চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে দালালচক্রের উৎপাতে প্রতিনিয়ত প্রতারিত হচ্ছে রোগী সাধারণ : দুজনের শাস্তিতে কিছুটা স্বস্তি

 

স্টাফ রিপোর্টার: চুয়াডাঙ্গার সদর উপজেলার খেজুরতলা গ্রামের গৃহবধূ রহিমা খাতুন তার স্বামী তসলিম উদ্দিনকে (৪৬) নিয়ে গত বৃহস্পতিবার সকালে চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে আসেন। তার স্বামী বেশ কয়েকদিন ধরে পেটের ব্যথায় ভুগছিলেন। ডাক্তার রোগী দেখে এক্স-রে ও আলট্রাসনোগ্রাম করতে বলেন। তিনি স্বামীকে নিয়ে ডাক্তারের চেম্বার থেকে বেরোনোর পর এক লোক এসে প্রেসক্রিপশনটি দেখতে চান। দেখে বলেন, হাসপাতালের এক্স-রে ও আলট্রাসনোগ্রাম মেশিন নষ্ট। বাইরের এক ডায়াগনস্টিক সেন্টারে পরীক্ষার ফল ভালো আসে। ওই সময় রহিমা খাতুন রোগী নিয়ে এতোটাই উদ্বিগ্ন ছিলেন যে সহজেই প্রভাবিত হয়ে যান। ওই লোকের পরামর্শ অনুসারে ওই ডায়াগনস্টিক সেন্টারে ৬শ টাকায় এক্স-রে, আলট্রাসনোগ্রাম করে আসেন। পরে হাসপাতালে এসে জানতে পারেন এ দুটো পরীক্ষাই হাসপাতালে হচ্ছে মাত্র ২২০ টাকায়।

একই ধরনের অভিযোগ করেন চুয়াডাঙ্গা শহরের পুরাতনপাড়ার মিনারুল ইসলাম। তিনি জানান, তার এক নিকট আত্মীয় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় জরুরি পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রয়োজন হয়। হাসপাতালে প্রতিটি পরীক্ষার ব্যবস্থা থাকলেও দালালেরা তাকে বাইরের রোগনির্ণয় কেন্দ্র থেকে পরীক্ষার জন্য প্রভাবিত করেন। চুয়াডাঙ্গার ১শ শয্যার আধুনিক সদর হাসপাতালে এমন অভিযোগ মেলে ভূরি ভূরি।

