কূটনৈতিক ভারসাম্যের সুফল পাচ্ছে সরকার

 

স্টাফ রিপোর্টার: বিশ্বের প্রভাবশালী ও ক্ষমতাধর দেশগুলোর সাথে ভারসাম্য রক্ষায় নেয়া কূটনৈতিক তৎপরতার সুফল পাচ্ছে সরকার। ভারত, চীন, রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, সৌদি আরব ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের ক্ষমতার বলয়ে থাকা অন্যান্য দেশগুলোর সঙ্গে আরো সম্পর্ক বৃদ্ধির লক্ষ্যে চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে সরকার। এরই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ, বঙ্গোপসাগরে ব্ল-ইকোনমি, পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন, আঞ্চলিক কানেকটিভিটিসহ বিভিন্ন প্রকল্পের কাজগুলো ভারসাম্য রক্ষা করেই এসব দেশের সহায়তা নেয়া হচ্ছে। কোনো প্রকল্পে বিশেষ একটি দেশের সহায়তা নিলে এই ভারসাম্য নষ্ট হতে পারে, এমন ক্ষেত্রে কনসোর্টিয়াম করা কৌশলে সরকার। যাতে কেউ মনে না করতে পারে বাংলাদেশ শুধুমাত্র এককভাবে কোনো একটি দেশের দিকে ঝুঁকে রয়েছে।
সরকারের এই উদ্যোগের অংশ হিসেবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কখনো নিজে এসব দেশ সফর করেছেন, আবার কখনো তার আমন্ত্রণে এসব দেশ থেকে শীর্ষ নেতারা বাংলাদেশ সফরে এসেছেন। তবে প্রতিটি সফরেই এসব ক্ষমতাধর দেশগুলোর সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক সর্বোচ্চ উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। এক্ষেত্রে অত্যন্ত সুচিন্তিতভাবে কূটনৈতিক নির্দেশনা ছিল। এছাড়া এসব দেশের সঙ্গে সম্ভাব্য প্রায় সব সেক্টরে চুক্তি করার পাশাপাশি নতুন অগ্রগতির চেষ্টা করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর বর্তমান মেয়াদের শুরুতেই যেমন চীন সফর করেছেন, তেমনি চীনের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে বাংলাদেশ সফর করেছেন, আবার ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে বাংলাদেশ সফরে এনেছেন। এ মাসে তিনিও ভারত সফর করবেন। এর ফলে ভারতের সঙ্গে চারদশক পর সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়ন হয়েছে, কানেকটিভিটি ও বাণিজ্যসহ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক এখন অন্য উচ্চতায় পৌঁছেছে। এছাড়া জাপানের প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশ সফর করলে, শেখ হাসিনাও জাপান সফরে গেছেন এবং এসব সফরে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে নতুন নতুন দিক উন্মোচন করেছেন।
সরকারের প্রথম মেয়াদে গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কে অবনতির পর দেশটির সঙ্গে পার্টনারশিপ ডায়ালগ, টিকফা চুক্তিসহ অনেক ক্ষেত্রেই পারস্পরিক সহযোগিতা বৃদ্ধি করা হয়েছে। এরপর সরকারের দ্বিতীয় মেয়াদে এখন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে কার্যকর ও বিভিন্ন সেক্টরে একসঙ্গে কাজ হচ্ছে এবং আরো নতুন সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। এরই ধারবাহিকতায় বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিপক্ষে অবস্থান নেয়া যুক্তরাষ্ট্র চারদশক পর প্রথম জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিতে শ্রদ্ধা জানিয়েছে। দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি সম্প্রতি ঢাকা সফরকালে ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরে গিয়ে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে এ শ্রদ্ধা জানান। আবার রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রকল্পে এবং সামরিক অস্ত্র কেনার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিদ্বন্দ্বী রাশিয়ার সহযোগিতাও নেয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী নিজেও রাশিয়া সফর করেছেন এবং রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্রুদিমির পুতিনও শিগগিরই বাংলাদেশ সফর আসবেন বলে কথা দিয়েছেন। এছাড়া সৌদি আরবের সঙ্গেও অবনতিশীল সম্পর্কের উন্নতি ঘটাতে সন্ত্রাসবিরোধী সৌদি জোট ঘোষণার পর তাতে যোগ দিতে দেরি করেনি বাংলাদেশ। এই জোটে সামরিক সহযোগিতা দেয়ারও ঘোষণা দেয় বাংলাদেশ। এরপর জুনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সৌদি সফরের মাধ্যমে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে নতুন গতি এসেছে। দেশটিতে বাংলাদেশের বৃহত্তম শ্রমবাজার ফের উন্মুক্ত হয়েছে এবং বাংলাদেশে বিনিয়োগ বাড়াতে উদ্যোগ নিয়েছে দেশটি। এই সফরে প্রধানমন্ত্রীকে সর্বোচ্চ আতিথিয়তা দেয়া হয়, যা আগে লক্ষ্য করা যায়নি।

