নূর হোসেন ও তারেক সাঈদসহ ২৬ জনের ফাঁসির আদেশ

নারায়ণগঞ্জের চাঞ্চল্যকর সাত খুন মামলার রায় :

মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তদের ১৬ জনই র‌্যাব কর্মকর্তা-সদস্য : এরা মানবতাবিরোধী অপরাধী- আদালত : আরও ৯ আসামির বিভিন্ন মেয়াদে সাজা

স্টাফ রিপোর্টার: নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের ঘটনাকে মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসাবে ঘোষণা করেছেন আদালত। আর এই অপরাধের দায়ে র‌্যাবের তত্কালীন কমান্ডিং অফিসার লে. কর্নেল তারেক সাঈদ মোহাম্মদ এবং নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের সাবেক ওয়ার্ড কাউন্সিলর নূর হোসেনসহ ২৬ জনকে ফাঁসির রশিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের আদেশ দিয়েছেন আদালত। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তদের মধ্যে ১৬ জনই র‌্যাব-১১’র তত্কালীন কর্মকর্তা ও সদস্য। বাকিরা নূর হোসেনের সহযোগী। মৃত্যুদণ্ড ছাড়াও আরো নয়জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ডের আদেশ দেয়া হয়েছে। নারায়ণগঞ্জের জেলা ও দায়রা জজ সৈয়দ এনায়েত হোসেন গতকাল সোমবার সকাল ১০টা ৪ মিনিটে জনাকীর্ণ আদালতে এই রায় ঘোষণা করেন। রায়ে বলা হয়, এই জঘন্য অপরাধ সাধারণ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা মিলে করেছে। এটা একটি জাতির জন্য খুবই লজ্জাকর যে সাধারণ মানুষের জানমালের নিরাপত্তার জন্য নিয়োজিত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা এই জঘন্য অপহরণ, হত্যা এবং অতঃপর লাশ গুমের কাজ করেছে। তারা পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী এই হত্যাকাণ্ড ও অপরাধ সংঘটিত করেছে। ১৬২ পৃষ্ঠার এই রায়ের শুধু আদেশের অংশ আদালতে পাঠ করে শোনানো হয়। রায় ঘোষণা শেষে জেলা ও দায়রা জজ তার খাস কামরায় চলে যান। অপরাধ সংঘটনের ৩৩ মাসের মধ্যে নিম্ন আদালতে জঘন্য এই হত্যাকাণ্ডের বিচার শেষ হলো।

মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত অন্য আসামিরা হলেন- ওই সময়ে র‌্যাব-১১ তে কর্মরত (ঘটনার পর বাধ্যতামূলক অবসরপ্রাপ্ত) মেজর আরিফ হোসেন, নৌবাহিনীর লে. কমান্ডার মাসুদ রানা, এসআই পূর্ণেন্দু বালা, হাবিলদার এমদাদুল হক, কনস্টেবল শিহাব উদ্দিন, আরওজি-১ আরিফ হোসেন, ল্যান্স নায়েক হীরা মিয়া, বেলাল হোসেন, সৈনিক আবদুল আলীম, সিপাহী আবু তৈয়্যব, সিপাহী আসাদুজ্জামান নূর, সৈনিক মহিউদ্দিন মুন্সী, সৈনিক আলামিন, সৈনিক তাজুল ইসলাম ও সার্জেন্ট এনামুল কবির এবং নূর হোসেনের সহযোগী সেলিম, সানাউল্লাহ সানা, শাহজাহান, জামাল উদ্দিন, মোর্তুজা জামান চার্চিল, আলী মোহাম্মদ, মিজানুর রহমান দীপু, রহম আলী ও আবুল বাশার। র‌্যাবের বরখাস্তকৃত ৯ কর্মকর্তা ও সদস্যকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। এদের মধ্যে কনস্টেবল হাবিবুর রহমানকে ১৭ বছর, এএসআই আবুল কালাম আজাদ, এএসআই কামাল হোসেন, কনস্টেবল বাবুল হাসান, করপোরাল মোখলেসুর রহমান, ল্যান্স করপোরাল রুহুল আমিন, সিপাহী নুরুজ্জামানের প্রত্যেককে দশ বছর এবং এএসআই বজলুর রহমান ও হাবিলদার নাসির উদ্দিনকে সাত বছর করে দণ্ড দিয়েছেন আদালত। দণ্ডপ্রাপ্তদের মধ্যে এখনও ১১ জন পলাতক রয়েছেন। এরা হলেন- মোখলেস, আব্দুল আলীম, মহিউদ্দিন মুন্সি, আলামীন, তাজুল ইসলাম, সার্জেন্ট এনামুল কবির, কামাল হোসেন, হাবিবুর রহমান, সেলিম, শাহজাহান ও জামালউদ্দিন।

