স্টা রিপোর্টার: নতুন নির্বাচন কমিশন এবং সার্চ কমিটি গঠনে রাষ্ট্রপতির সাথে সংলাপে ১৩ সদস্যের প্রতিনিধি দল নিয়ে আজ রোববার বঙ্গভবনে যাচ্ছে বিএনপি। সংলাপে ১৩ দফা প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা করবেন বলে জানিয়েছেন দলটির নেতারা। বিকেলে বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপ্রধান মো. আবদুল হামিদের সাথে এই আলোচনায় বিএনপির প্রতিনিধি দলে নেতৃত্ব দেবেন দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। নতুন ইসি গঠনে বিএনপির সাথে বৈঠকের মধ্যদিয়ে সংলাপ শুরু করতে যাচ্ছেন রাষ্ট্রপতি। এরপর ২০ ডিসেম্বর জাতীয় পার্টি, পরদিন এলডিপি ও কৃষক-শ্রমিক জনতা লীগ, তার পরদিন জাসদের সঙ্গে বৈঠক করবেন তিনি। বৃহস্পতিবার সংলাপ সূচি ঘোষণা করে বিএনপির ১০ সদস্যের প্রতিনিধি দলকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিলো বঙ্গভবনের পক্ষ থেকে। তার পরিপ্রেক্ষিতে বিএনপি ১০ জনের তালিকাও পাঠিয়েছিলো। কিন্তু পরে বিএনপি আরও তিন নেতাকে প্রতিনিধি দলে অন্তর্ভুক্ত করার অনুরোধ জানায়। ফলে প্রতিনিধি দলের সদস্য ১৩ জনে দাঁড়ায়।
বিএনপির প্রতিনিধি দলে খালেদা জিয়ার সাথে থাকছেন- মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন, মওদুদ আহমদ, তরিকুল ইসলাম, জমিরউদ্দিন সরকার, মাহবুবুর রহমান, রফিকুল ইসলাম মিয়া, মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, আবদুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান ও আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী। রাষ্ট্রপতির প্রেসসচিব মো. জয়নাল আবেদীন শনিবার বলেন, নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনে রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে রাষ্ট্রপতি আগামীকাল (আজ রোববার) আলোচনা শুরু করবেন। বিএনপির ১৩ সদস্যের প্রতিনিধি দলের সাথে এই আলোচনা শুরু হবে। বঙ্গভবনের দরবার হলে বিকেল সাড়ে ৪টায় বিএনপি নেতাদের সাথে আলোচনায় বসবেন রাষ্ট্রপ্রধান। বিএনপি চেয়ারপারসনের প্রেস উইংয়ের সদস্য শায়রুল কবির খান বলেন, ম্যাডাম রোববার গুলশানের বাসা থেকে বিকেল ৩টায় বঙ্গভবনের উদ্দেশে বেরিয়ে প্রথমে নয়া পল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে যাবেন। সেখান থেকে প্রতিনিধি দলের সদস্যদের নিয়ে বঙ্গভবনে যাবেন। বর্তমান নির্বাচন কমিশনের প্রতি আস্থাহীন বিএনপি সব রাজনৈতিক দলের আস্থাশীল ইসি গঠন করতে রাষ্ট্রপতির প্রতি আহ্বান জানিয়ে আসছে, যাদের অধীনে আগামী সাধারণ নির্বাচন হবে। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া গত নভেম্বরে এক সংবাদ সম্মেলনে নতুন ইসি ও সার্চ কমিটি গঠন নিয়ে তার দলের ১৩ দফা প্রস্তাব তুলে ধরেন, যা তারা সংলাপেও তুলবেন বলে দলের নেতারা জানিয়েছেন। মির্জা ফখরুল শুক্রবার বলেন, সুষ্ঠু ও সত্যিকার অর্থে নিরপেক্ষভাবে নির্বাচন পরিচালনা করতে সক্ষম হবে, সেই ধরনের একটি যোগ্য নির্বাচন কমিশন গঠন করবার জন্য আমরা বার বার বলে এসেছি। সেজন্য একটা প্রস্তাবও দিয়েছেন আমাদের দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া। আমরা সেই প্রস্তাব পেশ করব। আওয়ামী লীগের নেতারা খালেদা জিয়ার ওই অবস্থানের সমালোচনা করেছেন। তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, উনার প্রস্তাব উনি দিয়েছেন। রাষ্ট্রপতিকে বলুক। এটা রাষ্ট্রপতি ভালো বুঝবেন, উনি কী পদক্ষেপ নেবেন। রাষ্ট্রপতি যে পদক্ষেপ নেবেন সেটাই হবে। এখানে আমাদের বলার কিছু নেই। বঙ্গভবনের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, পাঁচটি দলের পর চলতি সপ্তাহে আরও কয়েকটি রাজনৈতিক দলকে আলোচনায় অংশ নেয়ার আমন্ত্রণ জানিয়ে চিঠি পাঠানো হবে। বিএনপির প্রতিনিধি দলের সদস্য সংখ্যা বাড়ার কারণে অন্যান্য দলের প্রতিনিধি সংখ্যাও বাড়ানো হবে বলে জানান তিনি।
