দশ বছরের বেশি বয়স হলেই হত্যা

 

স্টাফ রিপোর্টার: মিয়ানমারের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় রাখাইন রাজ্যের সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা গোষ্ঠীকে নিধনযজ্ঞে সেনাবাহিনীর টার্গেটে পরিণত হচ্ছে শিশুরা। হত্যা, ধর্ষণ আর নিপীড়ন থেকে বাঁচতে দেশ ছেড়ে পালাচ্ছে হাজার হাজার সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলিম। নিজেদের বাড়িঘর ছেড়ে প্রতিবেশী বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া লালু বেগম নামের এক রোহিঙ্গা নারী সিএনএনকে বলেন, ১০ বছরের বেশি বয়সী কোনো ছেলেকে পেলেই হত্যা করছে মিয়ানমার সেনারা। বহু রোহিঙ্গা পুরুষকে ধরে নিয়ে গেছে সেনাবাহিনী। তাদের কী পরিণতি হয়েছে- তা কেউ জানে না।

সিএনএনকে দেয়া সাক্ষাৎকারে বেশ কয়েকজন রোহিঙ্গা জানিয়েছেন, অনেক রোহিঙ্গা নারী সেনাবাহিনীর হাতে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। তারা নিজেদের চোখের সামনে বাড়িঘর পুড়ে যেতে দেখেছেন। তাদের পরিবারের লোকদের হত্যা করা হচ্ছে অথচ তারা কিছুই করতে পারছেন না। দেশ থেকে পালিয়ে আসার ভয়াবহ অভিজ্ঞতা সম্পর্কে লালু বেগম বলেন, ‘যখনই সেনারা আসে আমরা বাড়িঘর ছেড়ে অন্য কোথাও পালিয়ে থাকি। সেনারা আমার স্বামীকে ধরে নিয়ে গেছে। আমি এখনও জানি না আমার স্বামী বেঁচে আছেন নাকি মারা গেছেন। ৯ অক্টোবর সশস্ত্র একদল দুর্বৃত্ত মিয়ানমারের সীমান্ত এলাকার একাধিক পুলিশ চেকপোস্টে হামলা চালিয়ে ৯ জনকে হত্যার পর অস্ত্র নিয়ে পালিয়ে যায়। ওই হামলার প্রতিশোধ নিতে ওই এলাকায় নিরাপত্তা বাহিনী মোতায়েন করা হয়। তবে ওই এলাকায় সেনাবাহিনীর সহিংসতার অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছে সরকার। মিয়ানমারের কর্মকর্তারা বলছেন, রাখাইনে রোহিঙ্গারা নিজেদের বাড়িঘরে আগুন দিচ্ছে। মিয়ানমার সেনাবাহিনী ওই এলাকায় সাংবাদিক ও ত্রাণকর্মীদের প্রবেশে বাধা দিচ্ছে। তাই প্রকৃত ঘটনা যাচাই করা সম্ভব হচ্ছে না। লালু বেগম বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলীয় কুতুপালং ক্যাম্পে রয়েছেন। তিনি আরও জানান, তাদের গ্রামের বহু নারীকে ধর্ষণ করেছে সেনারা। যখনই কোনো নারীকে সেনাদের পছন্দ হতো, তখনই তারা পানি খাওয়ার কথা বলে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করে এবং নারীদের ধর্ষণ করে।’ লালু আরও বলেন, ‘যখন সেনারা আমাদের বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দিল, আমরা সেখান থেকে পালিয়ে অন্য গ্রামে আশ্রয় নিলাম। এরপর প্রতিনিয়ত আমরা এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রামে গেলাম। এরপর চার দিন পর গভীর রাতে নাফ নদী হয়ে বাংলাদেশে এলাম। নাফ নদী পাড়ি দিতে গিয়ে নৌকাডুবিতেও বহু রোহিঙ্গার মৃত্যু হয়েছে বলে জানান মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা অনেকেই।

রোহিঙ্গাদের ওপর নিষ্পেষণ চলছে- অ্যামনেস্টি: আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এক বিবৃতিতে বলেছে, মিয়ানমার সরকার দেশটির সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলমানদের সমষ্টিগতভাবে শাস্তি দিচ্ছে। এ থেকে বাঁচতে নাফ নদী পেরিয়ে বাংলাদেশে ঢোকার চেষ্টা করলে তাদের পুশব্যাক করছে বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষ। বিবৃতিতে মিয়ানমারের আচরণকে ‘নিষ্ঠুর’ আখ্যা দিয়ে সংস্থাটি বলছে, এটি আন্তর্জাতিক আইনের লংঘন।

বিবৃতিতে সংস্থাটির দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক পরিচালক চম্পা প্যাটেল বলেন, মিয়ানমার থেকে আসা মানুষরা, যারা নাফ নদীতে বা ভূমিতে আত্মগোপন করে আছেন, তারা খাবার, পানি এবং জরুরি চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। বাংলাদেশে এবং মিয়ানমারে থাকা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সঙ্গে কথা বলে অ্যামনেস্টি জানতে পেরেছে, মিয়ানমারে সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে নিরাপত্তা বাহিনী রোহিঙ্গা পুরুষদের হত্যা করছে, নারীদের ধর্ষণ করছে, বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ এবং লুটতরাজ চালাচ্ছে। সংস্থাটির হিসাব অনুযায়ী, এরই মধ্যে অন্তত দুই হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে ঢুকে আশপাশের গ্রামে, শরণার্থী শিবিরে এবং বস্তিতে আশ্রয় নিয়েছে। যে কারণে তাদের সঠিক সংখ্যা নিরূপণ সম্ভব নয় বলে জানিয়েছেন চম্পা প্যাটেল।

এশিয়ার বিভিন্ন দেশে রোহিঙ্গা নিধনের প্রতিবাদে বিক্ষোভ: মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলিমদের নিধনের প্রতিবাদে এশিয়ার বিভিন্ন দেশে বিক্ষোভ সমাবেশ হয়েছে। বাংলাদেশসহ ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ড এ নির্যাতনের প্রতিবাদে বিক্ষোভ করেছে। জুমার নামাজ শেষে রোহিঙ্গাদের জন্য মোনাজাতও করা হয়েছে। এএফপির খবরে বলা হয়, মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ মালয়েশিয়ার মন্ত্রিসভা থেকে এর নিন্দা জানিয়ে এক বিবৃতি দেয়া হয়েছে। ওই বিবৃতিতে বলা হয়, মিয়ানমার সরকারকে এসব অভিযোগ খতিয়ে দেখতে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়ার জন্য আহ্বান জানাচ্ছে মালয়েশিয়া সরকার। আরও বলা হয়, এ ইস্যুতে মিয়ানমারের কূটনীতিককে তলব করা হবে এবং অতি দ্রুত সময়ের মধ্যে মিয়ানমারের নেতা অং সান সুচির সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন মালয়েশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী আনিফাহ আমান। কুয়ালালামপুর মসজিদ থেকে ৫ শতাধিক বিক্ষোভকারী রাখাইন রাজ্যের গণহত্যার প্রতি নিন্দা প্রকাশ করে র‌্যালি করেন। ইন্দোনেশিয়ান ইসলামিক অর্গানাইজেশন মিয়ানমার দূতাবাসের বাইরে এক বিক্ষোভের আয়োজন করে। সেখানেও হাজার হাজার বিক্ষোভকারী অংশ নেন।