ঝিনাইদহের কালীগঞ্জে মোবারকগঞ্জ চিনিকলে ১ কেজি চিনি উৎপাদনে খরচ ১৪৮ টাকা : বিক্রি ৬০টাকা!

 

প্রায় ১শ ৫০ কোটি টাকা লোকসানের বোঝা নিয়ে ডিসেম্বরে মাড়াই মরসুম শুরু

শিপলু জামান: ঝিনাইদহের মোবারকগঞ্জ চিনিকলে ২০১৫-১৬ আখ মাড়াই মরসুমে এক কেজি চিনি উৎপাদন করতে খরচ পড়েছে  প্রায় ১৪৮.৪৫ টাকা। এ হিসেবে এ মরসুমে লোকসান হয়েছে প্রায় ৩৩ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে মিলটি শুরুর পর থেকে প্রায় ১শ ৫০ কোটি টাকা লোকসানে রয়েছে। আর এই ব্যাংক ঋনের বোঝা মাথায় নিয়ে ডিসেম্বর মাসের ১৫ তারিখে মিলটি ২০১৬-১৭ মাড়াই মরসুম চালু করতে যাচ্ছে কর্তৃপক্ষ। এর আগে যেখানে ৪/৫ মাস ধরে মিলে মাড়াই কার্যক্রম চলতে এখন আখের অভাবে মাত্র ১/২ মাস চলছে। মিল কর্তৃপক্ষ আখচাষিদের উদ্ভুদ্ধ করতে না পারায় কৃষকরা আখ চাষে আগ্রহ দেখাচ্ছে না। এদিকে মিলে প্রায় ৩৬ কোটি ৫০ লাখ টাকার ৬১২৪ মেট্রিক চিনি  অবিক্রিত রয়েছে।

মোবারকগঞ্জ চিনিকলসূত্রে জানা গেছে,  গত ২০১৫-১৬ আখ মাড়াই মরসুমে মিল কর্তৃপক্ষ কৃষকদের ৪৮৮৩ একর জমিতে আখ লাগাতে সক্ষম হয়। এ মরসুমে ৭০১৬১ মেট্রিকটন আখ মাড়াই করে ৪১২৪.১০ মেট্রিকটন চিনি উৎপাদন করে। এ মরসুমে মাত্র ৫৯ দিন মাড়াই কার্যক্রম চলে। এ মরসুমে ১ কেজি চিনি উৎপাদনে মিলের খরচ হয়েছে ১৪৮.৪৫ টাকা। প্রতিকেজি চিনি বিক্রি করেছে মাত্র ৪৭ টাকা দরে। তাও আবার রাস্তায় রাস্তায় ফেরি করে। পরে গত ২ মাস আগে মিলকর্তৃপক্ষ চিনির দাম বাড়িয়ে ৬০ টাকা করেছে। আগামী ২০১৬-১৭ আখ মাড়াই মরসুম শুরু হবে ১৫ ডিসেম্বর। এবার ৪৯৪১.৫৪ একর জমিতে লাখ রয়েছে। এবার ৯০৪২৫ মেট্রিক টন আখ সংগ্রহের লক্ষমাত্রা রযেছে। চিনি আহরনের হার ধরা হয়েছে ৭.৫%। মিলটি এবার ৭৫দিন মাড়াই দিবস ধরা হয়েছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বেশ কিছু শ্রমিক জানান, মিলটি প্রতি বছর এত কোটি কোটি টাকা লোকসান দিচ্ছে যা  হওয়ার কথা না। এক শ্রেণির কর্মকর্তারা ও শ্রমিক ইউনিয়নের নেতৃবৃন্দর দুর্নীতির কারণে মিলটিতে লোকসান হচ্ছে। বিভিন্ন ধরনের কেনাকাটার মাধ্যমে দুর্নীতি করছে। তারা আরও জানায়, মিলে যেখানে প্রতিবছর লোকসান হচ্ছে সেখানে প্রায়ই চুক্তিভিত্তিক শ্রমিক নিয়ে লোকসানের বোঝা বাড়াচ্ছে। এছাড়াও অদক্ষ চুক্তিভিত্তিক শ্রমিক নেয়ার কারণে আখ মাড়াই শুরুর পর থেকেই মিলে বারবার ব্রেক ডাউন হচ্ছে। বন্ধ থাকছে  উৎপাদন কার্যক্রম।

