প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী শাকিলের রহস্যজনক মৃত্যু

 

স্টাফ রিপোর্টার: প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী, কবি ও লেখক এবং ছাত্রলীগের সাবেক কেন্দ্রীয় নেতা মাহবুবুল হক শাকিলের রহস্যজনক মৃত্যু হয়েছে। আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহাবুব-উল আলম হানিফ ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, শাকিল (৪৮) হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। তবে মৃত্যুর আগে শাকিল ফেসবুকে আবেগময় স্ট্যাটাস দিয়েছেন। তার এই স্ট্যাটার্সের কারণে মৃত্যুর ঘটনা নিয়ে রহস্যের সৃষ্টি করেছে। এই ঘটনার পর পুলিশ খাদ্যে ও পানীয়তে বিষক্রিয়া ছিলো কি-না তার আলামত সংগ্রহ এবং ৬ জনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করেছে। আজ তার লাশের ময়নাতদন্ত হবে। তার লাশ আজ ময়মনসিংহে দাফন করা হবে। গতকাল মঙ্গলবার বেলা সাড়ে ১২টার দিকে রাজধানীর গুলশান দুই নম্বরে সামদাদো জাপানিজ কুইজিন রেস্তোরাঁ থেকে তার অসুস্থ হওয়ার খবর দেয়া হয়। প্রধানমন্ত্রীর প্রেসসচিব ইহসানুল করীম জানান, ছাত্রলীগের সাবেক সহসভাপতি শাকিল গতকাল দুপুরে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। জানা গেছে, সামদাদো জাপানিজ কুইজিন রেস্তোরাঁয় মাহবুবুল হক শাকিলের নিয়মিত যাতায়াত ছিলো। সোমবার রাতে মাহবুবুল হক শাকিল এই হোটেলের একটি কক্ষে ছিলেন। কিন্তু মঙ্গলবার সকাল থেকে কোনো সাড়া শব্দ না পাওয়ায় দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে হোটেল কর্মকর্তারা কক্ষটিতে গিয়ে শাকিলকে অচেতন অবস্থায় দেখতে পান। মৃত্যুর ১৬ ঘণ্টা আগে মাহবুবুল হক শাকিল তার ফেসবুকে একটি কবিতা স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন। তার সর্বশেষ স্ট্যাটাসটির শেষ অংশ এই রকম, ‘…মৃতদের কান্নার কোনো শব্দ থাকে না, থাকতে নেই/নেই কোন ভাষা, কবরের কোন ভাষা নেই/ হতভাগ্য সে মরে যায় অকস্মাত্ বুকে নিয়ে স্মৃতি/ তোমাদের উত্তপ্ত সৃষ্টিমুখর রাতে।’ তার এই আবেগঘন স্ট্যাটাসের কারণে মৃত্যুর কারণ নিয়ে রহস্যের সৃষ্টি হয়েছে। ওই রেস্তোরাঁয় রাতে তার সঙ্গে কারা এসেছিল সে বিষয়ে খোঁজ খবর নিচ্ছে পুলিশ। পাশাপাশি আটক করা ৬ কর্মচারীকে সেসব বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।

এদিকে মাহবুবুল হক শাকিলের মৃত্যুতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন। এক শোক বার্তায় প্রধানমন্ত্রী বলেন, তার মৃত্যুতে জাতি একজন বঙ্গবন্ধু প্রেমিক ও দক্ষ সংগঠককে হারালো। তিনি আরো বলেন, একজন ছাত্রনেতা হিসেবে শাকিল গণতান্ত্রিক আন্দোলনে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখেন। প্রধানমন্ত্রী মরহুমের বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা এবং শোক সন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জ্ঞাপন করেন। এছাড়া জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীও গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেন।

শাকিলের মৃত্যুর খবর শুনে সামদাদো জাপানিজ কুইজিন রেস্তোরাঁয় ছুটে যান বিদ্যুত, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু, প্রধানমন্ত্রীর প্রেসসচিব ইহসানুল করিম, প্রধানমন্ত্রীর সামরিক সচিব মেজর জেনারেল মিয়া মোহাম্মদ জয়নুল আবেদিন, আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহাবুব-উল আলম হানিফ, সাংগঠনিক সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, প্রধানমন্ত্রীর একান্ত সচিব সাজ্জাদুল হাসান, ৭১ টিভির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোজাম্মেল বাবু প্রমুখ। এছাড়া সেখানে শাকিলের ভক্ত-অনুরাগীরা ভিড় জমান।

