কিছুতেই সান্ত্বনা খুঁজে পাচ্ছেন না রিমুর মা-বাবা : তদন্ত দলের কার্যক্রম শুরু
কামরুজ্জামান বেল্টু: সুরাইয়া সুলতানা রিমু ছিলো তার পিতা-মাতার একমাত্র সন্তান। তাকে হারিয়ে কিছুতেই সান্ত্বনা খুঁজে পাচ্ছেন না তারা। রিমুর স্মৃতি যেমন তাদের তাড়া করে ফিরছে প্রতিমুহূর্ত, তেমনই তার বান্ধবীদেরও বিষণ্ণ করে তুলেছে। অপরদিকে জেলা প্রশাসনের তরফে গঠিত ৫ সদস্যের সদস্যের তদন্ত টিম গতকাল চুয়াডাঙ্গা সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় পরিদর্শন করে। বেশক’জন শিক্ষকের সাথে কথা বলে প্রাপ্ত লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। ৭ দিনের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন পেশ করার কথা রয়েছে।
সুরাইয়া সুলতানা রিমু কেমন ছিলো? প্রতিদিন কতোটুকু পড়তো। কোন কোন খাবার তার পছন্দের ছিলো? এসব নিয়ে তার বন্ধু-বান্ধবীদের মধ্যে যতোটা না আলোচনা, তার চেয়ে তাকে হারানোর কষ্ট কুরে কুরে খাচ্ছে তাদের। রিমুর পিতা শরিফুল ইসলাম শান্তি পুলিশ সুপার কার্যালয়ের অফিস সহকারী। মা হুসনে আরা খাতুন গৃহিণী। এ দম্পতির একমাত্র সন্তান রিমুকে মানুষের মতো মানুষ করে গড়ে তোলা স্বপ্ন দেখতেন। রিমু ছোটবেলা থেকে সেভাবেই পিতা-মাতার প্রতি ছিলো সত্যিকার আনুগত্য। বিনয়ী রিমু প্রতিদিন ভোরে ঘুম থেকে উঠে ফজরের নামাজ আদায়ের মধ্যদিয়ে শুরু করতো কর্মকাণ্ড। ৪ জন প্রাইভেট শিক্ষকের নিকট পড়তো। ভোরে একদিন পর একদিন যেতো তারই বিদ্যালয়ের লিটন স্যারের কাছে ইংরেজি পড়তে। যেদিন লিটন স্যারের কাছে যেতো না সেদিন যেতো কলেজের লিপি ম্যাডামের নিকট। সুমাইয়া সুলতানা রিমুর মা হুসনে আরা খাতুন কান্নাজড়িত কণ্ঠে তার মেয়ের দিন শুরুর এ বর্ণনা দিয়ে বললেন, সকালে প্রাইভেট পড়ে স্কুলে যেতো। স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে বিকেলে যেতো মাদরাসার আতিয়ার স্যারের কাছে। ভি.জে স্কুলের পিকে স্যারের কাছে করতো গণিত। সারাদিনটাই ওর কেটে যেতো লেখাপড়ায়। রাত ৮টার দিকে আধাঘণ্টার জন্য টিভির সামনে বসে দেখতো জি বাংলার গোয়েন্দা সিরিয়াল। তারপর পড়তে বসে ঘড়ির কাঁটা ধরে পড়ার টেবিলে থাকতো রাত ১১টা পর্যন্ত। লক্ষ্মী মেয়ে ছিলো আমার। প্রাথমিক সমাপনীতে শুধু বৃত্তিই পেলো না, সে জেলার ৫ম হলো। ৮ম শ্রেণিতে অর্থাৎ জেএসসি পরীক্ষায় গোল্ডেন এপ্লাস পেয়ে কৃতীত্বের স্বাক্ষর রাখলো। টপ টেনেই থাকতো সে। ৯ম শ্রেণির ফাইনাল অংক পরীক্ষা দিয়ে শনিবার বাড়ি ফিরলো। জিজ্ঞেস করলাম পরীক্ষা কেমন হয়েছে? টেনে বললো কোনোরকম। খটকা লাগলো। তাই পরে আবারও জিজ্ঞেস করলাম তুই টেনে বলছিস কেন? কী হয়েছে? বিস্তারিত বললো না। দুপুরে আমরা তিনজন ইলিশ মাছ দিয়ে ভাত খেলাম। জহুরের নামাজ পড়তে বসলো। দীর্ঘসময় ধরে মোনাজাত করছে দেখে বললাম কি এমন মোনাজাত করছিস যে শেষ হচ্ছে না। নামাজ থেকে উঠলো। বললাম, আজকের পরীক্ষা খারাপ হয়েছে তাতে কি, কালকের জন্য প্রস্তুতি নাও। ঘরে গিয়ে কম্বল গায়ে দিয়ে শুয়ে পড়লো। আছরের নামাজও পড়লো। এরপর কখন যে দরজা দিয়েছে। বুঝিনি। সন্ধ্যায় যখন ডাকাডাকি করি, তখনও বুঝিনি ভুল করে ফেলেছে রিমু। দরজা ভেঙে উদ্ধার করে হাসপাতালে নেয়া হলেও রাখতে পারলাম না আমরা।