মোবারকগঞ্জ চিনিকলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক দেলোয়ার হোসেন জানান, এক কেজি চিনি উৎপাদনে যে খরচ হয় তাতে ৩ ভাগের একভাগ দরে ভোক্তাদের কাছে চিনি বিক্রি করে সরকার। চিনির দাম কম থাকায় সুগারমিলটির লোকসান হচ্ছে। তিনি আরও জানান এক কেজি চিনি উৎপাদন করতে সব খরচ মিলিয়ে প্রায় ১৪৮ টাকা খরচ হয়। সেখানে বর্তমানে চিনির দাম মাত্র ৬০ টাকা। কৃষকরা আগের মতো আর আখ লাগাচ্ছে না এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি জানান, মিলকর্তৃপক্ষ, শ্রমিক ইউনিয়নের নেতৃবৃন্দ প্রায় প্রতিদিনই কৃষকদের দ্বারে দ্বারে গিয়ে তাদের আখ লাগাতে উদ্বুদ্ধ করছে। তাদের কে বোঝানো হচ্ছে। তিনি আরও জানান, এই মিলটি লাভজনক করতে চিনি উৎপাদনের পাশাপাশি আর কি করা যায় তা নিয়ে বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প কর্পোরেশনের সাথে সরকারের আলোচনা চলছে।

বাংলাদেশ চিনিকল শ্রমিক কর্মচারী কল্যাণ ফেডারেশনের সভাপতি আতিয়ার রহমান জানান, মিলটিকে লাভজনক করতে তারা বিভিন্ন কার্যক্রম করছে। তারা আখচাষিদের আখ লাগাতে উদ্বুদ্ধ করছে। চিনির দাম  বাড়ানোর জন্য সরকারের সাথে আলোচনা করছে। ইতোমধ্যে সকার সুগার মিলগুলো লাভজনক করতে ৭৮০ কোটি টাকা দিয়েছে। এবার ঠাকুরগাও সুগার মিল ও নর্থ বেঙ্গল সুগার মিলে বায়ো ফার্টিলাইজার, রিফাইনারী সুগার ও ডিসটেলারী কার্যক্রম শুরু করা হবে। বছরের ১২ মাস মিলটি চালু রাখার জন্য খুব শিঘ্রই মোবারকগঞ্জ চিনিকলে চিনি উৎপাদনের পাশাপাশি মিনারেল ওয়াটার ও রিফাইনারী সুগারের কার্যক্রম শুরু হবে।

উল্লেখ্য, ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলা শহরের নলডাঙ্গায় ১৯৬৫ সালে ৩ কোটি ৪৮ লাখ টাকা ব্যয়ে মোট ১৮৯.৮১ একর নিজস্ব সম্পত্তির ওপর নেদারল্যান্ড পদ্ধতিতে সরকার মোবারকগঞ্জ চিনিকলটি স্থাপন করে। এর মধ্যে ২০.৬২ একর জমিতে কারখানা, ৩৮.২২ একর জমিতে স্টাফদের জন্য আবাসিক কলোনি, ২৩.৯৮ একর জমিতে পুকুর ও প্রায় ১০০ একর জমিতে পরীক্ষামূলক ইক্ষু খামার স্থাপিত হয়। প্রতিষ্ঠাকালীন মরসুমে পরীক্ষামূলকভাবে ৬০ কর্মদিবস আখ মাড়াই চলে এবং প্রথম মরসুমে ১০ হাজার মেট্রিক টন আখ মাড়াই করে ১ হাজার মেট্রিকটন চিনি উৎপাদন হয়েছিলো। লক্ষ্য পূরণ হওয়ায় পরবর্তী ১৯৬৭-৬৮ মাড়াই মরসুম থেকে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে চিনিকলটি তাদের অনইয়ার বা উৎপাদন শুরু করে। ঝিনাইদহের ৬ উপজেলা ছাড়াও যশোরের দুটি উপজেলা নিয়ে গঠিত হয় মোচিক জোন। জোনের আওতায় মোট চাষযোগ্য জমির পরিমাণ রয়েছে সাড়ে ৩ লাখ একর।