আলমডাঙ্গার শিল্প সংস্কৃতির দুঃসময়ের কাণ্ডারী কলাকেন্দ্র ও মুক্তিযোদ্ধা সাংস্কৃতিক সংসদ

 

শরিফুল ইসলাম/আতিক বিশ্বাস: ডুগি-তবলা আর হারমোনিয়ামের তাল ও অমীয় সুরের মূর্ছনা ভেসে আসে বহুদুর অবধি। প্রতি শুক্রবার সারাদিনসহ প্রতিদিনের বিকেল সুর ও বাণীর অমীয় স্পর্শে মাতোয়ারা থাকে আলমডাঙ্গা উপজেলা চত্বর। আলমডাঙ্গা কলাকেন্দ্রের শিল্পীদের পদভারে আর নূপুর নিক্কনে বিভোর হয়ে উঠে উপজেলার এ বিশাল চত্বর। আলমডাঙ্গা শহরের প্রাণকেন্দ্র মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্সের পেছনের মঞ্চে প্রতি সন্ধ্যায় মুক্তিযোদ্ধা সাংস্কৃতিক সংসদের শিল্পীদের নিয়মিত রেওয়াজের সুললিত সুর পার্শ্ববর্তী করাতকলের পাশবিক গর্জনকে ছাপিয়ে কিছুক্ষণের জন্য হলেও এলাকাকে মুখরিত করে রাখে। মাঝে-মধ্যে গভীর রাত অবধি তাদের কণ্ঠশীলনের মাদকতা সকলকে মুগ্ধ করে।

আলমডাঙ্গা মফস্বল শহর হলেও এ শহরের পরিসর বেশ খানিকটা প্রশস্ত। ৮০ ও ৯০’র দশকে সাহিত্য আর সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে আলমডাঙ্গা ছিলো প্রাগ্রসর। সঙ্গীত, আবৃত্তি ও নৃত্যকলা শিক্ষার প্রায় এক ডজন সংঘ বা ক্লাব ছিলো। নাটকের ছিলো ৪/৫টি সংগঠন। তাছাড়া শহরের পাড়ায় পাড়ায় ছিলো সাংস্কৃতিক ক্লাব। কলেজের পাশ দিয়ে গেলেই শোনা যেত উচ্চ কণ্ঠে নাটকের ডায়ালগ। গ্রামও পিছিয়ে ছিলো না। ব্যারিস্টার বাদল রশিদের কল্যাণে প্রত্যন্ত রামদিয়া-কায়েতপাড়া গ্রাম নাট্য ও সঙ্গীত চর্চার উর্বরক্ষেত্রে পরিণত হয়েছিলো। হারদী-লক্ষ্মীপুর এলাকায় নাটক ও যাত্রাপালার ঐতিহ্য গড়ে উঠেছিলো। পাঁচলিয়া গ্রাম যাত্রাপালা ও তার রিহার্সেল নিয়ে ব্যস্ত ছিলো। ঘোলদাড়ি ও খাসকররা এলাকা সাংস্কৃতিচর্চার দিক দিয়ে মোটেও পিছিয়ে ছিলো না। বরাবরের মতো তখন হাটবোয়ালিয়াও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে তাদের সক্রিয়তা উচ্চকিত করে রেখেছিলো। বিভিন্ন জাতীয় দিনে সরকারি আয়োজন তো ছিলোই। তার বাইরেও শহরের প্রতিটি পাড়া-মহল্লায় সাংস্কৃতিক আয়োজন লেগেই থাকতো। নাটক মঞ্চস্থ হতো। এমন কি নিয়মিত নাট্য উৎসব হতো। ব্যস্ত সিনেমাহল ভাড়া করে চলতো সে নাট্যোৎসব। রীতিমত টিকেট কেটে ভিড় করে দেখতো সংস্কৃতিমনা দর্শক-শ্রোতা। প্রায় দেখা যেতো-সন্ধ্যা হলেই শহরবাসীর ব্যস্ততা বেড়ে যেত। গান অথবা নাটক মঞ্চ’র সামনের সারিতে বসার প্রতিযোগিতা ছিলো। উৎসবের আমেজ বিরাজ করতো মঞ্চস্থলসহ আশপাশ এলাকায়। ফলে ৮০ ও ৯০ দশকে বেড়ে উঠা মানুষের মাঝে সাংস্কৃতিক চেতনা গড়ে উঠেছিলো। এ সকল সাংস্কৃতিক মনস্করা এখনও বিভিন্ন ক্ষেত্রে আলমডাঙ্গার শ্রেষ্ঠ মানুষ হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছেন।

বছর বিশেক আগের কথা বললাম। এখন আর আলমডাঙ্গায় সেই সুস্থ সাংস্কৃতিক চর্চার ঘনঘটা নেই। নেই সুস্থ রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডও। সারা দেশের মতো কেমন জানি সব কিছু যান্ত্রিক হয়ে গেছে। সবক্ষেত্রেই অসহিষ্ণুতা, অস্থিরতা আর অশুভত্বের ডানা ঝাঁপটানি। একদিকে অসুস্থ রাজনীতি, অন্যদিকে সংস্কৃতিক অঙ্গনে পৃষ্ঠপোশকতা না থাকায় আলমডাঙ্গায় সাংস্কৃতিক পরিবেশ এখন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। এ শহরের মৃতপ্রায় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বাঁচিয়ে রেখেছেন কলাকেন্দ্রের ২ কর্ণধার- ইকবাল হোসেন-রেবা সাহা, মুক্তিযোদ্ধা সাংস্কৃতিক সংসদের সভাপতি আশরাফুল হক লুলু, সম্পাদক জামাল উদ্দীন মাস্টার, ডাক্তার আতিক বিশ্বাসসহ কতিপয় যুবক, মাটি সাংস্কৃতিক সংগঠনের মাসুদ রানা লিটন, তবলাবাদক তুষার, সুনীল কর্মকার, সুশীল কর্মকার, সৃষ্টি নাট্য সংগঠনের কিছু সৃষ্টিশীল যুবক। আজকের আলমডাঙ্গার সাংস্কৃতিক সারথি বলতে এরাই সবেমণিধন।