স্টাফ রিপোর্টার: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অনুমোদনের পর গতকাল রবিবার প্রশাসনে তিন স্তরে (উপসচিব, যুগ্ম সচিব ও অতিরিক্ত সচিব) ৫৬৯ কর্মকর্তার পদোন্নতির আদেশ জারি করেছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। তবে পদোন্নতির এই প্রক্রিয়ায় যোগ্য হয়েও বঞ্চিত হয়েছেন ১ হাজার ৩১৭ জন কর্মকর্তা। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের হয়েও বঞ্চনার কষ্টে যখন অনেকেই চোখের জল ফেলছেন তখন ছাত্রজীবনে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী সংগঠনের সক্রিয় নেতারা পদোন্নতি পেয়ে অট্টহাসি হাসছেন! মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারী সরকারের আমলে এ ধরনের বৈপরিত্যের সমালোচনা করেছেন সচিবালয়ের অনেক কর্মকর্তা। অনেকে বলেছেন, পদোন্নতি প্রক্রিয়ায় জড়িত কারো কারো ব্যক্তিগত ইচ্ছায় এমন ঘটনা ঘটেছে। এবারের পদোন্নতির ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন প্রশাসন ক্যাডার বহির্ভূত কর্মকর্তারা। পদভেদে বিশেষ করে অতিরিক্ত সচিবের ক্ষেত্রে তিন শতাংশ পদ পেয়েছেন অন্য ক্যাডার কর্মকর্তারা। যেখানে ২৫ শতাংশ পদে তাদের পদোন্নতি পাওয়ার কথা। যদিও যুগ্মসচিব ও তদূর্ধ্ব পদের পদোন্নতির ক্ষেত্রে কোটার পরিবর্তে জ্যেষ্ঠতাকে ভিত্তি ধরার কথা বলা হয়েছে, কিন্তু জ্যেষ্ঠতাকেও উপেক্ষা করার অভিযোগ উঠেছে প্রবলভাবে।
গতকালের আদেশ থেকে জানা যায়, অতিরিক্ত সচিব পদে (৮৬ ব্যাচসহ) মোট ৫৮৭ জন যোগ্য কর্মকর্তার নাম বিবেচনার জন্য এসএসবি বৈঠকে উত্থাপন করা হয়। কিন্তু পদোন্নতি দেয়া হয়েছে ১৪৮ জনকে। এখানে মোট বঞ্চিত হয়েছেন ৪৩৯ জন। এসব কর্মকর্তার অনেকেই অন্তত পাঁচ দফা পদোন্নতি বঞ্চিত হলেন। ১১তম ব্যাচসহ যুগ্ম সচিব পদে ৫৭০ জনের নাম বিবেচনার জন্য বৈঠকে পাঠানো হয়। পদোন্নতির জন্য বিবেচিত হয়েছেন ১৯৩ জন। এখানে বঞ্চিত হয়েছেন ৩৭৭ জন। এখানে ১০ থেকে তদূর্ধ্ব ব্যাচের শতাধিক কর্মকর্তা পাঁচ দফা পদোন্নতি পাননি। অন্যান্য ক্যাডারের ২৫৪ জনসহ উপ-সচিব পদে বিবেচনার জন্য বৈঠকে প্রস্তাব করা হয় ৭২৯ জনের নাম। এরমধ্যে ২১তম ব্যাচের ১৬৫ জন কর্মকর্তা ছিলেন। এই পদে পদোন্নতি পেয়েছেন ২২৮ জন। এখানে বঞ্চিত হয়েছেন ৫০১ জন। উপ-সচিব পদে বিবেচনার জন্য অন্যান্য ক্যাডারের ক্ষেত্রে সবচেয়ে খারাপ নজির স্থাপন করা হয়েছে। ২০তম ব্যাচের একটি ক্যাডার থেকে কাউকে বিবেচনা না করে ২১তম ব্যাচের প্রশাসন ক্যাডার বর্হিভূত অন্য ক্যাডার কর্মকর্তাদের পদোন্নতি দেয়া হয়েছে। এটি প্রশাসনে কখনোই ঘটেনি।