রাষ্ট্রপতির কাছে যেসব দাবি: সুষ্ঠু নির্বাচন ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে এবং নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) তরফ থেকে দেয়া একাধিক প্রস্তাবের বিষয়ে যখন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নানা সমালোচনায় মুখর ঠিক সেই সময়ে রাষ্ট্রের অভিভাবক হিসেবে বিএনপিসহ অন্যান্য নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের সাথে পর্যায়ক্রমে সংলাপ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ। রাষ্ট্রপতির দেয়া সময় অনুযায়ী ১৮ ডিসেম্বর তাঁর সঙ্গে বঙ্গভবনে সংলাপে বসার কথা রয়েছে বিএনপি নেতাদের। দলের চেয়ারপারসনের নেতৃত্বে প্রতিনিধি দলের সদস্য তালিকাও চূড়ান্ত করে ভঙ্গভবনে পাঠানো হয়েছে ইতোমধ্যে। তবে সংলাপে দলটির চেয়ারপার্সনের ঘোষণা করা নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনের প্রস্তাবের বাইরে আর কোনো বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হবে কি অথবা রাষ্ট্রপতির কাছে বিএনপির কোনো আশা রয়েছে কি? এছাড়া দলটির কোনো দাবি থাকবে কি রাষ্ট্রপতির কাছে? এ সব বিষয়ে কথা হয় বিএনপি মহাসচিব ও দুজন স্থায়ী কমিটির সদস্যের সাথে। এদিকে দীর্ঘদিন পর নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন নিয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি চেয়ারপারসন জানান, অতি জলদি নিরপেক্ষ নির্বাচনকালীন সরকারের রূপরেখা তুলে ধরা হবে। বিএনপির তরফ থেকে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনকে কেন্দ্র করে সংবাদ সম্মেলনের পর দেশের রাজনৈতিক মহল আবার চাঙ্গা হচ্ছে। চলছে নানা আলোচনা ও সমালোচনাও। বিএনপি চেয়ারপারসনের ঘোষণা করা নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনের প্রস্তাবের বাইরে আর কোনো বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হবে কি না? এ বিষয়ে দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, আমাদের প্রস্তাবে নির্বাচন সংক্রান্ত যাবতীয় বিষয় উল্লেখ রয়েছে। নির্বাচন কমিশন গঠন ছাড়াও নির্বাচনকালে একটা নিরপেক্ষ সরকার চাই আমরা। এ বিষয়ে রাষ্ট্রপতির কাছে আপনাদের কোনো আশা রয়েছি কি? জবাবে মির্জা ফখরুল বলেন, আমাদের সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা খুবই সীমিত। তার কাছে আশা আসলে কী? এটা নির্ভর করছে পরবর্তী সময়ে তিনি কেমন পদক্ষেপ নেন, তার ওপর। সেক্ষেত্রে আমরা প্রয়োজনে অনুরোধ করতে পারি। এর বেশি কিছু করার নেই। প্রস্তাবের বইটি আমাদের ভিত্তি। এটার ওপরেই আমরা কাজ করবো, কথা বলবো। বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে যেসব দলের প্রতিনিধিত্ব ছিল সেসব দলের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনের প্রস্তাব দিয়েছেন বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া। কীভাবে এই নির্বাচন কমিশনের অধীনে পরবর্তী নির্বাচন হতে পারে, সে বিষয়েও প্রস্তাবে উল্লেখ করেছেন তিনি।