এদিকে রায় ঘোষণাকে কেন্দ্র করে বিচারকের বাসভবন, আদালত প্রাঙ্গণ ও তার আশপাশের এলাকায় নিরাপত্তা জোরদার করা হয়। আদালত প্রাঙ্গণে প্রবেশের দুটি ফটক বন্ধ করে দেয়া হয়। এমনকি আদালতের অভ্যন্তরেও তত্পরতা ছিলো আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর। রায় শোনার জন্য আদালতের বাইরে শ শ সাধারণ মানুষ, আইনজীবী ও নিহতদের পরিবারের সদস্য ও আত্মীয়স্বজন অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করেন। সকাল ৯টা থেকে আসামিদের কাঠগড়ায় ওঠানো শুরু হয়। র‌্যাবের সাবেক তিন র্কমর্কতা তারেক সাঈদ, আরিফ হোসেন ও মাসুদ রানাকে সকাল ৯টা ৫০ মিনিটে আদালতকক্ষে নেয়া হয়। তাদের পায়ে ডাণ্ডাবেড়ি ছিলো না। নিরাপত্তার স্বার্থে তাদের কাঠগড়ার বাইরে রাখা হয়। একই সময়ে নূর হোসেনকেও হেলমেট পরিহিত অবস্থায় আদালতে হাজির করা হয়।

ঘড়ির কাঁটায় তখন ১০টা, এজলাসে আসেন নারায়ণগঞ্জের জেলা ও দায়রা জজ সৈয়দ এনায়েত হোসেন। বিচারক প্রথমেই আদালতে আসামিদের উপস্থিতির বিষয়টি নিশ্চিত হন। ১০টা ৪ মিনিটে তিনি রায় পড়া শুরু করেন। রায় ঘোষণার সময় বেশ গম্ভীর দেখা যায় নূর হোসেন ও তার সহযোগীদের। মাত্র ৫ মিনিটের মধ্যে বিচারক রায় ঘোষণা করে তার খাস কামড়ায় চলে যান। এ সময় কান্না ভেঙে পড়েন তারেক সাঈদ। রায় ঘোষণার পরপরই আসামিদের নিয়ে পুলিশ বের হয়ে যায়। এ সময় এক আসামি স্যান্ডেল খুলে জনগণের দিকে মারতে চাইলে পুলিশ তাকে থামায়। তবে তার নাম জানা যায়নি। এ সময় আদালতের ভেতরে কান্নাকাটি করতে দেখা যায় নিহত ওয়ার্ড কাউন্সিলর নজরুল ইসলামের স্ত্রী ও পিতাকে। তারা উপস্থিত সাংবাদিকদের বলেন, আমরা যাদের আসামি করেছিলাম তাদের সকলকে শাস্তি দেয়া সম্ভব হয়নি। রায় ঘোষণার পর আওয়ামী পন্থি ও বিএনপি পন্থি আইনজীবীরা আলাদা আনন্দ মিছিল বের করেন। আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট সাখাওয়াত হোসেন খান, বর্তমান সভাপতি আনিছুর রহমান দিপু ও মাহবুবুর রহমান মাসুম সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে রায়কে স্বাগত জানান।