প্রসঙ্গত, অতিরিক্ত সচিব পদে ৩ জন, যুগ্মসচিব পদে ৭ জন এবং উপ-সচিব পদে ২৪ জন লিয়েনে বা বিদেশে অবস্থান করায় তাদের পদোন্নতির আদেশ প্রকাশ করা হয়নি। তারা দেশে ফিরে জনপ্রশাসনে যোগ দিলে নিয়ম অনুযায়ী তা করা হবে। সেজন্য গতকাল ৫৩৫ জনের নাম প্রকাশ করা হয়। এর আগে সর্বশেষ পদোন্নতি হয়েছিল এ বছরের ১৫ মে। তখন অতিরিক্ত সচিব পদে ৮৭ জন, যুগ্মসচিব পদে ৬৯ জন এবং উপ-সচিব পদে ৬৪ জনকে পদোন্নতি দেয়া হয়।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা অবশ্য দাবি করছেন, বৈঠকে উত্থাপিত সকলেই যে যোগ্য ছিলেন তা নয়। অনেকেরই ‘ইমেজ’ সঙ্কট (এটি বঞ্চিত করার নতুন কৌশল) রয়েছে, নানাবিধ বিভাগীয় বিচার বিশ্লেষণ করতে গিয়ে অনেকে বাদ পড়েছেন। এর আগে ‘রাজনৈতিক’ কারণে বিভিন্ন দলীয় পরিচয়ে বঞ্চিত করার নজির রয়েছে।
উল্লেখ করা যেতে পারে, প্রশাসনে পদ ভেদে দুই, তিন ও চার বছর চাকরির অভিজ্ঞতা ও সমগ্র চাকরি জীবনের কর্মদক্ষতা এবং শিক্ষাগত যোগ্যতার ওপর নির্ভর করে পদোন্নতি বিবেচনা করার কথা। কিন্তু ৯০ দশকে নির্বাচিত সরকার পদ্ধতি চালু হওয়ার পর থেকে দেখা যায়, ‘আরও তথ্যের প্রয়োজন’ এরকম মন্তব্য লিখে অথবা ‘জনতার মঞ্চের কর্মকর্তা’ এই মন্তব্য লিখে অসংখ্য কর্মকর্তার পদোন্নতি আটকে রাখার রীতি চালু করা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় পরবর্তী সরকারগুলো এ অর্থাত্ আওয়ামী লীগ, বি অর্থাত্ বিএনপি, বিজে অর্থাত্ বিএনপি-জামায়াত আর জে অর্থাত্ ঘোর জামায়াত এভাবে কর্মকর্তাদের চিহ্নিত করে পদোন্নতি থেকে শুরু করে নিয়োগ/পদায়ন আটকে রাখার ধারা চালু করে। এরই ধারাবাহিকতায় এবারও অসংখ্য কর্মকর্তাকে বঞ্চিত রাখা হয়েছে। আবার অনেকে ফায়দাও লুটেছেন।
গতকাল সকালেই পদোন্নতিপ্রাপ্তদের নাম প্রকাশ করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় আদেশ জারি করে। এই আদেশ পেয়ে পদোন্নতিপ্রাপ্তরা উচ্ছ্বসিত হলেও তাদের অনেকের মধ্যেই চাপা ক্ষোভ লক্ষ্য করা গেছে। অনেকেই মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত এমন কর্মকর্তাদের পদোন্নতিতে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পদ সংখ্যার তুলনায় অস্বাভাবিক হারে পদোন্নতি দেয়ায় প্রশাসনের সাংগঠনিক কাঠামোয় বড় চাপ তৈরি হবে। তারা বলছেন, পদোন্নতিপ্রাপ্তদের সামাজিক মর্যাদা বাড়বে, কিছু আর্থিক সুবিধাও বাড়বে বটে কিন্তু তাদের প্রায় সকলকেই অধস্তন পদে থেকেই কাজ করতে হবে। কারণ এর আগের দফায় পদোন্নতিপ্রাপ্তরাই এখনো বসার জায়গা পাননি। বেশিরভাগই এখনও পদোন্নতিপূর্ব পদেই কাজ করছেন। অর্থাত্ যিনি অতিরিক্ত সচিব হয়েছেন তিনি কাজ করছেন যুগ্ম সচিবের, যুগ্ম সচিব কাজ করছেন উপ-সচিবের আর উপ-সচিব কাজ করছেন জ্যেষ্ঠ সহকারী সচিব তথা ডেস্ক অফিসারের পদে।