এ প্রসঙ্গে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বলেন, আমাদের পররাষ্ট্রনীতিতেই সব দেশের সঙ্গে সুসম্পর্কের কথা বলা আছে। এছাড়া আওয়ামী লীগ শাসনামলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে নতুন সম্ভাবনা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। কারণ, জাতিসংঘের সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন, নারীর ক্ষমতায়ন ও উন্নয়ন, মাতৃ ও শিশু স্বাস্থ্য, শিক্ষাসহ আন্তর্জাতিক অনেক ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অগ্রগতি অর্জন করেছে, যা বিশ্বের কোনো তৃতীয় দেশ সেটি পারেনি। এছাড়া বৃহৎ রাষ্ট্রগুলো বিভিন্ন সামাজিক উন্নয়নে যেসব উন্নয়নশীল দেশগুলোকে সহায়তা দিয়েছে, তার মধ্যে একমাত্র বাংলাদেশই সেই লক্ষ্য অর্জন করতে পেরেছে। সেক্ষেত্রে অন্য দেশগুলোকে দেয়া সহায়তা একরকম জলে গেছে বলেই মনে করে সহায়তাকারী দেশগুলো। এছাড়া বিশ্বের অন্যান্য মুসলিম দেশগুলো অশান্ত থাকলেও বাংলাদেশ শান্তিপূর্ণ একটি দেশ হিসেবে পরিচিতি আছে। সেই হিসেবে বাংলাদেশের বিশ্বের প্রভাবশালী দেশগুলোর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছে।
পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম আরো বলেন, বাংলাদেশ বিশেষ আরো দুটি কারণে বিশ্বে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এক, ভৌগোলিক কারণে এবং দুই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের ১৬ কোটি মানুষকে সম্পদে পরিণত করেছেন। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়াসহ অনেক দেশ এখন স্বীকার করে প্রবাসী বাংলাদেশিদের পরিশ্রমেই তাদের দেশের উন্নয়ন হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় অভিবাসনের সঙ্গে উন্নয়নের যোগসূত্রের বিষয়টি বাংলাদেশই প্রথম বিশ্বে পরিচিত করেছে এবং তা আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেয়েছে। এখন বাংলাদেশের এই উদ্যোগটি জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হিসেবে স্থান পেয়েছে। এখন অভিবাসন ও উন্নয়ন এবং জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়ে বাংলাদেশ বিশ্বে নেতৃত্ব দিচ্ছে। এছাড়া বিশ্বে নারীর ক্ষমতায়নের বিষয়টি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাই প্রথম নিশ্চিত করেছেন, যা আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসিত হয়েছে। কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানায়, সরকারের কূটনৈতিক তৎপরতায় প্রায় তিন দশক পর আগামী ১৪ সেপ্টেম্বর ঢাকায় আসছেন চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। ঢাকায় সফরকালে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার বার্তা দেবেন তিনি। এজন্য দুই দেশের অর্থনৈতিক সম্পর্কের সঙ্গে কৌশলগত উপাদানও যুক্ত হবে। সফরকালে বাংলাদেশের ২৫টি প্রকল্পে প্রায় ১ লাখ ৫৭ হাজার কোটি টাকার অর্থায়নের বিষয়ে চূড়ান্ত ঘোষণা আসতে পারে। এ সময় ২০টি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) ও চুক্তি সইয়ের প্রস্তুতিও চলছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, শিল্প উৎপাদন-বিষয়ক রূপরেখা চুক্তি এবং বিনিয়োগ ও উৎপাদন-বিষয়ক একটি সমঝোতা স্মারক। বিশ্লেষকদের মতে, এর আগে গত বছর ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফরকালে ২২টি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়। এই সফরের মাধ্যমে দু’দেশের মধ্যে সবচেয়ে বড় বিরোধ সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়ন সম্ভব হয়েছে। আঞ্চলিক কানেকটিভিটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বাণিজ্য এবং সুসম্পর্ক আরো নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছে। এছাড়া রাশিয়ার প্রেসিডেন্টও শিগগিরই বাংলাদেশ সফরে আসবেন। আশা করা যায়, এই সফরও দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে একটি মাইলফলক হয়ে থাকবে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও মধ্যপ্রাচ্যের প্রভাবশালী দেশগুলোর সঙ্গেও সম্পর্ক উন্নয়নে কূটনৈতিক উদ্যোগ লক্ষণীয় সাফল্য এনেছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।