না, মরা কিংবা মারা কোনোটাই করা যাবে না। যতো জটিল-কুটিল রোগই হোক, যন্ত্রণা বা কষ্ট যতোই অসহনীয় হোক স্বেচ্ছায় মরার আইনগত সুযোগ নেই। তবে মরে গেলে অনেক সময় ময়নাতদন্তটা এড়ানো যেতে পারে। ইদানীং জটিল রোগের কথা বলে ময়নাতদন্ত ছাড়াই লাশ দাফনের অনুমতি মেলে। তাই বলে জটিল রোগে আক্রান্ত দু ছেলে ও এক নাতিকে মারার অনুমতি? কতোটা কষ্টে হাবুডুবু না খেলে এরকম অনুমতি কেউ চায়? দেশের প্রচলিত বিধান ওই অনুমতি দেয়ার এখতিয়ার জেলা প্রশাসককে দেয়নি।
দেশের সকল নাগরিকের চিকিৎসা পাওয়ার অধিকার সাংবিধানিক। তাহলে মেহেরপুর বেড়পাড়ার ফলব্যবসায়ী তোফাজ্জেল হোসেনকে কেন ওই করুণ আকুতি করতে হয়েছে? তিনি মেহেরপুর জেলা প্রশাসকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেছেন, দুই ছেলে ও এক নাতিকে মেরে ফেলার অনুমতি দিন, নয়তো চিকিৎসার ব্যবস্থা করুন। গতকাল শনিবার এ বিষয়ে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তোফাজ্জেল হোসেনের ২৪ বছর বয়সী ছেলে আব্দুস সবুর ও ছোট ছেলে রায়হানুলের বয়স ১৩ বছর। আর ৮ বছর বয়সী নাতি সৌরভ ডুফিনি মাসকুলোর ডেসট্রোফি রোগে আক্রান্ত। এ রোগের নাকি নিরাময় নেই। ওদের সকলেরই বয়স যখন ৮ বছর তখনই ওই রোগে আক্রান্ত হয়। তোফাজ্জেল হোসেনের দাবি, তিনি বাংলাদেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ঘোরার পাশাপাশি ভারতের স্বনামধন্য বহু চিকিৎসকের কাছে ওই রোগীদের নিয়ে গেছেন। পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ওই রোগের বিষয়টি নিশ্চিত করে চিকিৎসক বলেছেন, ওই রোগে আক্রান্ত হলে আস্তে আস্তে রোগীর মাংসপেশি শক্ত হয়। চলাচলের ক্ষমতা হারায়। অকালেই মৃত্যু অনিবার্য হয়ে ওঠে। তোফাজ্জেল হোসেনের বড় ছেলে বর্তমানে চলাচলের ক্ষমতা হারিয়ে মৃত্যুর প্রহর গুনছে। একজন পিতা হয়ে এ দৃশ্য দেখা কতোটা কষ্টকর তা জগতের বিবেকবান সকল পিতা-মাতা নিশ্চয় উপলব্ধি করতে পারছেন।
মরতে তো একদিন হবেই। তাই বলে মৃত্যুর কাছে আত্মসমর্পণ করে ক’জন? পরাজিতদেরই আত্মসমর্পণ করতে দেখা যায়। আর যারা জীবনযুদ্ধে সফল তাদের অধিকাংশই জনমটাকে স্বার্থক করার লড়াইয়ে অবতীর্ণ হন। যেমন বিশ্বের সমকালীন তাত্ত্বিক পদার্থবিদদের মধ্যে অন্যতম পদার্থবিজ্ঞানী ও গণিতজ্ঞ স্টিফেন হকিং মৃত্যুকে জয় করে শুধু বিশ্ব নন্দিতই হননি, তিনি মানবজাতির জন্য যা রেখে চলেছেন তা যুগে যুগে তাকে বাঁচিয়ে রাখবে। অথচ এই হকিঙের ২৭ বছরেই মারা যাওয়ার কথা ছিলো। যে রোগে আক্রান্ত তিনি তাতে তেমনই হওয়ার কথা। অথচ শারীরিকভাবে ভীষণরকম অচল এবং এএলএসের (এমায়োট্রফিক ল্যাটারাল সেক্লরোসিস বা লাউ গেহরিগ রোগ – যা এক প্রকার মোটর নিউরন রোগ) জন্য ক্রমাগতভাবে সম্পূর্ণ অর্থবতার দিকে ধাবিত হওয়া স্বত্বেও বহু বছর যাবত তিনি তার গবেষণা কার্যক্রম সাফল্যের সাথে চালিয়ে যাচ্ছেন। কি করে সম্ভব হচ্ছে? বর্তমানে ৭৫ বছর বয়সেও তিনি যেমন অসম্ভব আত্মবিশ্বাসী, তেমনই তাকে ঘিরে রয়েছে আধুনিক সুচিকিৎসার সুশীতল ছায়া। অথচ মেহেরপুরের ফলব্যবসায়ী তোফাজ্জেল তার দু সন্তান ও এক নাতিকে নিয়ে ন্যূনতম আশাবাদী হতে পারছেন না। কারণ আমরা এখনও আমাদের সুচিকিৎসার বিষয়টি নিশ্চিত করতে পারিনি। চিকিৎসাক্ষেত্রে যতোটুকু পেরেছি তার প্রায় পুরোটাই হতাশায় ঘেরা। অবিশ্বাসে মোড়োনো সরকারি বেশির ভাগ স্বাস্থ্যসেবাদান কেন্দ্র। অথচ এমনটি হওয়ার কথা ছিলো না, এমনটি হওয়ার কথা নয়।
তোফাজ্জেল হোসেনের দু ছেলে ও এক নাতির সুচিকিৎসা নিশ্চিত করতে হবে। সরকারের পদস্থ কর্তাদের যদি বিদেশে চিকিৎসা নিতে যাওয়ার সুযোগ মেলে তাহলে তোফাজ্জেলের দু ছেলে ও নাতির তা মিলবে না কেন? যদিও পদস্থ কর্তার সুস্থ রাখতে পারলে জাতি যতোটা উপকৃত হয় অতোটা নিশ্চয় গ্রামবাংলার একজন খেটে খাওয়া মানুষের ক্ষেত্রে নয়। তাই বলে কাউকেই কি তুচ্ছ ভেবে সুচিকিৎসা থেকে বঞ্চিত করা যায়? সাধ্যের পরিধি বাড়াতে হবে, নিশ্চিত করতে হবে চিকিৎসা পাওয়ার অধিকার।