এদিকে ১৮ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের সাথে বৈঠকে বসা এবং তার কাছে দলটির আশা ও প্রস্তাবের বাইরে অন্য কোনো বিষয়ে আলোচনা করবেন কি-না এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, প্রস্তাবের বাইরে আলোচনা করার কোনো সুযোগ নেই। যেহেতু আমাদের নেত্রী নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনের বিষয়ে একটা প্রস্তাব দিয়েছেন জাতির সামনে। তার বাইরে কীভাবে আমরা কথা বলবো। এর মধ্যেই আমাদের আলোচনা হবে। রাষ্ট্রপতির কাছে এই বিষয়ে কী ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণের আশা করছেন? জবাবে তিনি বলেন, কথা না বলে আমরা কীভাবে বুঝবো, তিনি কী মনোভাব নিয়ে কথা বলবেন। তার সঙ্গে কথা বলার পর বোঝা যাবে, তার পরবর্তী ব্যবস্থা দেখে বোঝা যাবে। এখন বোঝা যাবে না। একই বিষয়ে বিএনপির আর এক স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জে. (অব.) মাহাবুবুর রহমান বলেন, আলাপের মধ্যে বোঝা যাবে মহামান্য রাষ্ট্রপতি আর কী কী আমাদের কাছে জানতে চান। আমরা যদি আরো কিছু বলতে চাই সেটা আলোচনার ওপর নির্ভর করবে। তিনি আরো বলেন, রাষ্ট্রপতির কাছে আমাদের আর কী চাওয়া? বিজয়ের মাসে একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গণতান্ত্রিক দেশের গণতন্ত্র রক্ষার জন্য তিনি সিদ্ধান্ত নেবেন বাংলাদেশের অভিভাবক হিসেবে। তিনি যদি আমাদের কাছে জানতে চান, তাহলে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার বিষয়ে তার সঙ্গে কথা হবে। আগামী বছর বর্তমান নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ শেষ হয়ে যাবে। এরপর যে নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন করা হবে তার অধীনেই পরবর্তী জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে।
নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনের বিষয়ে খালেদা জিয়ার প্রস্তাবে বলা হয়েছে, নিবন্ধিত সব রাজনৈতিক দল অথবা স্বাধীনতার পর প্রথম জাতীয় সংসদে থেকে শুরু করে বিভিন্ন সময়ে জাতীয় সংসদে প্রতিনিধিত্ব করেছে এমন প্রত্যেক রাজনৈতিক দলের মহাসচিব বা সাধারণ সম্পাদক অথবা তাদের মনোনীত প্রতিনিধি দলের সাথে রাষ্ট্রপতি পৃথক বৈঠক করে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের জন্য প্রতি পদের বিপরীতে ২ (দুই) জনের নাম ও পরিচয়সহ সুস্পষ্ট প্রস্তাব লিখিতভাবে পেশ করবেন। রাষ্ট্রপতি বাছাই কমিটির মাধ্যমে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের জন্য বাছাই করা ২ জনের মধ্যে থেকে ১ জনকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং নির্বাচন কমিশনারের জন্য বাছাই কমিটির বাছাই করা ৮ জনের মধ্য থেকে ৪ জনকে নির্বাচন কমিশনার পদে চূড়ান্ত করবেন। রাষ্ট্রপতির চূড়ান্ত করা এসব ব্যক্তির সম্মতি গ্রহণ এবং তাদের জীবনবৃত্তান্ত ও সম্পদের বিবরণী জনসমক্ষে প্রকাশ করার ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন এবং তাদের নিয়োগ দেবেন। রাষ্ট্রপতির চূড়ান্ত করা ব্যক্তিদের মধ্যে কেউ সম্মত না হলে, কিংবা অন্য কোনো অসঙ্গতি পাওয়া গেলে বাছাই কমিটির মনোনীত অবশিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্য থেকে রাষ্ট্রপতি একই প্রক্রিয়া ও পদ্ধতিতে চূড়ান্ত নিয়োগ দেবেন।