর যারা দেশে আছেন তারা প্রভাবশালী মহলের আশীর্বাদ নিয়ে প্রকাশ্যে বুক ফুলিয়ে ঘোরাফেরা করছেন।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, সরকারি ব্যাংকগুলোতে প্রথমে দুর্নীতির মাধ্যমে ঋণ দেয়া হয়েছে। এখন এসব ঋণ পুরোটাই খেলাপি। তাই শীর্ষ ঋণখেলাপিদের থেকে টাকা আদায় অনেক ক্ষেত্রে অসম্ভব হয়ে পড়েছে। তিনি বলেন, সঙ্কট উত্তরণে বাংলাদেশ ব্যাংক এখন সমঝোতা স্মারক চুক্তির (এমওইউ) মাধ্যমে শীর্ষ খেলাপি থেকে টাকা আদায়ের জন্য ব্যাংকগুলোকে চাপ দিচ্ছে। কিন্তু এই পদ্ধতিতে টাকা আদায় কতটা ফলদায়ক হবে তা নিয়েও সংশয় রয়েছে। তার মতে, এভাবে ভদ্র পদ্ধতিতে টাকা আদায় নাও হতে পারে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংককে আরও কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে।

গত বছরের শুরুতে বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে সরকারি ব্যাংকগুলোর সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) স্বাক্ষরিত হয়। এই স্মারকের আওতায় কিছু সূচক নির্ণয় করা হয়। এগুলোর মধ্যে রয়েছে- মোট ঋণ (কর্মচারী ঋণ ব্যতীত), শ্রেণিকৃত ঋণ, শ্রেণিকৃত ঋণ থেকে নগদ আদায়, অবলোপনকৃত ঋণ থেকে নগদ আদায় (বছরের শুরুতে পুঞ্জীভূত অবলোপনকৃত ঋণের বিপরীতে), মোট আমানতের বিপরীতে স্বল্পব্যয়ী আমানতের হার, মূলধন সংরক্ষণ হার (ব্যাসেল-২ অনুযায়ী), প্রভিশন সংরক্ষণের হার, কর ও প্রভিশন পরবর্তী মুনাফা, সম্পদের ওপর উপার্জনের হার, লোকসানি শাখার সংখ্যা, মামলা নিষ্পত্তির হার, অটোমেশন ও মানবসম্পদ উন্নয়ন। এই সূচকগুলোর আওতায় সরকারি ব্যাংকের পারফরম্যান্স মূল্যায়ন এবং প্রতি ছয় মাস অন্তর তা বিশ্লেষণ করা হয়।

প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, গেল বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সরকারি খাতের সোনালী, অগ্রণী ও রূপালী ব্যাংক শীর্ষ ২০ খেলাপি থেকে আদায় করেছে মাত্র ১০৮ কোটি টাকা। এসব ব্যাংকের শীর্ষ ২০ খেলাপি থেকে বছরে আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিলো ৮৮০ কোটি টাকা। এর মধ্যে রূপালী ব্যাংক ছাড়া সোনালী ও অগ্রণী ব্যাংকের অবস্থা খুবই নাজুক। সোনালী ব্যাংক সেপ্টেম্বর শেষে আদায় করেছে মাত্র ৩০ কোটি টাকা। ব্যাংকটির আদায়ের লক্ষ্য ছিলো ৪৪০ কোটি টাকা। একই সময়ে অগ্রণী ব্যাংক আদায় করেছে আরও কম, মাত্র ২ কোটি টাকা। ব্যাংকটির আদায়ের লক্ষ্য ছিলো ২৯০ কোটি টাকা। এ বিষয়ে সোনালী ও অগ্রণী ব্যাংকের কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। উভয় ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের (এমডি) সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়েছে। তাদের পাওয়া যায়নি। এমনকি বক্তব্যের বিষয়বস্তু উল্লেখ করে ক্ষুদে বার্তা পাঠানো হয়েছে। তাতেও কোনো সাড়া মেলেনি।