রিমুর পিতার স্মৃতিপটে মেয়ের কতো আবদরাই না ভাসছে। তিনি তার মেয়ের জন্যই কিনেছিলেন মোটরসাইকেল। দীর্ঘ প্রায় ১২ বছর ধরে শান্তিপাড়ায় বাড়ি করে বসবাস করছেন তিনি। মোটরসাইকেল মেয়েকে আনা নেয়ার সময় রিমু মাঝে মাঝে আবদার করতো কোর্টমোড়ের সামাদ ভাইয়ের দোকানের আইসক্রিম আর আলী হোসেন সুপার মার্কেটের সামনের ভ্যানগাড়ির গরম বাদাম। এখন ওদিকে গেলেই বুক ফেটে কান্না আসছে আমরা। এ কথা বলতেই তিনি মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। তাকে সান্ত্বনা দেন আত্মীয়স্বজন। রিমুর মায়ের আকুতি। আমার মতো আর কোনো মায়ের কোল যেন খালি না হয়। প্রশাসন সেটাই নিশ্চিত করুক। তাতেই বুঝবো রিমুর প্রতিবাদ করে যাওয়া স্বার্থক হয়েছে। অন্য মেয়েদের মধ্যেই খুঁজবো রিমুর মুখ।
চুয়াডাঙ্গা সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির প্রভাতী শাখার মেধাবী ছাত্রী ছিলো সুরাইয়া সুলতানা রিমু। দাদাবাড়ি আলুকদিয়ার পীরপুরে। গত শনিবার বিকেলে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করে। পরদিন রোববার পৈত্রিক গ্রামের কবরস্থানে দাফন কাজ সম্পন্ন করা হয়। ওইদিনই তার সহপাঠীরা বিদ্যালয়ের সামনে সড়কে অবস্থান নিয়ে অভিযোগ তুলে বলে, শিক্ষকের নিকট প্রাইভেট না পড়ার কারণে টেনে উঠতে দেবে না বলে পূর্বেই যে হুমকি দিয়েছিলো সেই হুমকি মতো কটুকৌশলে খাতা কেড়ে নেয়ার কারণেই সুরাইয়া সুলতানা রিমুকে আত্মঘাতী করেছে। শিক্ষক হাসানুজ্জামানের প্ররোচনায় ছাত্রী রিমুর খাতা পরীক্ষা হলে কর্তব্যরত শিক্ষিকা কেড়ে নেন কি-না তাও খতিয়ে দেখার দাবি উঠেছে। রিমুর মাও গতকাল তার মেয়ে সম্পর্কে তথ্য দিতে গিয়ে বলেন, স্কুলের হাসান স্যারের হুমকির কারণে রিমু তটস্থ থাকতো। এছাড়াও পরীক্ষা হলে শিক্ষকের মোবাইলফোনে কথা বলা, কথা বলতে বাইরে বের হলে পরীক্ষার্থীদের মধ্যে বিশৃঙ্খলা ও হইচই ঠেকাতে গিয়ে আন্দাজেই রিমুর খাতা কেড়ে নেয়াসহ নানা অভিযোগ ওঠে। এসব অভিযোগের প্রেক্ষিতে গঠিত তদন্ত দল তদন্ত শুরু করেছে। গতকাল বুধবার দুপুরে তদন্ত টিমের প্রধান চুয়াডাঙ্গার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব ও আইসিটি) আব্দুর রাজ্জাকের নেতৃত্বে তদন্তদল বালিকা বিদ্যালয়ের বেশ ক’জন শিক্ষকের সাথে কথা বলার পাশাপাশি রিমুর দেয়া পরীক্ষার খাতা খতিয়ে দেখেছে। দু-একদিনের মধ্যেই রিমুর সহপাঠীসহ অন্যদের সাথে কথা বলতে পারেন তদন্তকারীরা।