বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্ব শুরু আজ : লাখো মুসল্লির ঢল

 

স্টাফ রিপোর্টার: টঙ্গীর তুরাগ তীরে আজ শুক্রবার তাবলীগ জামাতের শীর্ষ মুরব্বিদের আম বয়ানের মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছে বিশ্ব মুসলিম জাহানের দ্বিতীয় বৃহত্তম সম্মিলন বিশ্ব ইজতেমা। ইজতেমাকে সামনে রেখে ইতোমধ্যে ময়দানের সকল কাজ সম্পন্ন হয়েছে। পবিত্র হজ্বের পর বিশ্ব মুসলিম জাহানের দ্বিতীয় মহাসমাবেশ এটি। কনকনে শীত উপেক্ষা করে ধর্মপ্রাণ মুসল্লিদের ঢল এখন টঙ্গীমুখী। ইবাদাত-বন্দেগীর মোক্ষম সময় হূদয়ে ধারণ করে মুসল্লিদের স্রোত টঙ্গী অভিমুখে বেড়েই চলছে। এ স্রোত থাকবে আখেরি মোনাজাতের আগ পর্যন্ত। আজ ইজতেমা ময়দানে দেশের বৃহত্তম জুমার জামাত অনুষ্ঠিত হবে।

বিশ্ব ইজতেমা আজ শুরু হলেও গত ১১ জানুয়ারি বুধবার বিকাল থেকে জামাতবদ্ধ মুসল্লি­রা ইজতেমা মাঠে আসতে শুরু করেছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আয়োজন কমিটির এক মুরব্বি জানান, অতীতে বাংলাদেশসহ সারা বিশ্ব থেকে আগত মুসল্লিদের ইজতেমা মাঠে স্থান সংকুলান না হওয়ায় আখেরী মোনাজাতে অংশ নিতে সমস্যা হতো। যাতে কোনো রকম অসুবিধা না হয় সে বিবেচনা মাথায় রেখে দেশের ৬৪টি জেলাকে ২ ভাগে ভাগ করা হয়েছে। এদের মধ্যে এবছর নির্দিষ্ট ৩২ জেলার মুসল্লিরা বিশ্ব ইজতেমায় অংশগ্রহণ করবেন। প্রথম পর্বে ১৬ জেলা এবং দ্বিতীয় পর্বে ১৬ জেলার মুসল্লিরা তাদের জন্য নির্ধারিত খিত্তায় অবস্থান নিয়ে ইবাদত বন্দেগিতে মশগুল থাকবেন। তবে ঢাকা জেলার মুসল্লিরা দুই পর্বেই অংশ নেবেন। সারা দেশের জামাতবদ্ধ মুসল্লি­দের জেলাওয়ারি দুই দফায় ভাগ করা হয়েছে। কোন কোন জেলার মুসল্লি­ কোন দফায় অংশ নেবেন সে দিক-নির্দেশনাও ইতোমধ্যে দেওয়া হয়েছে। মাঠে মুসল্লিদের অবস্থানও জেলাওয়ারি নির্দিষ্ট খিত্তায় (ভাগে) বিভক্ত করা হয়েছে। প্রথম দফায় পুরো মাঠকে ২৭টি খিত্তায় এবং দ্বিতীয় দফায় ২৬টি খিত্তায় ভাগ করা হয়েছে।

এবারের ইজতেমায় বিশ্বের শতাধিক দেশের প্রায় ২০ হাজার বিদেশি মেহমান আখেরি মোনাজাতে অংশগ্রহণ করবেন বলে আশা করা হচ্ছে। দেশি-বিদেশি ইসলামী চিন্তাবিদ ও ওলামায়ে কেরামগণ ছয় উসুল যথা- ঈমান, নামাজ, এলেম ও জিকির, একরামুল মুসলিমীন, তাসহীহ নিয়ত, দাওয়াত ও তাবলীগ সম্পর্কে বিভিন্ন দিক-নির্দেশনামূলক মূল্যবান বয়ান রাখবেন। মূল বয়ান সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন ভাষায় তরজমা করা হবে।

