দেখাই তো গেলো, চাঁদাবাজ আকাশ থেকে পড়ে না। ওরা ধরা ছোঁয়ার বাইরেও নয়। আশপাশেই ঘোরে। ক্ষমতাসীন দলের মিছিলে মাঝে মাঝে পা মিলিয়ে চুয়াডাঙ্গা ছয়ঘরিয়ার মোমিনও গড়ে তুলেছিলো চাঁদাবাজ গ্যাঙ। যে গ্যাঙের দাপট দশ গ্রামের শান্তিকামী মানুষের দীর্ঘশ্বাস হয়ে দাঁড়িয়েছিলো। অবশেষে কালুপোলে প্রবাসীপুত্রের পিতার কাছে দাবিকৃত টাকা আদায় করতে গিয়ে হাতেনাতে ধরাপড়েছে গ্যাং প্রধান মোমিনসহ তার দু সহযোগী। একজন পালিয়ে পিটুনি থেকে রক্ষা পেয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, তিন চাঁদাবাজ হাতেনাতে ধরাপড়ার পর তাদের বিরুদ্ধে আনীত মামলা হালকা করার জন্য পার্শ্ববর্তী এলাকার এক তরুণ জনপ্রতিধি নির্লজ্জের মতো তদবির করতে গিয়ে বলেছেন, ‘ওরা আমাদেরই লোক’। পরবর্তীতে অবশ্য তিনি নিজেকে সুধরে নিয়ে বলেন, ‘তলায় তলায় ওরা চাঁদাবাজ তা তো বুঝিনি!’
চুয়াডাঙ্গা-মেহেরপুরসহ পার্শ্ববর্তী এলাকায় অসংখ্য গ্যাং গ্রুপ গড়ে উঠেছে। অঞ্চলভিত্তিক গ্যাঙের উৎপাতে ইটভাটার মালিক, মাঝারি পুজির ব্যবসায়ী, সচ্ছল কৃষকসহ প্রবাসী ছেলের পিতা কেউই স্বস্তিতে নেই। চাঁদাবাজচক্রের প্রধান অস্ত্রের নাম সেলফোন বা মোবাইলফোন। দামুড়হুদার ভারত সীমান্তবর্তী এলাকার গ্যাং প্রধান প্রথম দিকে দেশি মোবাইলফোন অপারেটরের নম্বর ব্যবহার করে হামলা, খুন-গুমের হুমকি দিয়ে চাঁদাবাজ করলেও পরবর্তীতে ভারতীয় সিম কাজে লাগাতে শুরু করেছে। ফলে মোবাইলফোন ট্রাকিং করে অবস্থান শনাক্ত করা কিছুটা কষ্টসাধ্য। তাহলেও তাদের সাঙ্গাপাঙ্গরা যে আশপাশেই তা নতুন করে বলার অবকাশ রাখে না। অধিকাংশ এলাকার গ্যাং প্রধানসহ তার লোকজন কখনো ছদ্মবেশে, কখনো মদদদাতার ছত্রছায়ায় মুখোশ ছাড়াই দিব্যি ঘোরে প্রকাশ্যে। যেমন মোমিন গ্যাং। সরোজগঞ্জ ফাঁড়ি পুলিশের এক সদস্যকেও থাপ্পড় মেরে যে মোমিন পার পায়, সেই মোমিনকে কি আর চাঁদা আদায় করতে আগ্নেয়াস্ত্র বা অন্ধকার সময় সুযোগ লাগে? পরিচয়টাই তো অনেক। যদিও সন্ত্রাসী যতোই শক্তিশালী হোক, যতোটা অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্রেরই মালিক হোক জনগণের কাছে তা তুচ্ছ। কালুপোলের আমজনতা তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। এর আগে অন্য এলাকার মানুষও বিষয়টি বোঝাতে ছাড়েনি। তারপরও গ্যাং গজে, সন্ত্রাস মাথাচাড়া দেয়। পুলিশি দুর্বলতা আর রাজনৈতিক কোনো কোনো নেতার ব্যক্তি স্বার্থান্ধতার কুপ্রভাবেই যে সন্ত্রাস মাথাচাড়া দেয় তা বলাই বাহুল্য। কালুপোলে ধরাপড়া তিন চাঁদাবাজের পাশে পার্শ্ববর্তী ইউনিয়ন পর্যায়ের এক জনপ্রতিনিধির দাঁড়ানো তারই কলঙ্কময় উদাহরণ। নেতার ন্যূনতম প্রশ্রয়ই যে সাধারণ মানুষের জন্য শ্বাসরুদ্ধকর পরিবেশ গড়ে ওঠে সেটা উপলব্ধি করেন ক’জন নেতা? যে নেতা বুঝে শুনে কথিত ক্যাডার বা পাপোষ পোষেন সেই নেতার নেতৃত্বে দীর্ঘস্থায়ী হয়। হতে বাধ্য। কেননা, কোনো নেতা একক ব্যক্তি নন। নেতা অনেক মানুষের সমষ্টি। অন্যের কষ্ট নিজের মতো করে উপলব্ধি করে দ্রুত উপসমে সঠিক ওষুধ লাগাতে না পারলে কি তাকে দরদি নেতা বলা যায়? তোষামোদকারীদের তোষামোদী বলায় ডিঙিয়ে আমজনতার দশা দেখার মতো প্রখর দৃষ্টি এবং দূরদর্শী না হলে কি তাকে নেতা হওয়া মানায়?
চুয়াডাঙ্গা-মেহেরপুর ও ঝিনাইদহসহ পার্শ্ববর্তী এলাকা এক সময় সন্ত্রাসকবলিত হিসেবে চিহ্নিত ছিলো। তখন প্রত্যন্ত অঞ্চলের যোগাযোগ যেমন ছিলো দূরহ, তেমনই মার্কসবাদ- লেলিন বাদ স্লোগান তুলে অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্রের ঝনঝনানি আর রক্তের হলিতে জিম্মি করে রাখতো গোটা এলাকা। সমাজ বদলানো নয়, সকলকে জিম্মি করে অর্থবাণিজ্যই ওদের অদর্শের বিষয়টি জনগণের কাছে যতোই স্পষ্ট হয়েছে ততোই পতন ঘটেছে তাদের। র্যাব-পুলিশের অনমনীয় অভিযান সেই পতনেকে ত্বরান্বিত করেছে। এখন তেমনটি নেই। আছে অপহরকচক্র, চাঁদাবাজ গ্যাং। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি হয়েছে। পুলিশের অপ্রতুলতাও অনেকটা কেটেছে। তারপরও চাঁদাবাজ, অপহরকচক্রের উৎপাত কি বরদাস্ত করা যায়? কালুপোলের সাহস ছড়িয়ে পড়–ক সবখানে। ত্রুটি সুধরে নিক নেতা। গড়ে উঠুক স্বস্তির-স্বপ্নের প্রত্যাশিত সমাজ।