ঘটনাস্থল ঘুরে এসে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ বলেন, শাকিল আর আমাদের মাঝে নেই। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে ওই রেস্তোরাঁর সামনে বিদ্যুত ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ সাংবাদিকদের বলেন, শাকিলের মরদেহ বারডেমের হিমঘরে রাখা হবে। আজ বুধবার তার ময়নাতদন্ত শেষে বেলা ১১টার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদে তার প্রথম নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হবে। সেখান থেকে মরদেহ তার বাড়ি ময়মনসিংহের বাঘমারায় নেওয়া হবে। সেখানে দ্বিতীয় জানাজা শেষে সন্ধ্যায় পারিবারিক কবরস্থানে শাকিলের দাফন করা হবে। ২০০১ সালে অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর নবগঠিত আওয়ামী লীগের তথ্য ও গবেষণা সেল সিআরই পরিচালনার দায়িত্ব পান ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক ও সিনিয়র সহসভাপতি শাকিল। ২০০৮ সালে নবম সংসদ নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপ প্রেসসচিবের দায়িত্ব পান তিনি। দুই বছর পর তাকে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারীর (মিডিয়া) দায়িত্ব দেয়া হয়। ২০১৪ সাল থেকে অতিরিক্ত সচিব মর্যাদায় প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারীর দায়িত্বে ছিলেন শাকিল।

মাহবুবুল হক শাকিল বিশিষ্ট কবি ও লেখক, এক সময়ের তুখোড়-মেধাবী ছাত্রলীগ নেতা হিসেবে পরিচিত। তার কবিতা বোদ্ধা মহলে বেশ প্রশংসিত হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। পৈতৃক নিবাস ময়মনসিংহ হলেও শাকিলের জন্ম ১৯৬৮ সালের ২০ ডিসেম্বর টাঙ্গাইলে। তার বাবা জহুরুল হক খোকা ময়মনসিংহ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং বর্তমানে জেলা পরিষদের প্রশাসক। মা শিক্ষকতা করেন। তিনি এক কন্যা সন্তানের জনক। আইনজীবী-শিক্ষক দম্পতির সন্তান মাহবুবুল হক শাকিল ময়মনসিংহ জেলা স্কুল ও আনন্দমোহন কলেজে পড়েছেন। সাবেক এই ছাত্রনেতার কবিতা লেখার শখ ছিলো। তার প্রকাশিত বই— খেরোখাতার পাতা থেকে ও মন খারাপের গাড়ী। গতকাল বিকাল ৫টার দিকে পুলিশের ফরেনসিক বিশেষজ্ঞরা রেস্তোরাঁর ভেতরে প্রবেশ করেন। সাড়ে ৫টায় আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম ঘটনাস্থলে আসেন। বিকাল ৫টা ৫০ মিনিটে মাহবুবুল হক শাকিলের মরদেহ নিয়ে অ্যাম্বুলেন্স সামদাদো থেকে বারডেমের উদ্দেশে রওনা হয়। এদিকে শাকিলের অসুস্থ হওয়ার খবরটি প্রথম তার ব্যক্তিগত ড্রাইভার হেলালকে জানায় রেস্টুরেন্ট কর্তৃপক্ষ। হেলাল বলেন, আমাকে হোটেল থেকে দুপুরের দিকে ফোন দিয়ে জানানো হয় স্যার অসুস্থ। তারপর আমি সবাইকে ফোনে খবর দিয়েছিলাম। আমরা ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে রেস্টুরেন্টের দ্বিতীয় তলায় গিয়ে দেখি, শাকিল স্যার একটি কম্বল গায়ে দেয়া অবস্থায় শোয়া আছেন। পরে আরো লোকজন এবং একজন ডাক্তারকে খবর দেয়া হয়। পরে ডাক্তার উপস্থিত হয়ে সেখানেই পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে শাকিল স্যারকে মৃত ঘোষণা করেন।

এদিকে ঘটনার পর রেস্টুরেন্টে আত্মীয়স্বজন উপস্থিত হলে তারা কান্নায় ভেঙে পড়েন। আর রাজনৈতিক নেতারা উপস্থিত হলে পরিবারের সদস্যরা তাদের জড়িয়ে ধরে কান্নাকাটি করতে থাকেন। ফলে সেখানে এক আবেগঘন পরিবেশের সৃষ্টি হয়। এদিকে সন্ধ্যা পৌনে ছয়টার দিকে আওয়ামী লীগের দফতর সম্পাদক ড. আব্দুস সোবহান গোলাপ সামদাদো রেস্টুরেন্টের সামনে সাংবাদিকদের বলেন, ‘ধারণা করা হচ্ছে শাকিল হূদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। সম্ভবত বেলা একটা-দেড়টার দিকে তিনি মারা যান। তবে ময়নাতদন্তের রিপোর্ট পাওয়ার পর মৃত্যুর বিস্তারিত কারণ জানা যাবে।’ এদিকে ঘটনাস্থলে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের উপস্থিতি লক্ষ করা গেছে। সিআইডির একটি দল ঘটনাস্থল থেকে বিভিন্ন আলামত সংগ্রহ করেছে।

