সকল জরিপ টপকে ট্রাম্পের জাদুকরী জয়

 

মাথাভাঙ্গা মনিটর: প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তিনটি শব্দ। এই শব্দ তিনটি লাখ লাখ আমেরিকান এবং বিশ্বের অধিকাংশ মানুষের কাছে অচিন্ত্যনীয় ছিলো। কিন্তু বিস্ময়কর হলেও সত্য, ডোনাল্ড ট্রাম্পই যুক্তরাষ্ট্রের ভবিষ্যত। মার্কিনীরা আস্থা রেখে দেশের নেতৃত্ব তুলে দিলেন রিপাবলিকান প্রার্থী ট্রাম্পের হাতে। ট্রাম্পের জাদুতে পাল্টে গেলো সকল হিসাব নিকাশ। গত দেড় বছরের সব আলোচনা, সমালোচনা এবং জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে ট্রাম্পই এখন বিশ্বের ক্ষমতাধর দেশটির ৪৫তম কর্ণধার। ৫৩৮ ইলোক্টোরাল ভোটের মধ্যে ২৯০টি পেয়ে হোয়াইট হাউসে প্রবেশ করছেন ট্রাম্প, যেখানে নির্বাচিত হতে দরকার ২৭০টি ইলেক্টোরাল ভোট। পপুলার ভোটেও এগিয়ে ট্রাম্প। ট্রাম্পের জয়ে তার সমর্থকরা যেমন উল্লসিত তেমনি ডেমোক্র্যাট প্রার্থী হিলারি রডহ্যাম ক্লিনটনের পরাজয়ে তার সমর্থকের অনেকে কান্নায় ভেঙে পড়েন। জয়ের পর ট্রাম্প এক ভাষণে আমেরিকার স্বার্থকে প্রাধান্য দেয়া এবং তিনি সবার প্রেসিডেন্ট বলে উল্লেখ করেন। হিলারি পরাজয় স্বীকার করে নির্বাচিত ট্রাম্পকে অভিননন্দন জানিয়েছেন। অভিনন্দন জানিয়েছেন প্রেসিডেন্ট ওবামাও। মার্কিন কংগ্রেসেও আধিপত্য বজায় রেখেছে রিপাবলিকান দল। জাদুকরী জয়ে বিশ্ব নেতাদের অভিনন্দনে সিক্ত ট্রাম্প। মূলত শ্বেতাঙ্গ আর ধনীদের ভোটেই জয় পান ৭০ বছর বয়সী ট্রাম্প। ট্রাম্পের জয়ে মার্কিন ফার্স্ট লেডি হচ্ছেন মেলানিয়া ট্রাম্প।

