চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে বেতনভুক্ত কর্মকর্তা কর্মচারী ও বিনাবেতনের কর্মচারীর সংখ্যা প্রায় সমান
স্টাফ রিপোর্টার: হাসপাতালে স্বেচ্ছাসেবী হলেও গ্রামে ওরা ডাক্তার। এরকম ডাক্তার চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে সর্বকালের রেকর্ড ভেঙে বর্তমানে বায়ান্ন ছুঁয়েছে। যা হাসপাতালে বেতনভুক্ত তথা সরকার নিযুক্ত মোট চিকিৎসক কর্মকর্তা-কর্মচারীর সমান। চমকানো এ পরিসংখ্যানে হাসপাতালে চিকিৎসা সেবার মান কতোটা বাড়ায়, কতোটা বিড়ম্বনার কারণ হয়ে দাঁড়ায়? এ প্রশ্নের জবাব খুঁজতে গিয়ে পাওয়া গেছে বিচিত্র তথ্য।
না, চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালের জরুরি বিভাগে মেডিকেল অফিসার পদ সৃষ্টি করা সম্ভব হয়নি। তারপরও ক্রমন্বয়ে ৫১ থেকে ১শ শয্যায় উত্তীর্ণ হয়েছে। দেড়শ শয্যার কার্যক্রম চলছে। আড়াইশ বেড়ের অবকাঠামো নির্মাণ প্রায় সম্পন্ন হওয়ার পথে। অথচ লোকবল সংকট লেগেই আছে। এই সুযোগে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ নিখরচায় কাজ করা তথা স্বেচ্ছায় শ্রম দেয়া বহু নারী-পুরুষকে কাজ করার সুযোগ দিয়েছে। সুযোগ পাওয়াদের অধিকাংশেরই বিরুদ্ধে রোগী সাধারণের নিকট থেকে টাকা আদায়ের অভিযোগ রয়েছে। বিভিন্ন ডায়াগনস্টিক, ক্লিনিকে রোগী নেয়ার দালালিটাও কারে তাদের কেউ কেউ। উপরি আয় না, টিকে থাকার জন্য কিছু পাওয়া। সংশ্লিষ্টরা এরকমই মন্তব্য করে বলেছেন, চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালটি অনেকটই স্বেচ্ছাসেবী নির্ভর হয়ে পড়েছে। ফলে স্বেচ্ছাসেবীদের অনেকেই রোগী সাধারণের সাথে উগ্র আচরণ করেন। অসহনীয় স্বেচ্ছাচারি হয়ে ওঠা ওদের বিরুদ্ধে নালিশ করেও তেমন কাজ হয় না।
জানা গেছে, চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে ৩৩ জন স্টাফ নার্স থাকার কথা থাকলেও কর্তব্যরত ৩১ জন। মেডিকেল অফিসার ও কনসালটেন্টদের সংখ্যা মোট ২১ জন। এর মধ্যে ৪টি পদ শূন্য। অর্থাৎ সেবিকা ও নার্স দিয়ে মোট ৫৪ জন কর্মরত। আর স্বেচ্ছাসেবীর সংখ্যা? ৫২ জন। এর মধ্যে কার্ডধারী তথা পরিচয়পত্রধারী স্বেচ্ছাসেবীর সংখ্যা ২১ জন। বাকি ৩১ জনের কার্ড না থাকলেও চিকিৎসকের চেম্বারে বা ওয়ার্ডে দিব্যি স্বেচ্ছাসেবীর দায়িত্ব পালন করে চলেছেন। অবাক হলেও সত্য যে, স্বেচ্ছাসেবী না থাকলে চিকিৎসা সেবা দেয়াই বেতনভুক্তদের জন্য কষ্টসাধ্য হয়ে দাঁড়াবে। একাধিক চিকিৎসক ও একাধিক স্টাফনার্সের এ মন্তব্য শুনে হতবাক সচেতন মহলের দীর্ঘশ্বাস- হায়রে স্বাস্থ্যসেবা, হায়রে স্বাস্থ্য বিভাগ! সত্যিই তো, যে ওয়ার্ড ১৪ জন রোগীর চিকিৎসা দেয়ার কথা, সেখানে থাকে তার তিনগুণ। যেখানে ৩০টি শয্যা সেখানে দ্বিগুনেরও বেশি। অথচ লোকবল নেই। যাও বা আছে তাদের তেমন জবাবদিহিতায়ও ঘাটতি।
