ট্রেনের ধাক্কায় শিশু রাফিন নিহত ॥ বিএনপি নেতা খোকনসহ আহত ৪

চুয়াডাঙ্গা আন্দুলবাড়িয়ার বেলতলায় অরক্ষিত রেলক্রসিঙে দুর্ঘটনার কবলে প্রাইভেটকার

 

জীবননগর ব্যুরো/আন্দুলবাড়িয়া প্রতিনিধি: চুয়াডাঙ্গার আন্দুলবাড়িয়ায় আবারও ট্রেনের ধাক্কায় প্রাইভেটকারে থাকা এক শিশুর মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছেন প্রাইভেটকার যাত্রী জীবননগর উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আনোয়ার হোসেন খোকনসহ ৪ জন। নিহত শিশু আহমেদ রাফিন মোক্তারপুর গ্রামের রেফাজ উদ্দিন রিপনের ছেলে। গতকাল বুধবার বেলা সাড়ে ১০টার দিকে আন্দুলবাড়িয়া-সরোজগঞ্জ সড়কের বেলতলা রেলক্রসিঙে এ মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ঘটে। স্থানীয়রা আহতদের উদ্ধার করে চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে ভর্তি করেন। বেলা আড়াইটার দিকে তাদের উন্নত চিকিৎসার জন্য দুটি হেলিকাপ্টারযোগে ঢাকায় নেয়া হয়।

20160915_114417           প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, জীবননগর উপজেলার আন্দুলবাড়িয়া গ্রামের প্রয়াত সাজ্জাদ আলী খানের ছেলে সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আনোয়ার হোসেন খান খোকন (৫৫), তার মেয়ে আসমা আক্তার এ্যানী (২৯), জামাই রেফাজ উদ্দিন রিপন (৩৪), নাতনি রাফিয়া আক্তার (৮) ও নাতি আহমেদ রাফিনকে (৫) নিয়ে প্রাইভেটকারযোগে (ঢাকা-মেট্রো ঘ-১৩-১৫১২) ঢাকার উদ্দেশে রওনা হন। গাড়ি চালাচ্ছিলেন জামাই রিপন। তারা বেলতলার অরক্ষিত রেলক্রসিং পার হতে গেলে সৈয়দপুরগামী আন্তঃনগর রূপসা এক্সপ্রেস ট্রেন প্রাইভেটকারকে ধাক্কা দেয়। স্থানীয়রা দুমড়েমুচড়ে যাওয়া প্রাইভেটকার থেকে বিএনপি নেতা খোকন, তার মেয়ে এ্যানী, জামাই রিপন ও নাতনি রাফিয়াকে উদ্ধার করলেও মৃত অবস্থায় উদ্ধার করা হয় শিশু রাফিনকে। পরে আহতদের চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

এলাকাবাসী সূত্রে জানা গেছে, আন্দুলবাড়িয়া গ্রামের বিএনপি নেতা খোকনের মেয়ে আসমা আক্তার এ্যানীর সাথে একই উপজেলার মোক্তারপুর গ্রামের মৃত আনসার আলীর ছেলে জামাই রেফাজ উদ্দিন রিপনের বিয়ে হয়। রিপন বাংলাদেশ বিমানের স্ট্যুয়ার্ড। তার ঢাকা মিরপুরের রূপনগরে ফ্লাট আছে। কিছু দিনের ছুটিতে স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে গ্রামের বাড়িয়ে বেড়াতে এসেছিলেন। এ বছর তার দু সন্তানকে ঢাকা মিরপুরের কসমো ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে শিশু শ্রেণিতে ভর্তি করান। আজ বৃহস্পতিবার তাদের প্রথম ক্লাস ছিলো। তাই সকালে দাদা বাড়ি মোক্তারপুরে খাওয়া-দাওয়া শেষে চলে তারা চলে আসে নানাবাড়ি আন্দুলবাড়িয়ায়। পরে নানার সাথে প্রাইভেটকারযোগে ঢাকার উদ্দেশে যাচ্ছিলো। পরে তারা বেলতলার রেলক্রসিঙে পৌঁছুলে প্রাইভেটকারটি রেল লাইনের ওপর পৌঁছানো মাত্র বিকল হয়ে যায়। ট্রেন আসতে দেখে অনেক চেষ্টা করেও গাড়ি চালু করতে না পেরে প্রাইভেটকার থেকে বেরিয়ে পড়েন চালক রিপন। এ সময় তিনি সকলকে প্রাইভেটকারের থেকে বেরিয়ে আসতে বলেন। কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই সৈয়দপুরগামী আন্তঃনগর রূপসা হুইসেল বাজাতে বাজাতে প্রাইভেটকারকে ধাক্কা দেয়। স্থানীয়রা আহতদের উদ্ধার করে চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে ভর্তি করেন। জামাই রিপন সামান্য জখম হন। তবে বিএনপি নেতা খোকনের ডান পা, বুক ও ডান চোয়াল রক্তাক্তভাবে জখম হয়। এছাড়া তার মেয়েও রক্তাক্ত জখম হয়। অবস্থা আশঙ্কাজনক হওয়ায় কর্তব্যরত চিকিৎসক ডা. কানিজ নাঈমা খোকন ও তার মেয়েকে পিজি হাসপাতালে রেফার করেন। পরে টাউন ফুটবল মাঠ থেকে পৃথক দুটি হেলিকাপ্টারযোগে ঢাকায় নেয়া হয়েছে।