ট্রাম্পের ইতিহাস: প্রাইমারি নির্বাচনে যেমন রিপাবলিকান দলের বাঘা বাঘা নেতাদের হারিয়ে দলের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মনোনয়ন পান তেমনি মূল নির্বাচনেও তিনি হিলারির মতো রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা সম্পন্ন এক রাজনীতিককে হারিয়ে দিয়ে বিশ্বে ইতিহাস সৃষ্টি করলেন। ট্রাম্পের বিরুদ্ধে সমালোচনা কেবল বিরোধী দলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলো না, নিজ দলের অনেক নেতাও তাকে সমর্থন দেননি। তার বিরুদ্ধে বিদ্বেষমূলক বক্তব্যও দিয়েছেন। ১৯৬৪ সালের পর এই প্রথম কোনো প্রার্থী দলের মূল অংশকে পাশ কাটিয়ে দলীয় মনোনয়ন পান। আর ১৯৪০ সালের পর এই প্রথম কেউ সরকারি কিংবা সামরিক কাজের অভিজ্ঞতা ছাড়াই দলীয় প্রার্থী মনোনীত হন এবং প্রেসিডেন্টও নির্বাচিত হলেন। আবার ১৯৩২ সালের পর প্রথম মুক্তবাণিজ্য বিরোধী কোনো প্রার্থী একটি দল থেকে মনোনীত হন। মার্কিন মিডিয়ার একটি বড় অংশ হিলারিকে কেবল সমর্থনই দেননি, যথারীতি ট্রাম্পকে সমালোচনার মাধ্যমে তুলোধুনা করেছেন। মার্কিন প্রভাবশালী সংবাদপত্র নিউইয়র্ক টাইমস বলেছে, ট্রাম্পের এই জয় মার্কিন মিডিয়ার জন্যও একটি বড় ধাক্কা। খুব কম জরিপেই হিলারির চেয়ে ট্রাম্প এগিয়ে ছিলেন। কিন্তু এসব জরিপ যে মিথ্যা তা প্রমাণ করলেন ট্রাম্প। ভোট দিতে গিয়ে ট্রাম্প বলেছিলেন, মার্কিন জনগণ ভোটের মাধ্যমেই তাদের সিদ্ধান্ত জানাবেন। সেটাই ঘটলো। জনগণ নীরব ভোট বিপ্লবের মাধ্যমে ট্রাম্পকে হোয়াইট হাউসে পাঠালেন। গত বছর জুনে ট্রাম্প দলীয় মনোয়নের কথাঘোষণা করেন এবং প্রেসিডেন্ট হওয়ার আশা প্রকাশ করেন। তখন সাংবাদিকদের অনেকেও হেঁসেছিলেন। কিন্তু সেই ট্রাম্পই এখন যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান নেতা। অনেক বিশ্লেষক, ট্রাম্পের এই জয়কে ব্রিটেনের ব্রেক্সিট ভোটের সঙ্গে তুলনা করছেন। তারা বলছেন, ব্রিটেনে যেমন অভিবাসী বিরোধী অবস্থান নিয়ে ব্রেক্সিটপন্থীদের জয় হয়েছিল, তেমনি জয় হয়েছে ট্রাম্পের। ট্রাম্প তার বক্তব্যে হিলারির প্রশংসা করে বলেছেন, এখন সময় আমেরিকার ঐক্যবদ্ধ হওয়ার।

ইলেক্টোরাল ভোট জয়ে ট্রাম্প জাদু: শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত ৫০টি অঙ্গরাজ্যের ৫৩৮টি ইলেক্টোরাল ভোটের মধ্যে ২৯০টি ভোট পেয়েছেন ট্রাম্প। বিপরীতে হিলারি ক্লিনটন পেয়েছেন ২১৮টি। ট্রাম্প ৪৭ দশমিক ৮ ভাগ (৫ কোটি ৯০ লাখ ৫৮ হাজার ৩০৭ ভোট) এবং হিলারি ৪৭ দশমিক ৫ ভাগ (৫ কোটি ২০ লাখ ৪ হাজার ৪০৮ ভোট) পপুলার ভোট পেয়েছেন। ট্রাম্পের জয় পাওয়া রাজ্যগুলোর মধ্যে রয়েছে, আলাবামা (৯ ইলেক্টোরাল ভোট), আলাস্কা (৩), অ্যারিজোনা (১১), আরকানসাস (৬), ফ্লোরিডা (২৯), জর্জিয়া (১৬), আইডাহো (৪), আইওয়া (৬), কানসাস (৬), ইন্ডিয়ানা (১১), কেনটাকি (৮), লুইজিয়ানা (৮), মিশিগান (১৬), মিসিসিপি (৬), মিসৌরি (১০), মন্টানা (৩), নেব্রাস্কা (৫), নর্থ ক্যারোলিনা (১৫), নর্থ ডাকোটা (৩), ওহাইও (১৮), ওকলাহোমা (৭), পেনসিলভানিয়া (২০), সাউথ ক্যারোলাইনা (৯), সাউথ ডাকোটা (৩), টেনেসিস (১১), টেক্সাস (৩৮), উটাহ (৬), ওয়েস্ট ভার্জিনিয়া (৫), উইসকনসিন (১০), উইওমিংয়ে (৩)। তবে নিউইয়র্ক (২৯) ও ওয়াশিংটনে (১২) জয় পেয়েছেন হিলারি। মিনোসোটায় ও নিউ হ্যাম্পশায়ারে হিলারি এগিয়ে।

গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গরাজ্যগুলোতে জয়ই ট্রাম্পের জয় এনে দিয়েছে। সাউথ ক্যারোলাইনা, নর্থ ক্যারোলাইনা, ফ্লোরিডা, উটাহ, ওহাইও, অ্যালাবামা, ম্যাসাচুসেটস, ওয়েস্ট ভার্জিনিয়ায় জয় পান ট্রাম্প। জিততে হলে হিলারির প্রয়োজন ছিল মিশিগান, পেনসিলভানিয়া এবং উইসকিনসনে জয়। উইসকনসিনে ১৯৮৪ সালের পর রিপাবলিকান দলের কোনো ইলেক্টর জয় পাননি। কিন্তু এবার জয় এসেছে। একই অবস্থা পেনসিলভানিয়ায়ও। ১৯৮৮ সালের পর এই প্রথম রিপাবলিকান দল সেখানে জিতেছে। গত দুটি নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট ওবামা আইওয়া, ওহাইও এবং মিসৌরিতে জয় পেয়েছিলেন। কিন্তু এবার ট্রাম্প সেখানে জয় পেয়েছেন। গতকাল বুধবার বাংলাদেশ সময় সকাল ৭টা থেকেই ফলাফল আসতে শুরু করে। মঙ্গলবার সকাল থেকে ৫০টি অঙ্গরাজ্যে ভোট গ্রহণ শুরু হয়। রাজ্য ভেদে ১১ থেকে ১৩ ঘণ্টা ভোট গ্রহণ চলে।

কংগ্রেসেও আধিপত্য রিপাবলিকানের: শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত কংগ্রেসের নিম্নকক্ষ প্রতিনিধি পরিষদে রিপাবলিকানরা ৪৩৫ আসনের ২৩৬ আসন পেয়েছে। ডেমোক্র্যাটরা পেয়েছে ১৯১ আসন। আর উচ্চকক্ষ সিনেটে রিপাবলিকানরা ১০০ আসনের ৫১টি আসন পেয়েছে। এখানে ডেমোক্র্যাটরা পেয়েছে ৪৭ আসন। কংগ্রেসে ফ্লোরিডা, পেনসিলভানিয়া এবং ইন্ডিয়ানায়ও বড় ধরনের জয় পেয়েই কংগ্রেসে তাদের আধিপত্য বজায় রাখতে সমর্থ হয়েছে।