হাসপাতাল সংশ্লিষ্ট একাধিকসূত্রের সাথে কথা বলে জানা গেছে, জরুরি বিভাগে সরকারি বেতনভুক্ত ৩ জন ব্রাদার ও তিনজন এমএলএসএস। মেডিকেল চিকিৎসক পদ না থাকলেও হাসপাতালের মেডিকেলে অফিসারদের দিয়ে পালাক্রমে দায়িত্ব পালন করানো হয়। এতে হাসপাতালের বর্হিবিভাগে চিকিৎসা সেবাদান ব্যাহত হলেও ইমার্জেন্সি মেডিকেল অফিসার পুনঃসৃষ্টি করা সম্ভব হয়নি। জরুরি বিভাগে স্বেচ্ছাসেবি রয়েছেন মোট ১৩ জন। এদের মধ্যে ১০ জন তিন শিফিটে কাজ করেন। বাকি তিনজন ট্রলিবয় হিসেবে পালাক্রমে দায়িত্বপালন করেন। এদের প্রায় সকলেই রোগী বা রোগীর লোকজনের নিকট থেকে অর্থ আদায়ে সিদ্ধ হস্ত। অর্থ আদায়ের বর্ণনা দিতে গিয়ে একাধিক ভুক্তভোগী বলেছেন, যদি হাত বা পা ভাঙা রোগী নিয়ে হাসপাতালে যাওয়া হয় তাহলে দেখা যাবে স্বচ্ছোসেবিরাই এগিয়ে আসছে। তারা পরিষ্কার করতে করতে জানতে চাইবে, কতো টাকার মধ্যে কাজটা করে দেবো? সরকারি হাসপাতালের জরুরি বিভাগে পা ভাঙা প্লাস্টার করতেও টাকা লাগে নাকি? রোগীর এ প্রশ্নের জবাবে স্বেচ্ছাসেবীর সাফ জবাব, হাসপাতালে ওসব পথ্য সরবরাহ নেই। বাইরে থেকে কিনতে হবে। লিখে দিচ্ছি কিনেন আনুন। ব্যাস। এই চিরকুট নিয়ে দোকানে গেলে কমপক্ষে ৬-৭ টাকার ফ্যার। ফলে কৌশলে স্বেচ্ছাসেবীই বলে বসেন, ৩-৪ দিন, সব ঠিক করে দিচ্ছি। আর যদি বিষপান করা রোগীর ওয়াশ করার দায়িত্ব পেয়ে যান ওরা, তাহলে বকশিসের বহর কতো ফুটে তা হাড়ে হাড়ে বুঝিয়ে দিতে ছাড়েন না। কর্তব্যরত চিকিৎসককে কিছুটা আড়াল করলেও সকলের সামনেই এসব হয়। যাকে বলে ওপেন সিক্রেট। কর্তব্যরত চিকিৎসক কিছু বলেন না কেন? নাম প্রকাশ না করার স্বার্থে দায়িত্বশীলদের একজন বললেন, স্বেচ্ছাশ্রম দেয়। বেতন নেই। একটু এদিকে ওদিক করে যদি কিছু টাকা হয় তো দোষের কি? কাজ করেই তো নেয়। তাছড়া লোকবল থাকলে তো আর স্বেচ্ছাসেবীদের রাখতে হতো না! ওদের স্বেচ্ছারিতাও সহ্য করতে হতো না কাউকে।
চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালের ওয়ার্ডগুলোতে কার্ডধারী স্বেচ্ছাসেবী ছাড়াও আউটডোরে চিকিৎসকদের চেম্বারের সামনে বা ভেতরে থাকেন ৩০ জনের মতো স্বেচ্ছাসেবী। এরা রোগীকে চিকিৎসকের সামনে নেন। চিকিৎসক কোনো ডায়গোনসির জন্য লিখলেই ওদের অনেকেই ওই রোগী নিয়ে কম খরচে পরীক্ষাটা করে দিচ্ছি বলে নিয়ে যায় পছন্দের ডায়াগেনস্টিক সেন্টারে। বিনিময় পান বিশেষ হারে কমিশন। অবাক হলেও সত্য যে, হাসপাতালের রান্নাঘরে নিযুক্ত এক আয়াকেই সব সমালাতে হয় দেখে তিনিই কয়েকজন স্বেচ্ছাসেবী রেখেছেন। তাদের ওই আয়ায় কিছু অর্থের ব্যবস্থা করে দেন। এই যখন অবস্থা তখন হাসপাতালের খাবারের মান কতোটা ধরে রাখা সম্ভব? কুকে বা ওয়ার্ড কিংবা ট্রলিতে দায়িত্ব পালন করা সকলেই নিজ গ্রামে বা এলাকায় ডাক্তার। গ্রাম্য চিকিৎসক হওয়ার জন্যই মূলত স্বেচ্ছাশ্রম। সুযোগ বুঝে অর্থ আদায়। ওয়ার্ডে স্টাফ নার্সদের সাথে কর্মরত কয়েকজন নারী ও পুরুষ স্বেচ্ছাসেবী বলেছেন, গ্রাম্যচিকিৎসক হওয়ার জন্যই মূলত বেগার খাটতে হাসপাতালে আসা। এতেও নেতাদের ধরে আসতে হয়েছে। ন্যূন্যতম ভাতা দেয়ার ব্যবস্থা থাকলে রোগী ও রোগীর লোকজনকে হয়তো ওদের উৎপাতের শিকার হতে হতো না। পাশের জেলা ঝিনাইদহ জেনারেল হাসপাতালের স্বেচ্ছাসেবীদের হাসপাতাল থেকে কিছু না দেয়া হলেও একেকজনকে একেক নেতা বা বিশিষ্ট ব্যবসায়ীদের কেউ নির্দিষ্ট হারে কিছু অর্থ দেন। তাতে অন্তত আশা যাওয়া আর নুন ভাতের ব্যবস্থাটা হয়ে যায়। কম্পাউন্ডারিটা শেখা হয়ে গেলে তো গ্রামে শুধু ডাক্তার বলেই পরিচিতি পান না, স্বর্দি কাশির পরামর্শ আর স্যালাইন ইনজেশকশন পুশ করলেও পাওয়া যায় টাকা।
স্বেচ্ছাসেবী সম্পর্ক চুয়াডাঙ্গা সিভিল সার্জন ডা. সিদ্দিকুর রহমানের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, দায়িত্বভার গ্রহণের পর থেকে স্বাস্থ্য সেবার মান বৃদ্ধির সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যা্ছি। হাসপাতালে লোকবলে অপ্রতুলতার কারণেই মূলত স্বেচ্ছাসেবীদের কাজ করার সুযোগ দিতে হয়। তবে ওদের কোনোভাবেই অর্থ নেয়ার কথা নয়। স্বেচ্ছায় কাজ করার শর্তে যেহেতু কাজ করছো সেহেতু সম্পূর্ণ বিনামূল্যে সেবা দিতে হবে। যে অজুহাতে বা কটুকৌশলে ওরা অর্থ নেয় বলে অভিযোগ, তা খতিয়ে দেখে অবশ্যই উপযুক্ত ব্যবস্থা নেয়া হবে। আর কার্ড নেই এমন কেউ নিজেকে স্বেচ্ছাসেবী বলে দাবি করলে ধরে নিতে হবে ওই ব্যক্তি স্বীকৃত নয়। অন্য কোনো ক্লিনিক বা কোনো ব্যক্তি বিশেষের স্বার্থে। ফলে আইনের দৃষ্টিতে ওদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।