এদিকে পরিবারের সদস্যরা আহত রাফিয়াকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে বাড়ি ফিরিয়ে নেয়। বাদ মাগরিব শিশু রাফিনের মৃতদেহ গ্রামের বাড়ি উপজেলার মোক্তারপুর গ্রামে নামাজের জানাজা শেষে স্থানীয় কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিএনপি নেতা খোকন ঢাকা পিজি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। মেয়ে এ্যানির জ্ঞান ফেরেনি। তাকে আইসিইউতে রাখা হয়েছে। সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, বেলতলা রেলক্রসিংটি দীর্ঘদিন থেকে অরক্ষিত। গেটে কোনো গেটম্যান নেই। প্রতিদিন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করছে যানবাহনসহ পথচারীরা। দুর্ঘটনা এড়াতে এর দু প্রান্তে দুটি বড় গতিরোধক দেয়া হয়েছিলো। তার মধ্যে একটি গতিরোধক সম্প্রতি তুলে ফেলা হয়েছে। আর ওই তুলে ফেলা গতিরোধকের জন্যই ওই দুর্ঘটনা ঘটেছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা।

জীবননগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এনামুল হক জানান, আন্দুলবাড়িয়া বেলতলা রেলক্রসিং পার হতে গিয়ে রেললাইনের ওপর ৫ জন যাত্রীবাহী প্রাইভেটকারটির ইঞ্জিন বিকল হয়ে যায়। এ সময় খুলনা থেকে আসা রূপসা এক্সপ্রেস ট্রেনের সাথে লাইনের ওপরে থাকা প্রাইভেটকারের সংঘর্ষ হয়। ঘটনাস্থলে নিহত হয় রাফিন নামে ৫ বছরের এক শিশু।

চুয়াডাঙ্গা স্টেশন মাস্টার আনোয়ার সাদাত দুর্ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে জানিয়েছেন, রেলওয়ে প্রকৌশল গেট নামে পরিচিত আন্দুলবাড়িয়ার ওই রেলক্রসিংয়ে কোনো নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিলো না। এলাকার লোকজন নিজ দায়িত্বে পারাপার হতেন।

উল্লেখ্য, ২০০৭ সালের ২৯ ডিসেম্বর আন্দুলবাড়িয়া ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান প্রয়াত কাজি আব্দুস সবুর মিয়ার ছেলে প্রকৌশলী কাজি নজরুল ইসলাম মুকুল (৪৮), তার স্ত্রী অ্যাড. আশরাফুন নাহার কেয়া (৩৭), ছেলে জারিফ হোসেন (৫), মেয়ে প্রথা (৭ মাস) ও কাজের মেয়ে ফাতেমা খাতুন (২৬) মাইক্রোবাসযোগে বেলা ১১টার দিকে ওই সড়ক দিয়ে ঢাকার উদ্দেশে যাচ্ছিলেন। পরে তারা বেলতলা রেলক্রসিঙে পৌঁছুলে সৈয়দপুরগামী আন্তঃনগর রূপসা এক্সপ্রেস ট্রেন মাইক্রোবাসকে ধাক্কা দিলে ঘটনাস্থলেই নিহত হন অ্যাড. আশরাফুন নাহার কেয়া। অন্যরা আহত হয়ে প্রাণে রক্ষা পান। ওই রেলক্রসিংয়ে একের পর এক দুর্ঘটনায় ঝরছে তাজা প্রাণ। তাই সেখানে স্থায়ী গেটম্যান নিয়োগ দেয়ার দাবি জানিয়েছে এলাকাবাসী।

Leave a comment