সাখাওয়াত হোসেন খান বলেন, রায়ে আমরা সন্তুষ্ট, তবে ৩৫ জনের মৃত্যুদণ্ড আশা করেছিলাম। এখন যে রায় দেয়া হয়েছে তা যেন দ্রুত কার্যকর করা হয়। তিনি রায়কে দৃষ্টান্তমূলক রায় আখ্যায়িত করে বলেন, অন্যায়কারীরা এই রায় দেখে শিক্ষা নেবে। মামলার প্রধান আসামি নূর হোসেনের আইনজীবী খোকন সাহা বলেন, নূর হোসেন তাকে বলেছেন অন্যায়ভাবে তাকে ফাঁসানো হয়েছে। তারা উচ্চ আদালতে আপিল করবেন। প্রবীণ আইনজীবী আব্দুল মজিদ খন্দকার বলেন, শুধু বাংলাদেশে নয়, বিশ্বের কোথাও সিভিল আদালতে একসাথে এতো মৃত্যুদণ্ডের এমন রায়ের নজির খুবই বিরল। তিনি রায়কে ইতিহাসের অংশ হিসেবে অভিহিত করেন। নারায়ণগঞ্জ জেলা ও দায়রা জজ আদালতের পিপি ওয়াজেদ আলী খোকন বলেন, রায়ে আমরা সন্তুষ্ট। আদালতের কাছে সাক্ষ্য- প্রমাণসহ যাবতীয় তথ্যাদি উপস্থাপন করতে পেরেছি বলেই আদালত দৃষ্টান্তমূলক রায় দিয়েছে।

উল্লেখ্য, ২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোডের ফতুল্লার লামাপাড়া এলাকা থেকে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের তত্কালীন ওয়ার্ড কাউন্সিলর নজরুল ইসলামসহ ৭ জনকে অপহরণ করা হয়। তিন দিন পর ছয়জনের এবং পরদিন আরেক জনের লাশ শীতলক্ষ্যায় ভেসে ওঠে। ওই ঘটনায় নিহত হন নজরুল ইসলাম, তার বন্ধু মনিরুজ্জামান স্বপন, তাজুল ইসলাম, লিটন, নজরুলের গাড়িচালক জাহাঙ্গীর আলম, আইনজীবী চন্দন কুমার সরকার ও তার গাড়িচালক ইব্রাহিম। নজরুল ও তার ৪ সহকর্মী হত্যার ঘটনায় নজরুলের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম বিউটি বাদী হয়ে ফতুল্লা থানায় ২৮ এপ্রিল একটি এবং সিনিয়র আইনজীবী চন্দন সরকার ও তার গাড়ির চালক ইব্রাহিম হত্যার ঘটনায় বিজয় কুমার পাল বাদী হয়ে একই থানায় আরেকটি মামলা দায়ের করেন।

প্রায় এক বছর তদন্ত শেষে ২০১৫ সালের ৮ এপ্রিল তদন্ত কর্মকর্তা মামুনুর রশীদ মণ্ডল, সাবেক কাউন্সিলর নূর হোসেন, র‌্যাবের সাবেক তিন কর্মকর্তাসহ ৩৫ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। গত বছরের ৮ ফেব্রুয়ারি ৭ খুনের দুটি মামলায় নূর হোসেন ও র‌্যাবের সাবেক তিন কর্মকর্তাসহ ২৩ আসামির উপস্থিতিতে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরু করেন আদালত। র‌্যাবের ৮ সদস্যসহ পলাতক ১২ আসামির অনুপস্থিতিতেই বিচারকার্য সম্পন্ন হয়েছে। তবে পলাতক ১২ আসামির পক্ষে রাষ্ট্রীয় খরচে ৫ জন আইনজীবীকে নিয়োগ দেয়া হয়। দুটি মামলারই অভিন্ন সাক্ষী ১২৭ জন করে। তাদের মধ্যে তদন্ত কর্মকর্তাসহ ১০৮ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ করেছেন আদালত। মামলার সর্বশেষ ধাপ উভয়পক্ষের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে গত বছরের ৩০ নভেম্বর তারিখে রায়ের জন্য গতকাল ১৬ জানুয়ারি রায় ঘোষণার দিন র্ধায করেন আদালত। আসামিদের মধ্যে ১৮ জনকে নারায়ণগঞ্জ জেলা কারাগার থেকে এবং নূর হোসেনসহ ৫ জনকে কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার পার্ট-২ থেকে আদালতে আনা হয়। এই রায়ের মধ্যদিয়ে বিচার বিভাগ ও সরকারের প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা বাড়লো বলে সাধারণ মানুষ মনে করেন।