২ সন্তান ও ১ নাতিকে নিয়ে অসহায় তোফাজ্জেলের মেহেরপুর জেলা প্রশাসকের কাছে করুণ আর্জি
মেহেরপুর অফিস: হয় চিকিৎসার সু-ব্যবস্থা করুন, নয়তো বিষাক্ত ওষুধ প্রয়োগ করে মেরে ফেলার অনুমতি দিন। আমি আর পেরে উঠছি না। বাবা হয়ে দুই ছেলে আর নানা হয়ে নাতির অসহায়ত্ব দেখে আত্মহত্যা করতেও পারছি না। এমন আকুতি জানিয়ে মেহেরপুর জেলা প্রশাসক বরাবর একটি আবেদন জানিয়েছেন শহরের ফলব্যবসায়ী তোফাজ্জেল হোসেন। তার বাড়ি শহরের বেড়পাড়া এলাকায়। জেলা প্রশাসকের অনুপস্থিতিতে মানবিক আবেদনটি গ্রহণ করেন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক খায়রুল হাসান।
আবেদনকারী তার আবেদন পত্রে জানিয়েছেন, তার স্ত্রী একজন মানসিক প্রতিবন্ধী। তার দুই ছেলে এবং এক মেয়ে রয়েছে। বড় ছেলে আব্দুস সবুরের বয়স ২৪ বছর। আর ছোট ছেলে রায়হানুল ইসলামের বয়স ১৩ বছর। দুটি ছেলেই দূরারোগ্য ব্যধি ডুফিনি মাসকুলার ডেসট্রোফি রোগে আক্রান্ত। আবার একমাত্র নাতি সৌরভ (৮) ওই একই রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। বড় ছেলের বয়স যখন আট বছর তখন সে এ রোগে আক্রান্ত হয়। ছোট ছেলেটিও একই বয়সে একই রোগে আক্রান্ত হয়েছে। দেশে এবং ভারতে বড় ছেলের চিকিৎসা করতে গিয়ে জমানো টাকা, জমি-জমা, দোকান-পাট, অস্থায়ী সম্পদ সবই বিক্রি করে নিঃস্ব হয়ে পড়েছি। এখন দুই ছেলে আর নাতনির ক্রমশঃ মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। নিকটাত্মীয়রা সাহায্যের হাত বাড়ালেও এখন তাও বন্ধ করে দিয়েছে। এখন সবার মুখে দু মুঠো ভাত তুলে দিতেই হিমসিম খাচ্ছি।
এদিকে দুই ছেলেকে চিকিৎসার জন্য বাংলাদেশের বিভিন্ন হাসপাতালের পাশাপাশি ভারতের কয়েকটি হাসপাতালে হেঁটেছেন তোফাজ্জেল হোসেন। ভারতের কেয়ার হাসপাতালের শিশু-বিশেষজ্ঞ গৌরাঙ্গ ম-ল, তপন কুমার বিশ্বাস, ভারতের কোঠারি মেডিকেল সেন্টারের শিশু বিশেষজ্ঞ ড. স্বপন মুখার্জি সবুরের মল-মূত্র, রক্ত, কফ পরীক্ষা করে নিশ্চিত হন ডুফিনি মাসকুলার ডিসট্রোফি ডিজিজ হয়েছে। দেশের কয়েকজন চিকিৎসক একই কথা বলেছেন। ভারতে চিকিৎসার সময় ডাক্তার বলেছিলেন, দূরারোগ্য ব্যধিটির নাম ডুফিনি মাসকুলার ডেসট্রোফি। বয়স বাড়ার সাথে সাথে রোগীর মাংস পেশি শক্ত হয়ে যাবে এবং চলাচলের ক্ষমতা হারিয়ে ফেলবে। আস্তে আস্তে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাবে। এরই মধ্যে বড় ছেলেটি চলাচলের ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে। নিজে নিজে কোনো রকমের নড়াচড়া করতে পারছে না। ছোট ছেলে এবং নাতনিটিও একই পথে এগিয়ে যাচ্ছে। চোখের সামনে তাদের কষ্ট আর মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাওয়া দেখে সহ্য করতে পারছি না। বর্তমানে তাদের চিকিৎসা করার কোনো সক্ষমতা তার নেই। তাই হয় তাদের সরকারিভাবে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হোক আর না হয় মেরে ফেলার অনুমতি দেয়া হোক।