এদিকে শাকিলের মৃত্যুর খবর শুনে ময়মনসিংহের বাড়িতে বারবার অজ্ঞান হয়ে পড়ছেন তার বাবা-মা। শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের সমবেদনা জানাতে শহরের ৩৮ নম্বর বাঘমারার বাসায় ছুটে যান ধর্মমন্ত্রী অধ্যক্ষ মতিউর রহমান, বিভাগীয় কমিশনার জিএম সালেহ উদ্দিন, পুলিশে রেঞ্জ ডিআইজি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন, জেলা প্রশাসক খলিলুর রহমান, জেলা পুলিশ সুপার সৈয়দ নরুল ইসলাম, পৌর মেয়র ইকরামুল হক টিটু, জেলা নাগরিক আন্দোলনের সভাপতি আনিসুর রহমান খানসহ প্রশাসন, রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনের লোকজন।

মাহবুবুল হক শাকিলের মৃত্যুর ঘটনায় গুলশানের সামদাদো রেস্টুরেন্টের ম্যানেজার বাবলুসহ ছয় ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসাবাদ করছে পুলিশ। গতকাল বিকেলে ঘটনার পর গুলশানের সামদাদো রেস্টুরেন্টের কর্মচারীসহ ছয়জনের কাছে শাকিলের মৃত্যুর বিষয়ে জানার চেষ্টা করছে পুলিশ। ঢাকা মহানগর পুলিশের কূটনৈতিক জোনের উপ-কমিশনার জসিম উদ্দিন বলেন, ‘এখনও কাউকে আটক দেখানো হয়নি। আমরা ঘটনাস্থলেই আছি। শাকিলের মৃত্যুর বিষয়টি আমরা খতিয়ে দেখছি।’

জেপি শোক: প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী মাহবুবুল হক শাকিলের মৃত্যুতে জাতীয় পার্টির (জেপি) চেয়ারম্যান এবং পরিবেশ ও বন মন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জু এমপি, সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক শিক্ষা মন্ত্রী শেখ শহীদুল ইসলাম গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন। এক যৌথ শোক বিবৃতিতে জেপি নেতৃদ্বয় বলেন, মাহবুবুল হক শাকিলের মৃত্যুতে একজন কবি ও সাংবাদিকের জীবনাবসান হলো। জেপি নেতৃদ্বয় মরহুমের রুহের মাগফেরাত কামনা করেন এবং শোক সন্তপ্ত-পরিবারবর্গের প্রতি আন্তরিক সমবেদনা জ্ঞাপন করেন। জাতীয় পার্টির (জেপি) নির্বাহী সম্পাদক সাদেক সিদ্দিকী ব্যক্তিগতভাবে শাকিলের মৃত্যুতে শোক জানিয়েছেন।

বিরোধীদলীয় নেতার শোক: এদিকে মাহবুবুল হক শাকিলের অকাল মৃত্যুতে জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ এমপি গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন। এক শোক বার্তায় বিরোধীদলীয় নেতা বলেন, ময়মনসিংহ জেলায় জন্ম নেয়া প্রয়াত মাহবুবুল হক শাকিল রাজনীতি ছাড়াও কবি ও সাহিত্যিক হিসেবে সকলের মাঝে পরিচিত ছিলেন। বিরোধীদলীয় নেতা মরহুমের রুহের মাগফিরাত কামনা এবং শোক সন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জ্ঞাপন করেছেন। মাহবুবুল হক শাকিলের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন জাসদের সভাপতি ও তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু এবং সাধারণ সম্পাদক শিরীন আখতার এমপি। এক যৌথ শোক বার্তায় নেতৃবৃন্দ বলেন, শাকিলের মৃত্যুতে দেশ এক প্রতিশ্রুতিশীল রাজনৈতিক কর্মীকে হারালো। এছাড়া গভীর শোক প্রকাশ করেছেন জাতীয় সংসদের ডেপুটি স্পিকার মো. ফজলে রাব্বি মিয়া, জাতীয় সংসদের চীফ হুইপ আ স ম ফিরোজ, কবি নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ড. মোহীত উল আলম, ট্রেজারার প্রফেসর এ এম শামসুর রহমান, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সভাপতি আবুল হাসনাত, বঙ্গবন্ধু পরিষদের সভাপতি লায়ন মো. গনি মিয়া বাবুল প্রমুখ।

সামদাদো রেস্টুরেন্ট সাময়িক বন্ধ: প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী মাহবুবুল হক শাকিলের মৃত্যুর ঘটনায় রাজধানীর গুলশান দুই নম্বরে সামদাদো নামের একটি জাপানি রেস্তোরাঁ সাময়িক বন্ধ করে দিয়েছে পুলিশ। মঙ্গলবার সন্ধ্যায় রেস্টুরেন্টটি সাময়িক বন্ধ ঘোষণা করা হয়।