প্রাপ্ত তথ্যে আরও দেখা যায়, সেপ্টেম্বর শেষে রূপালী ব্যাংক আদায় করেছে ৭৬ কোটি টাকা। ব্যাংকটির আদায়ের লক্ষ্য ছিলো ১৫০ কোটি টাকা। তবে রূপালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আতাউর রহমান প্রধান মুঠোফোনে বলেন, গত বছর ৩০০ কোটি টাকা আদায় করা হয়েছে। এর মধ্যে শুধু ডিসেম্বরে আদায় হয়েছে ১০০ কোটি টাকা। পর্যায়ক্রমে বাকি অর্থ আদায় করা সম্ভব হবে বলে মনে করেন তিনি।

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন  বলেন, লক্ষ্যমাত্রা পূরণে পিছিয়ে থাকলে অবাক হওয়ার কিছু নেই। কারণ এসব ঋণ যাচাই-বাছাই করে দেয়া হয়নি। এদিকে সোনালীর ৪৪০ কোটি টাকা লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে জুন পর্যন্ত আদায় হয়েছিলো মাত্র ৫ কোটি টাকা। অগ্রণী ২৯০ কোটি টাকার বিপরীতে মাত্র ১ কোটি ৬৯ লাখ এবং রূপালী ব্যাংকের ১৫০ কোটি টাকা লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে আদায় হয়েছিলো ৭৬ কোটি টাকা। এছাড়া জুনে সোনালীর লোকসানি শাখা ১২৪টি থেকে বেড়ে ২৯০টিতে উন্নীত হয়েছে। অগ্রণী ৩৪টি থেকে ৯৯টি এবং রূপালী ১০টি থেকে বেড়ে হয়েছে ১২৬টি। জুনে সোনালীর ২ হাজার ৬০৬ কোটি, অগ্রণী ২০০ কোটি ও রূপালী ব্যাংকে ১ হাজার ৫৩ কোটি টাকার মূলধন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে। সার্বিক পরিস্থিতির উন্নয়নে ব্যাংকগুলোকে পরামর্শ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০১৬ সালের জুন পর্যন্ত সোনালী ব্যাংকের ১৫ শীর্ষ খেলাপির কাছে আটকে আছে ২ হাজার ৬০০ কোটি টাকার বেশি। একইভাবে অগ্রণী ব্যাংকের ১৮ শীর্ষ খেলাপির কাছে প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা ও রূপালী ব্যাংকের ৪ শীর্ষ খেলাপির কাছে আটকে আছে ৪২৫ কোটি টাকার বেশি। এ খেলাপিরা বেশির ভাগই ধরাছোঁয়ার বাইরে। এদের থেকে খেলাপির টাকা উদ্ধার করতে পারছে না ব্যাংকগুলো।

বিশ্লেষকরা বলছেন, এসব টাকা ব্যাংকের সাধারণ গ্রাহকের আমানতের টাকা। অথচ দুর্নীতির মাধ্যমে তা লুটপাট করা হচ্ছে। আর বেকায়দায় পড়লে মূলধন ঘাটতির অজুহাত দেখিয়ে সরকারি তহবিল কিংবা শেয়ার ছেড়ে ঘাটতি মেটানো হচ্ছে। এতে করে প্রকারান্তরে দেশের মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। অবস্থা এখন এমন পর্যায়ে দাঁড়িয়েছে যে, দুর্নীতি করে একদিনে সাধারণ মানুষের আমানত রাখা টাকা আত্মসাৎ করা হচ্ছে, অপরদিকে ওই ঘাটতি পূরণ করা হচ্ছে জনগণের ট্যাক্সের পয়সা দিয়ে। অর্থাৎ একটি চক্র সরকারি তহবিল লুটপাট করছে বললেও ভুল বলা হবে না।

 

Leave a comment