এবারের বিশ্ব ইজতেমায় যেসব জেলার মুসল্লিরা অংশ নিবেন: প্রথমপর্বে ১৬ জেলার মধ্যে ঢাকা জেলার (খিত্তা নং-১, ২, ৩, ৪, ৫), টাঙ্গাইল (খিত্তা নং-৬, ৭, ৮), ময়মনসিংহ (খিত্তা নং-৯, ১০, ১১), মৌলভীবাজার (খিত্তা নং-১২), ব্রাহ্মণবাড়িয়া (খিত্তা নং-১৩), মানিকগঞ্জ (খিত্তা নং-১৪), জয়পুরহাট (খিত্তা নং-১৫), চাঁপাইনবাবগঞ্জ (খিত্তা নং-১৬), রংপুর (খিত্তা নং-১৭), গাজীপুর (খিত্তা নং-১৮, ১৯), রাঙ্গামাটি (খিত্তা নং-২০), খাগড়াছড়ি (খিত্তা নং-২১), বান্দরবান (খিত্তা নং-২২), গোপালগঞ্জ (খিত্তা নং-২৩), শরীয়তপুর (খিত্তা নং-২৪), সাতক্ষীরা (খিত্তা নং-২৫), যশোর (খিত্তা নং-২৬, ২৭) এবং দ্বিতীয় পর্বে ঢাকা জেলা (খিত্তা নং-১, ২, ৩, ৪, ৫, ৭), মেহেরপুর (খিত্তা নং-৬), লালমনিরহাট (খিত্তা নং-৮), রাজবাড়ি (খিত্তা নং-৯), দিনাজপুর (খিত্তা নং-১০), হবিগঞ্জ (খিত্তা নং-১১), মুন্সিগঞ্জ (খিত্তা নং-১২, ১৩), কিশোরগঞ্জ (খিত্তা নং-১৪, ১৫), কক্সবাজার (খিত্তা নং-১৬), নোয়াখালী (খিত্তা নং-১৭, ১৮), বাগেরহাট (খিত্তা নং-১৯), চাঁদপুর (খিত্তা নং-২০), পাবনা (খিত্তা নং-২১, ২২), নওগাঁ (খিত্তা নং-২৩), কুষ্টিয়া (খিত্তা নং-২৪), বরগুনা (খিত্তা নং-২৫) ও বরিশাল (খিত্তা নং-২৬)।

ধর্মমন্ত্রীর ইজতেমা ময়দান পরিদর্শন: গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে ধর্মমন্ত্রী অধ্যক্ষ মতিউর রহমান টঙ্গী ইজতেমা মাঠ পরিদর্শনে আসেন। এসময় তিনি ময়দানের উত্তর পাশে মন্নু টেক্সটাইল মিলের মাঠে স্থাপিত হামদর্দ ফ্রি মেডিক্যাল ক্যাম্প উদ্বোধন করেন। হামদর্দ ল্যাবরেটরিজ (ওয়াকফ)-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও চিফ মোতাওয়াল্ল­­­ী ড. হাকিম মো. ইউসুফ হারুন ভুঁইয়ার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন গাজীপুর-২ আসনের সংসদ সদস্য মো. জাহিদ আহসান রাসেল, গাজীপুর সিটি করপোরেশনের ভারপ্রাপ্ত মেয়র মো. আসাদুর রহমান কিরণ, হামদর্দ ফাউন্ডেশনের পরিচালক লে. কর্নেল মাহবুবুল আলম চৌধুরী, ধর্ম মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম-সচিব মো. হাফিজুর রহমান, গাজীপুর জেলা ওষুধ প্রশাসনের সহকারী পরিচালক মো. আক্তার হোসেন, কাউন্সিলর আবুল হোসেন প্রমুখ। প্রধান অতিথির বক্তৃতায় ধর্মমন্ত্রী বলেন, হামদর্দ আর্তপীড়িত ও দুস্থ মানুষের কল্যাণে নিয়োজিত। বিশ্ব ইজতেমায় আগত লাখ লাখ মুসল্লিকে বিনামূল্যে চিকিত্সা প্রদানের জন্য হামদর্দ প্রতিবছর যে উদ্যোগ গ্রহণ করে তা সত্যিই প্রশংসনীয়। ময়দান পরিদর্শনকালে গাজীপুর-২ আসনের এমপি মো. জাহিদ আহসান রাসেল বলেন, এবারও বিশ্ব ইজতেমা দুই পর্বে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। ইতোমধ্যে বিশ্বইজতেমার সকল কার্যক্রম সুষ্ঠভাবে সম্পন্ন হয়েছে। দেশ-বিদেশের কয়েক লাখ মুসল্লি ময়দানে সমবেত হয়েছেন।

পুলিশ প্রশাসনের প্রেসব্রিফিং: গতকাল বিশ্ব ইজতেমা ময়দানের আইন-শৃংখলা নিয়ে শহীদ আহসান উল্লাহ মাস্টার স্টেডিয়ামে এক প্রেস ব্রিফিং অনুষ্ঠিত হয়েছে। সাংবাদিকদের ব্রিফিংকালে গাজীপুর পুলিশ সুপার মো. হারুন-অর-রশিদ জানান, এবার ইজতেমা মাঠের নিরাপত্তার জন্য প্রথম পর্বে ৬ হাজার পুলিশ, র্যাব, আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন পুলিশ, সাদা পোশাকধারীসহ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রায় ৮ হাজার সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে। এবারই প্রথমবারের মতো ইজতেমা ময়দান ছাড়াও এর বাইরে সিসি ক্যামেরার আওতায় আনা হয়েছে। র্যাব ও পুলিশ পৃথক পৃথকভাবে সিসি ক্যামেরার মাধ্যমে ইজতেমা ময়দানের সার্বিক নিরাপত্তা মনিটরিং করছে। এছাড়া বাইনোকুলার, মেটাল ডিটেক্টর দিয়ে তল্লাশি করা হচ্ছে। ইজতেমা ময়দানের সব প্রবেশ পথে শতাধিক ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা ও বিভিন্ন পয়েন্টে ১৪টি পর্যবেক্ষণ টাউয়ার রয়েছে। গোয়েন্দা তথ্য ও সকল ধরনের হুমকি মাথায় রেখে ইজতেমার নিরাপত্তা ব্যবস্থা সাজানো হয়েছে।