ট্রাম্পের জয়ের পাঁচ কারণ: বুথ ফেরত জরিপ অনুযায়ী, পাঁচটি কারণ ট্রাম্পের জয়ের পেছনে ভূমিকা রেখেছে। প্রথমত, শ্বেতাঙ্গ সমর্থন। ওহাইও, ফ্লোরিডা, এবং নর্থ ক্যারোলাইনার শ্বেতাঙ্গ প্রধান রাজ্যগুলো একের পর এক ট্রাম্পের পক্ষে সমর্থন দিয়েছেন। দেশটিতে শ্বেতাঙ্গ ভোটার ৬৯ ভাগ। এর মধ্যে ৫৮ ভাগ ট্রাম্পকে এবং ৩৭ ভাগ হিলারিকে ভোট দিয়েছেন। শ্বেতাঙ্গ পুরুষদের মধ্যে ৬৩ ভাগ ট্রাম্পের এবং ৩১ ভাগ হিলারির পক্ষে ভোট দিয়েছেন। আর শ্বেতাঙ্গ নারীদের ৫৩ ভাগ ট্রাম্প এবং ৪৩ ভাগ ভোট দিয়েছেন হিলারিকে। কলেজের নিচে পড়ুয়াদের মধ্যে ৬৭ ভাগই ট্রাম্পকে ভোট দিয়েছেন যাদের মধ্যে ৭২ ভাগ নারী এবং ৬২ ভাগ নারী। কলেজ শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৪৫ ভাগ হিলারিকে ভোট দিয়েছেন। এদের মধ্যে ৩৯ ভাগ পুরুষ এবং ৫১ ভাগ নারী। ১৮ থেকে ২৯ বছর বয়সী শ্বেতাঙ্গদের ৪৮ শতাংশ ট্রাম্পের এবং ৪৩ শতাংশ হিলারিকে ভোট দিয়েছেন। আর অশ্বেতাঙ্গ ভোট মাত্র ৩১ শতাংশ যার মধ্যে হিলারির পক্ষে গেছে ৭৪ ভাগ এবং ট্রাম্পের পক্ষে ২১ ভাগ। ট্রাম্প ১৮ থেকে ২৯ বছর বয়সী কৃষ্ণাঙ্গদের ৯ ভাগ এবং ল্যাটিনোদের ২৪ ভাগ ভোট পেয়েছেন। হিলারি অশ্বেতাঙ্গ (কৃষ্ণাঙ্গ ও ল্যাটিনো) ভোট পেয়েছেন ৮৮ ভাগ। কিন্তু চার বছর আগে ওবামা ৯৩ ভাগ ভোট পেয়েছিলেন। হিলারি ল্যাটিনো ভোট পেয়েছেন ৬৫ ভাগ যেখানে ওবামা পেয়েছিলেন ৭১ ভাগ। ট্রাম্প কৃষ্ণাঙ্গদের ৮ ভাগ এবং ল্যাটিনোদের ২৯ ভাগ ভোট পেয়েছেন। গত বছর নির্বাচনে রিপাবলিকান প্রার্থী মিট রমনির চেয়ে দুই ভাগ ভোট বেশি পেয়েছেন। এছাড়া ট্রাম্পের নির্বিকার ভূমিকা, এফবিআইয়ের জেমস কোমির আবির্ভাব, একার লড়াই এবং আলাদা প্রচারণা কৌশলও ট্রাম্পের জয়ে ভূমিকা রেখেছে।

ওবামাহিলারির ফোন: প্রেসিডেন্ট ওবামা বিজয়ী প্রার্থী ট্রাম্পকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। তিনি আজ বৃহস্পতিবার ট্রাম্পকে হোয়াইট হাউসে চায়ের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। এর আগে মঙ্গলবার রাত আড়াইটার দিকে উইসকনসিনে হারের খবর শুনেই নিজের পরাজয় সম্পর্কে নিশ্চিত হন হিলারি। তিনি ট্রাম্পকে ফোন করে অভিনন্দন জানান এবং পরাজয় স্বীকার করেন। তবে তিনি প্রচলিত প্রথা অনুযায়ী বক্তব্য দেননি। পরে বক্তব্য দেবেন বলে দলের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। তিনি তার দলের উপদেষ্টা জন পডেস্টাকে সমর্থকদের বাড়ি ফিরে যেতে বলার অনুমতি দেন। ট্রাম্পের বিরুদ্ধে নিউইয়র্ক,লস অ্যাঞ্জেলস এবং ওয়াশিংটন ডিসিতে বিক্ষোভের খবর পাওয়া গেছে।

ইতিহাস গড়া হলো না যুক্তরাষ্ট্রের: যুক্তরাষ্ট্রের ২৪০ বছরের ইতিহাসে প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হন হিলারি। ধারণা করা হয়েছিলো, ক্ষমতাধর দেশটির হোয়াইট হাউসে যাবেন প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট। কিন্তু সেই ইতিহাস আর গড়া হলো না। হিলারিকে পরাজয় স্বীকার করতে হয়েছে পুরুষ প্রার্থীর কাছে।