মাজেদুল হক মানিক: ছোট্ট একটি দোচালা টিনের ঘরের পিড়িতে (বারান্দায়) বসে নাতি ইমনকে মুক্তিযুদ্ধের গল্প শোনাচ্ছিলেন মেহেরপুর গাংনী উপজেলার মুন্দা গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা আলতাফ হোসেন (৬৮)। ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস। বাঙালি জাতির এক অনন্য গৌরবের দিন। কতো সাধনা ও ত্যাগের মাধ্যমে বিজয় অর্জন হয়েছিলো তা বর্ণনা করছিলেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধের সেই বীরত্বগাথা গল্পের মধ্যে ছেদ পড়ে। যখন মনে হয় কার জন্য স্বাধীনতা, কিসের জন্য জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করেছিলেন তিনি। অনেক অমুক্তিযোদ্ধা ও বিতর্কিত ভুমিকার অনেকেই আজ মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। তাদের সন্তানরা মুক্তিযোদ্ধা কৌটায় সরকারি চাকরিও করছেন। অথচ তার শিক্ষিত দুই ছেলের ভাগ্যে জোটেনি সরকারি চাকরি নামক সেই সোনার হরিণ। আলতাফ হোসেন স্বাধীনতার এতো বছর পরেও পাননি মুক্তিযোদ্ধার সনদ। কথা বলতে বলতে দুচোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছিলো। সবকিছু যেন আবছা হয়ে আসতে থাকে মুক্তিযুদ্ধের অকুতোভয় সৈনিক আলতাফ হোসেনর চোখে।
১৯৭১ সালে ভারতের রামপুর হাট বীরভূমে ২৮ দিনের উচ্চ প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে ১৮ বছরের টগবগে তরুণ আলতাফ হোসেন ঝাপিয়ে পড়েন মুক্তিযুদ্ধে। গ্রুপ কমান্ডার প্রয়াত আবুল কাশেম কোরাইশির নেতৃত্বে ৮নং সেক্টরে মেহেরপুর, গাংনী ও পাশর্^বর্তী আলমডাঙ্গাসহ বিভিন্ন এলাকায় সম্মুখ যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেন। স্বাধীনের পর দেশ পুনর্গঠনের কাজে যোগদেন পুলিশ বাহিনীতে। কনস্টেবল পদের সামান্য বেতনে চাকরি করে দুই ছেলে ও তিন মেয়েকে লেখাপড়া শিখিয়েছেন। দুই ছেলে আজো বেকার। ছোট মেয়ে নবম শ্রেণির ছাত্রী। স্বাধীনতার এতো বছর পরেও তার ভাগ্যে জোটেনি মুক্তিযোদ্ধার সনদ। ভারতে প্রশিক্ষণার্থী তালিকার এফএফ নম্বর বি-২০৮ এর উপর ভিত্তি করে পাচ্ছেন ভাতা। ২০১০ সালে আবেদন করলেও আজো মেলেনি মুক্তিযোদ্ধার সনদ। এতে রাষ্ট্রীয় অনেক সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত তিনি। বলছিলেন আলতাফ হোসেন।
আলতাফ হোসেনের আবেদনের বিষয়ে এখনো মন্ত্রণালয় থেকে যাচাই-বাছাইয়ের জন্য উপজেলা কমিটিতে কাগজপত্র আসেনি বলে জানান গাংনী উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মুন্তাজ আলী। তাকে একজন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা উল্লেখ করে তিনি জানান, যাছাই-বাছাই সম্পন্ন হলে তিনি গেজেটভুক্ত হতে পারবেন।
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সংরক্ষণে মেহেরপুর জেলার বিভিন্ন প্রান্তে নিরলস পরিশ্রম করেছেন মুক্তিযুদ্ধের গবেষক ও বিশিষ্ট কথা সাহিত্যিক রফিকুর রশিদ রিজভী। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে বিতর্কেরতো শেষ হলো না। শেষ কবে হবে আমরা জানিও না। বিশেষ করে মুক্তিযোদ্ধা কারা? ভূয়া মুক্তিযোদ্ধা কারা? কি করে মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত তালিকায় ভূয়া মুক্তিযোদ্ধাদের নাম যুক্ত হলো ?
জেলার মুক্তিযোদ্ধার তালিকা ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সংগ্রহ করতে গিয়ে বিপাকে পড়েছিলেন উল্লেখ করে তিনি আরো বলেন, এমন কিছু ব্যক্তির নাম মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গেজেট প্রকাশ হয়েছে, যাদেরকে আমাদের চারপাশের মানুষ সবাই চেনে। তারা মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন না। ইতিহাসের সত্যা রক্ষার স্বার্থে খুব জরুরি হয়ে উঠেছে সকল রাজনৈতিক বাক বদলের সময়ে প্রণীত মুক্তিযোদ্ধার তালিকাগুলো সামনে নিয়ে বসে মাঠ পর্যায়ের কিছু মানুষের সাথে কথা বলে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার তালিকাটি প্রনয়ণ করা। তা না হলে আমরা জাতি হিসেবে নিজেরাই অসত্যের ঘেরাটপে বন্দি হয়ে থাকবো এবং ইতিহাসের প্রতি অবিচার করবো। এই অবিচারের দায় জাতি হিসেবে আমাদেরকেই সুধতে হবে।
সরকারি গেজেটভুক্ত জেলায় ৮৭৫ জন মুক্তিযোদ্ধার মধ্যে অনেকের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধ না করা ও স্বাধীনতার সময় বিরোধী ভুমিকার অভিযোগ রয়েছে। এদের সংখ্যা ঠিক কতো তার হিসেব না থাকলেও নেহায়েত কম নয় বলে জানালেন মুক্তিযোদ্ধারা। যারা ভাতা ভোগের পাশাপাশি মুক্তিযোদ্ধা কৌটায় রাষ্ট্রীয় অনেক সুবিধা পাচ্ছেন। যা প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য এক কলঙ্কজনক বিষয়। এই লজ্জা কুরে কুরে খাচ্ছে মুক্তিযোদ্ধাদের। বিব্রতকর অবস্থা থেকে মুক্তি ও লজ্জা মুছে ফেলতে তালিকা যাচাই-বাছাই করে বিতর্কিতদের বাদ দিতে সরকারের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন মুক্তিযোদ্ধারা।
জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডের সাংগঠনিক কমান্ডার আমিরুল ইসলাম জানান, জেলার প্রায় তিনশোর ওপরে অমুক্তিযোদ্ধা গেজেটভুক্ত হয়েছেন। তাই যাচাই-বাছাই হওয়া জরুরি। অবশ্য বর্তমান সরকার এ বিষয়ে স্বোচ্ছার। দ্রুত যাচাই-বাছাইয়ের আশা প্রকাশ করেন তিনি। স্বাধীনতা যুদ্ধের পক্ষে বিভিন্নভাবে ভূমিকা রেখেছিলেন এমন মানুষের সংখ্যা অগণিত। যারা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দাবি করেননি। দেশ স্বাধীন হয়েছে এটাই তাদের বড় পাওয়া হিসেবে ধরে নিয়েছেন। অথচ বিতর্কিত অনেকেই আজ মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে পরিচিতি ও গুরুত্বপূর্ণ পদ-পদবিও দখল করেছেন। কিন্তু আলতাফ হোসেনের মতো মানুষ পাননি স্বীকৃতি। তাই এমন আলতাফ হোসেনদের স্বীকৃতি ও অমুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা থেকে বাদ দেয়া এখন সময়ের দাবি।