সেখানে চিকিৎসা নিতে আসা রোগী ও তাদের স্বজনেরা প্রতিনিয়তই এভাবে দালালদের খপ্পরে পড়েন। সরকারি হাসপাতাল থেকে রোগী নিয়ে ব্যক্তিমালিকানাধীন ক্লিনিকে ভর্তি করা থেকে শুরু করে রোগীর বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য ডায়াগনস্টিক সেন্টারে যেতে প্রভাবিত করে এই দালালেরা। তারা সরকারি হাসপাতালে এই চিকিৎসা নেই, অল্প খরচে ক্লিনিকে ভালো চিকিৎসা হবে, সরকারি হাসপাতালে রোগনির্ণয়ের ব্যবস্থা নেই, অল্প খরচে অন্য জায়গায় সঠিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা হবে উল্লেখ করে রোগীর স্বজনদের বিভ্রান্ত করে ফেলে। উদ্বিগ্ন স্বজনদের অনেকেই দালালদের কথায় বিশ্বাস করে সরকারি হাসপাতাল ত্যাগ করেন এবং দালালদের দেখানো জায়গায় চিকিৎসা নেন।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, দালালদের দৌরাত্ম্যে রোগী ও রোগীর স্বজনেরা দিশেহারা। যেখানে রোগী, সেখানেই হাজির হয়ে যায় দালালেরা। মূল ফটক থেকে ওয়ার্ড পর্যন্ত গোটা হাসপাতালজুড়ে রয়েছে তাদের অবাধ বিচরণ ও আধিপত্য। রাজনৈতিকভাবে মদদপুষ্ট স্বেচ্ছাসেবক নাম দিয়ে প্রকাশ্যে দালালি করারও সুযোগ দেয়া হচ্ছে কয়েকজনকে। ভুক্তভোগীদের ভাষ্য, বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও রোগনির্ণয় কেন্দ্রের নিয়োগ করা দালালদের হাতে জিম্মি হয়ে পড়েছে হাসপাতালটির স্বাস্থ্যসেবা। তারা রাজনৈতিক আর্শীবাদপুষ্ট হওয়ায় কর্তৃপক্ষও অনেকটা অসহায় হয়ে পড়েছে। মাঝেমধ্যে ভ্রাম্যমাণ আদালত ও পুলিশের অভিযানে দালালদের আনাগোনা সাময়িকভাবে কমে এলেও অল্প দিনেই তা আগের অবস্থায় ফিরে আসে। সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ও নির্বাহী হাকিম কে এম মামুন উজ্জামান গত বৃহস্পতিবার দুপুরে দালাল ধরতে হাসপাতালে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করেন। তিনি ওইদিন নাছিমা খাতুন ও মৌ খাতুন নামে দুই দালালকে দণ্ডবিধির ১৮৮ ধারায় ১ হাজার টাকা করে অর্থদণ্ডের আদেশ দেন। তাদের কাছ থেকে মুচলেকা নেয়া হয় যে ভবিষ্যতে তারা আর দালালি করবেন না। এর আগে সদর থানার পুলিশ সাঈদ, সালমান, নাহিদ, সাব্বির ও আরিফ নামে পাঁচ দালালকে ধরে ৫৪ ধারায় গ্রেফতার দেখিয়ে জেলহাজতে পাঠায়। কিন্তু হাজতমুক্ত হয়ে তারা আবারও আগের পেশায় নেমে পড়ে। বৃহস্পতিবার সকালে সরেজমিনে দেখা যায়, হাসপাতালের মূল ফটক, জরুরি বিভাগের ভেতরে-বাইরে, বর্হিবিভাগে চিকিৎসকদের প্রায় প্রতিটি দরজার সামনে এবং অন্তর্বিভাগের সবকটি ওয়ার্ডেই দালালদের আনাগোনা। দুপুরে ভ্রাম্যমাণ আদালত অভিযানে নামলে তারা গা-ঢাকা দেয়। একজন চিকিৎসক দাবি করেন, হাসপাতালকে দালালমুক্ত করতে একাধিকবার উদ্যোগ নেয়া হলেও রাজনৈতিক চাপে সম্ভব হচ্ছে না। কর্তৃপক্ষ দালাল ধরে পুলিশে সোপর্দ করলেও জনপ্রতিনিধিদের চাপে তাদের তাৎক্ষণিক ছাড়িয়ে নেয়া হচ্ছে। এরপর তাদেরই স্বেচ্ছাসেবকের পরিচয়পত্র দিয়ে প্রকাশ্যে দালালির সুযোগ করে দিতে হচ্ছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, হাসপাতালটিতে এ রকম ২০ জন পরিচয়পত্রধারী স্বেচ্ছাসেবক রয়েছেন।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, দালালেরা প্রথমে নিজেদের হাসপাতালের কর্মী হিসেবে পরিচয় দেয়। হাসপাতালের অব্যবস্থাপনার কথা বলে রোগী ও রোগীর স্বজনদের উন্নত চিকিৎসার প্রলোভন দেখিয়ে বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে নিয়ে নেয়ার চেষ্টা করে। হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীদের হাসপাতালের চিকিৎসা যন্ত্রপাতি অচল ও নিম্নমানের দাবি করে বেসরকারি রোগনির্ণয় কেন্দ্রে নিয়ে যায়। অভিযোগ রয়েছে, হাসপাতালের বেশ কয়েকজন চিকিৎসক, নার্স ও কর্মচারীদের সাথেও দালালদের সখ্য রয়েছে। হাসপাতালের অর্থোপেডিক বিশেষজ্ঞ আবু বকর সিদ্দিক বলেন, হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রোগীকেও দালালেরা কৌশলে ‘ভাগিয়ে’ নিয়ে যায়। সাইনবোর্ডসর্বস্ব ক্লিনিকে নিয়ে উন্নত চিকিৎসার নামে এভাবে দীর্ঘদিন ধরে রোগীদের সাথে প্রতারণা করা হচ্ছে। একাধিক অর্থোপেডিক রোগীকে এভাবে সরকারি হাসপাতাল থেকে ক্লিনিকে নিয়ে অপারেশন করা হয়েছে। পরে কাটা অংশে পচন ধরায় ওইসব রোগী আবার হাসপাতালে ফিরে এসেছে। এমনও ঘটেছে পচনের কারণে কোনো কোনো রোগীর শরীর থেকে পা বিচ্ছিন্ন করতে হয়েছে। এমন রোগী ও স্বজনদের অপূরণীয় ক্ষতির দায় কেউ নেয়নি।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক ডাক্তার অভিযোগ করেন, রাজনৈতিক মদদের পাশাপাশি এসব দালালের কেউ কেউ আঞ্চলিক পত্রিকার সংবাদদাতার পরিচয়পত্র সাথে রেখে সার্বক্ষণিক হাসপাতালে অবস্থান করে। রোগীদের হাসপাতাল থেকে নিয়ে যায় বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে। প্রতিবাদ করলে ওই দালালেরা সংবাদপত্রে মিথ্যা প্রতিবেদন ছাপানোর হুমকি দেয়। এমনকি প্রাণনাশেরও হুমকি দেয়।

হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা (আরএমও) মাসুদ রানা বলেন, ‘সিভিল সার্জন মু. ছিদ্দিকুর রহমানের পরামর্শে হাসপাতালকে দালালমুক্ত করতে উদ্যোগ নিয়েছি। তবে সহকর্মীদের কাছ থেকে সেভাবে সহযোগিতা পাচ্ছি না। উল্টো দালালমুক্ত করতে গিয়ে আমাকেই প্রতিনিয়ত প্রাণনাশের হুমকির মুখে পড়তে হচ্ছে।’ প্রশাসনের পাশাপাশি হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা কমিটি প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিলে দালালদের তৎপরতা বন্ধ করা সম্ভব হবে বলে তিনি জানান।