বিশ্ব ইজতেমার নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে সাংবাদিকদের ব্রিফিংকালে র্যাবের মহাপরিচালক বেনজির আহমেদ বলেন, গোয়েন্দা তথ্য ও সকল ধরনের হুমকি মাথায় রেখে ইজতেমার নিরাপত্তা ব্যবস্থা সাজানো হয়েছে। এজন্য ইজতেমাস্থল ও আশপাশের এলাকাকে দুইটি সেক্টরে ভাগ করে নিরাপত্তা বলয় তৈরি করা হয়েছে। ভূমিতে মোটরসাইকেল টহল, পদাতিক টহল, ছদ্মবেশে নিরাপত্তা টহল, সাদা পোশাকে নিরাপত্তা টহল, সিসি টিভি ক্যামেরা, অবজারভেশন পোস্ট, মোবাইল টহল, রাত্রীকালিন নাইট ভিশন ক্যামেরার সাহায্যে নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। তুরাগ নদীতে স্পিড বোট টহল ও আকাশে হেলিকপ্টারের টহল থাকবে। তিনি গতকাল বিকালে টঙ্গিতে তুরাগ নদের তীরে ইজতেমা ময়দানে র্যাবের নিয়ন্ত্রণ কক্ষে আয়োজিত ব্রিফিংয়ে সাংবাদিকদের এসব কথা বলেন। এসময় র্যাবের মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খানসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাগণ উপস্থিত ছিলেন।

বিশেষ পরীক্ষণ যন্ত্র: ইজতেমা ময়দানে বিদেশি নিবাসের তিনটি রাস্তায় একটি করে আর্চওয়ে নামের বিশেষ পরীক্ষণ যন্ত্র স্থাপন করা হয়েছে। যার ভেতর দিয়ে কেউ কোনো ধরনের বিস্ফোরক নিয়ে প্রবেশ করলে বিশেষ সিগনাল প্রদান করবে। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন গাজীপুর পুলিশ সুপার।

ইজতেমায় এক মুসল্লির মৃত্যু: টঙ্গি বিশ্ব ইজতেমা ময়দানে গতকাল মো. ফজলুল হক (৫৬) নামের এক মুসল্লির মৃত্যু হয়েছে। তিনি ময়মনসিংহ জেলার নান্দাইল থানার মারুয়া আহম্মদ আলীর ছেলে। নিহতের লাশ জানাজা শেষে গতকাল গ্রামের বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।

ধুলায় ধূসর ইজতেমা ময়দান: বিশ্ব ইজতেমা ময়দানে নতুন করে বালি ফেলে উঁচু করা এবং মুসল্লিদের যাতায়াতের রাস্তাগুলোয় পানি না ছিটানোয় ধুলায় ধূসর হচ্ছেন ময়দানে আগত মুসল্লিরা। এতে করে রোগ জীবাণু ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।

ইজতেমা কমিটি বক্তব্য: বিশ্ব ইজতেমা আয়োজক কমিটির শীর্ষ মুরুব্বি প্রকৌশলী মো. গিয়াস উদ্দিন জানান, ইতোমধ্যে ইজতেমা ময়দানের প্রস্তুতির কাজ সম্পন্ন হয়েছে। প্রথম পর্বে অংশগ্রহণকারী ধর্মপ্রাণ মুসল্লিরা ময়দানে স্ব-স্ব খিত্তায় এসে অবস্থান নিচ্ছেন। দেশের ৬৪টি জেলার মধ্যে ৩২ জেলার মুসল্লি­রা এবছর দুই দফায় ইজতেমায় অংশ নেবেন। প্রথম পর্বে ১৬ জেলা এবং দ্বিতীয় পর্বে ১৬ জেলার মুসল্লিরা বিশ্ব ইজতেমায় অংশগ্রহণ করবেন। তবে ঢাকা জেলার মুসল্লিরা দু পর্বেই অংশগ্রহণ করবেন। ইজতেমার আয়োজক তাবলিগ জামাতের স্বেচ্ছাসেবীদের প্রস্তুতি ছাড়াও ডেসকো, তিতাস, ওয়াসাসহ সরকারের সংশ্লিষ্ট সেবাদানকারী সংস্থাগুলোও তাদের প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছেন।

 

Leave a comment