আড়াই প্যাঁচে ঘোরে হালিমার জীবনের চাকা!

 

মাজেদুল হক মানিক: আমার কোনো আঁধার নিই বিটা (ছেলে)। স্বামী গতরে খাটতে পারে না। অচল মানুষ বিটা। তার আয়ে সংসার চলে না। মেয়েলোক দোকানদারি করি বলে লোকজনে নানান কথা বলাবলি করে। কিন্তু কি আর করবো? উপায়তো নেই। তাই এই ব্যবসা বেছি নিছি। এভাবেই কথাগুলো বলছিলেন জিলাপি বিক্রেতা হালিমা খাতুন (৫৫)। মেহেরপুরের গাংনী উপজেলার রাধাগোবিন্দপুর ধলা গ্রামের পাকা সড়কের পাশে জিলাপি তৈরি করে বিক্রি করেন।

জীবন সংগ্রামের বর্ণনা দিতে গিয়ে হালিমা খাতুন বলেন, তার স্বামীর নাম আমেরিকা। ধনী ও উন্নত রাষ্ট্রের  নামের সাথে তার স্বামীর নাম হলেও বাস্তবে অবস্থা সম্পূর্ণ বিপরিত। শারীরিকভাবে যেমনি অসুস্থ তেমনি অর্থনৈতিকভাবেও পঙ্গু। একমাত্র ছেলে আসাদুল ইসলাম দুই মেয়ে ও স্ত্রীকে নিয়ে আলাদা। মাছের ব্যবসা করে কোনোমতে তার সংসার চলে। মা বাবাকে দেখভাল করার মতো সামর্থ নেই। তাই অচল স্বামীর খেদমত করতেই নিজেই কাঁধে তুলে নেন সংসারের যাবতীয় দায়িত্ব। বেশ কয়েক বছর আগে একটি এনজিও থেকে ১০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে জীবন যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন হালিমা খাতুন। গ্রামের পাকা সড়কের পাশে চুলা জ্বেলে জিলাপি ও পিঁয়াজু বড়া তৈরি করেন। প্রথম দিকে বেচাবিক্রি কম হলেও এখন তা মোটামুটি পর্যায়ে। ঋণের কিস্তি দিয়ে যা অবশিষ্ট থাকে তা নিয়ে সংসার চলে না। ধার-দেনা করে কোনোমতে দু বেলা আহার জোগাচ্ছেন তিনি। ওই গ্রামের জাহাঙ্গীর আলম ও তার পরিবারের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে তিনি বলেন, তাদের জমির গর্ত ভরাট করে টিনের চালা তৈরি করেছি। এর মধ্যে দুটি বেঞ্চ ক্রেতাদের বসার জায়গা। গ্রামের মানুষ ছাড়াও পথচারী অনেকেই জিলাপি ও বড়া খেতে আসেন। প্রতিদিন ৩০০-৫০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়। লাভ ১০০-১৫০ টাকা। এই টাকা দিয়েই স্বামী-স্ত্রী মিলে কোনোমতে জীবন চলে।

সংগ্রামী জীবনের গল্প শোনাতে গিয়ে হালিমা আরো খাতুন বলেন, ভিক্ষা কিংবা অন্যের কাছে হাত পেতে টাকা নেয়া ভালো কাজ নয়। এতে সম্মান থাকে না। সঞ্চয় না হলেও নিজের আয় দিয়ে সংসার চালানোতে অনেক তৃপ্তি। শ্বশুরের আমলে সরকারি বরাদ্দ পাওয়া এক টুকরো জমিতে টিনের ঘর করে বসবাস করেন স্বামী-স্ত্রী। অন্য কোনো জমিজমা নেই। তাই এই আয় দিয়েই জীবনের বাকি সময় স্বামীর খেদমত করে যাওয়ার আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি। সংগ্রামী এই জীবনে বাধা-বিপত্তি প্রতি পদে পদে বলে জানালেন এই প্রত্যয়ী নারী। তিনি বলেন, সমালোচকদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করেই তার পথচলা। তিনি পিছু হঁটেননি। পেটের তাগিদেই চোখ-কান বন্ধ করে কাজ করে যাচ্ছি। মহিলা হয়ে কীভাবে পুরুষ মানুষের মতো দোকানদারি করে এমন সমালোচনা বিব্রত করে হালিমাকে। তবুও হার না মানা হালিমা এগিয়ে চলেছেন স্বমহিমায়। নিজের পায়ে দাঁড়ানোর এক অন্যন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন বলে মতামত ব্যক্ত করেন গ্রামের অনেকেই। ওই গ্রামের যুবক রনি মিয়া জানান, হালিমার জিলাপি ও পিঁয়াজু বড়া এলাকার মানুষের কাছে বেশ প্রিয়। খাওয়ার পাশাপাশি অনেকেই আত্মীয়স্বজনদের বাড়িতেও নিয়ে যায়। জিলাপি কেনার মাধ্যমে তার জীবনযুদ্ধে সহযোগিতা করছি।