সন্তানদের চিকিৎসার জন্য তোফাজ্জেল হোসেন দেশের বিভিন্ন ধর্ণাঢ্য ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান, দূতাবাসেও ছুটে গেছেন। ঢাকায় ফ্রান্স দূতাবাস সহযোগিতা দিতে ইন্টারনেটের মাধ্যমে বিশ্বের চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের কাছে এ রোগের ওষুধ কী জানতে চায়। শ শ চিকিৎসক ইন্টারনেটে জানিয়েছেন, এখনো এই রোগের কোনো ওষুধ আবিষ্কার হয়নি। ফলে তোফাজ্জেল হতাশ হয়ে পড়েন। ক্যান্সারের চেয়েও এ রোগ ভয়াবহ উল্লেখ করে কয়েকজন শিশু বিশেষজ্ঞ বলেছেন, আক্রান্তের শরীরে সব অংশের মাংসপেশি আস্তে আস্তে জমাট বেঁধে যাবে। চলাফেরা বন্ধের সাথে সাথে কথা বলার শক্তিও হারিয়ে যাবে। তাই চিকিৎসায় সুফল মিলবে না। বয়স বাড়ার সাথে সাথে বাড়বে যন্ত্রণাও।
ভারতের একটি স্বনামধন্য হোমিও চিকিৎসক তোফাজ্জেল হোসেনকে বলেছেন, দীর্ঘ মেয়াদী চিকিৎসায় এ রোগ সারিয়ে তোলা সম্ভব। কিন্তু অর্থের অভাবে সেখানে তিনি সন্তানদের নিয়ে যেতে পারছে না। শেষ চেষ্টা হিসেবে তিনি সেখানে নিয়ে যেতে চান। তাই সন্তানদের ভরণ-পোষণ ও চিকিৎসার জন্য সহৃদয় ব্যক্তিদের কাছে সাহায্যের আবেদন করেছেন তোফাজ্জেল হোসেন।
তোফাজ্জেল হোসেনের আবেদনের প্রেক্ষিতে গতকাল শুক্রবার দুপুরে তার বাড়ি পরিদর্শন করেছেন মেহেরপুর জেলা প্রশাসক পরিমল সিংহ। তিনি পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানিয়ে তাদের কিছু ব্যয় বহনের ঘোষণা দেন। জেলা প্রশাসক বলেন, বিষয়টি অত্যন্ত মানবিক ও হৃদয় বিদারক। আবেদনটি পড়ে চোখের পানি ধরে রাখতে পারিনি। এই পরিবারের জন্য আমি সাধ্যমতো চেষ্টা করবো। সমাজের সকলকেই অসহায় পরিবারটির পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানান তিনি। তোফাজ্জেল হোসেনের চোখে এখন শুধুই জল। দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে তিনি চোখের পানিতে বুক ভাসাচ্ছেন। কিন্তু উপায় মিলছে না। উপরন্তু চোখের সামনে নিভে যেতে বসছে দুই সন্তান ও নাতির জীবনপ্রদীপ। একজন পিতার পক্ষে সন্তানের মৃত্যু যন্ত্রণা কতোটা ব্যথার তা শুধুই জানেন ব্যথিতরা। পৃথিবীতে সবচেয়ে কঠিন কাজ হচ্ছে পিতার কাছে সন্তানের লাশ।
অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক খায়রুল হাসান জানান, আবেদনের বিষয়টি অত্যন্ত মানবিক। আবেদনটি হাতে নিয়ে চোখের পানি ধরে রাখতে পারিনি। চাকরি কিংবা প্রাত্যহিক জীবনে এমন ঘটনা এর আগে দেখিনি। তাদের চিকিৎসার কাগজপত্র এবং আবেদনপত্র দিয়ে বিভাগীয় কমিশনারের মাধ্যমে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করবো। একই সাথে তিনি সমাজের বিত্তবানদের এগিয়ে আসারও আহ্বান জানান। অসহায় বাবা তোফাজ্জেলের ফোন নম্বর- ০১৭১০-০৩৩৬৪৩।